তেল প্রকল্প এলাকায় জীবিকা থেকে উচ্ছেদের প্রতিবাদ
২৬ নভেম্বর ২০২০এই প্রকল্প নিয়ে অবশ্য মোটের উপর রাজনৈতিক ঐকমত্য রয়েছে রাজ্যে৷
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ভারসাম্যকে বদলে দিয়েছিল৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই রাজ্যে ক্ষমতা পরিবর্তনের নেপথ্যে জমি লড়াই একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বাংলায় তেমন কোনো জমি বিরোধ দেখা যায়নি৷ তাঁর ঘোষিত নীতি, কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে জমি নেওয়া হবে না৷ কিন্তু বিধানসভা নির্বাচন যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, তখন জমির উপর নির্ভরশীল জীবিকা ঘিরে অসন্তোষের বুদবুদ তেল প্রকল্প ঘিরে৷
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ভারতের কেন্দ্রীয় সংস্থা অয়েল অ্যান্ড ন্যাচরাল গ্যাস কর্পোরেশন (ওএনজিসি) পশ্চিমবঙ্গের ভূগর্ভে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান চালাচ্ছে৷ তারা প্রথম উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায় তৃণমূল সরকারের আমলে৷ ২০১৪ সালে উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে যে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার মেলে, সেখানে বাণিজ্যিকভাবে উত্পাদন লাভজনক বলে সিদ্ধান্তে আসে ওএনজিসি৷ এর ফলে দেশ যেমন জ্বালানি পাবে, তেমনই বিপুল অঙ্কের রাজস্ব পাবে রাজ্য সরকার৷
অশোকনগরে মাটির নীচে তিন কিলোমিটারের বেশি গভীরে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস৷ তারও নীচে বিপুল তেল ভাণ্ডারের সন্ধান মিলেছে৷ এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর জন্য ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের কাছ থেকে তিন একরের বেশি জমি পেয়েছে ওএনজিসি৷ আরো ২০ একরের মতো জমি অদূর ভবিষ্যতে দরকার৷ প্রকল্প পূর্ণমাত্রায় শুরু করার জন্য প্রয়োজন বহু একর জমি৷ এই প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার হাত মিলিয়েই চলছে৷ স্থানীয় স্তরে পুরসভা ‘‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট'' দিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থাকে৷ কিন্তু হঠাৎ করে বিরোধ দেখা যাচ্ছে কেন?
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানের বক্তব্য উঠে এসেছে অশোকনগরের কথা৷ তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, এই এলাকা থেকে বাণিজ্যিকভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল উৎপাদনের অপেক্ষা শেষ হতে চলেছে৷ ইতিমধ্যে এখানকার তেলের নমুনা পাঠানো হয়েছে হলদিয়া শোধনাগারে৷ অর্থাৎ ছ'বছর পর এই কেন্দ্র চালু হওয়ার সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল হয়েছে৷ মন্ত্রীর বক্তব্যের পর কিছুটা আশঙ্কিত সরকারি জমিতে চাষাবাদের মাধ্যমে অন্নসংস্থান করা মানুষজন৷ তাই স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ প্রতিবাদ শুরু করেছেন৷ রাস্তায় পিকেটিং হয়েছে, পথ অবরোধও করা হয়েছে৷ সেই অবরোধের সামিল হয়েছেন অশোকনগরের পুর প্রশাসক বোর্ডের সদস্য সমীর দত্ত৷ কৃষকদের অনেকের দাবি, তাঁদের ব্যক্তিগত জমিও ওএনজিসি দখল করে নিচ্ছে ক্ষতিপূরণ নিয়ে ধোঁয়াশা রেখে৷ অথচ ৭০ বছর ধরে তাঁরা চাষ করছেন, জমির দলিলও আছে৷ মানবাধিকার কর্মী অম্বিকেশ মহাপাত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওখানকার কর্মযজ্ঞে সাধারণ মানু্ষের জমি আরো প্রয়োজন হলে ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি তাদের চাকরি দেওয়া উচিত৷ এটা সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করছে৷’’
তৃণমূল নেতা বিক্ষোভে যোগ দিলেও অবশ্য রাজ্যের শাসক দল ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে৷ অশোকনগর পুর প্রশাসক বোর্ডের প্রধান প্রবোধ সরকার বলেছেন, ‘‘এই জমি মূলত রাজ্যের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের৷ ব্যক্তিগত জমি নিতে হলে সরকারের নীতি অনুযায়ী নেওয়া হবে৷’’ তৃণমূল নেতার বিক্ষোভে সামিল হওয়াকে তাঁর নিজস্ব অবস্থান বলে ব্যাখ্যা করেন তিনি৷ রাজ্যের শাসক দলের অবস্থান স্পষ্ট করে অশোকনগরের বিধায়ক ধীমান রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকারি জমিতে অনেকে চাষাবাদ করেন৷ কেউ কৃষি মজুরের কাজ করেন৷ তাঁদের বিকল্প কর্মসংস্থানের দাবি সহানুভূতির সঙ্গে দেখা হবে৷ তবে তাঁরা কেউ জমির নথি দেখাতে পারেননি৷’’
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের থেকে এখানে পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা৷ সেখানে বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন ছিল৷ তাই অশোকনগর নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে মোটের উপর রাজনৈতিক ঐকমত্য দেখা যাচ্ছে৷ বিজেপি থেকে বামপন্থীরা এই প্রকল্পের সমর্থনে কথা বলছেন৷ সিপিএম সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই প্রকল্পে দেশের উপকার হবে৷ এলাকার অর্থনীতি উন্নত হবে৷ এই কথাটা আমরা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছি৷’’ বিজেপি নেতা রন্তিদেব সেনগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এত বড় প্রকল্প তৈরি হলে কত মানুষের কর্মসংস্থান হবে৷ অনুসারী শিল্প গড়ে উঠবে৷ হঠাৎ তাতে বাধা তৈরির একটা চেষ্টা দেখা যাচ্ছে৷ এতে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক অভিসন্ধি আছে বলে মনে হয়৷ আদতে এই প্রকল্প হলে সবারই উপকার৷’’