তুরস্কে লিরা নিয়ে কী হচ্ছে?
তুরস্কের মুদ্রা লিরার দর কমছে দ্রুতগতিতে৷ এর ফলে দেশটি বড় ধরনের ঋণের কবলে পড়তে যাচ্ছে৷ দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট৷ কিন্তু এই অবস্থার সৃষ্টি হলো কীভাবে?
সার্বিক পরিস্থিতি
ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক৷ বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৪৫ শতাংশ দর হারিয়েছে লিরা৷ এর ফলে বিশ্বের ১৮তম বৃহৎ অর্থনীতির এই দেশটি আরো মারাত্মক সংকটে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে৷ এর ধাক্কা এসে লাগছে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ, এমনকি ইউরোপের মার্কেটেও৷
বাণিজ্য ঘাটতি
তুরস্ক সবসময়ই বাণিজ্য ঘাটতিতে ভুগছে৷ আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে রয়েছে বিশাল ফারাক৷ বৈদেশিক মুদ্রা ধার করাকেই এ ঘাটতি মেটানোর উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে দেশটি৷ পাশাপাশি, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে স্বল্প সুদের সুযোগ নিয়ে অনেকেই উঠতি অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে বিনিয়োগের জন্য বেছে নিয়েছেন তুরস্ককেই৷
উন্নয়নে নগদ অর্থ
ঘাটতি মেটাতে ধার করা অর্থে বিশাল বিশাল সরকারি প্রকল্পের অর্থায়ন করা হয়েছে৷ এর ফলে তুরস্কের অর্থনীতি বড় হয়েছে, বাজারে পণ্যপ্রবাহ এবং বড় আকারের নির্মাণকাজ বাড়ায় সরকারের জনপ্রিয়তাও বেড়েছে৷ কিন্তু সে তুলনায় বাজার থেকে পর্যাপ্ত অর্থ ফেরত আসেনি৷
অর্থ প্রত্যাহার
সম্প্রতি মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়ে দেয়ায় উঠতি বাজারগুলো থেকে বিনিয়োগ প্রত্য়াহার করে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা৷ কঠিন করা হয়েছে অর্থ বরাদ্দের নীতিও৷ এর ফলে ডলারের দাম বেড়েছে, লিরার দাম কমেছে৷
এর্দোয়ানের ওপর অনাস্থা
তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ানের নীতিতে আস্থা হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা৷ এসব বিনিয়োগকারীদের চাহিদা ছিল এমন এক অর্থনৈতিক পলিসি, যা সুদের নিম্নহার সমর্তন করে৷ কিন্তু তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন এর্দোয়ান৷
ট্রাম্পের টুইট
১০ আগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দেন৷ এর ফলে দুই দেশের মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যে তেমন প্রভাব পড়েনি, কিন্তু তুরস্কের অর্থনীতিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা তাতে আরো কমে গেছে৷ টুইটে ট্রাম্প তুরস্কের লিরার কথা সরাসরি উল্লেখ করায় আরো বড় ধাক্কা খেয়েছে লিরা৷
বন্ধু? নাকি শত্রু?
তুরস্কে আটক মার্কিন যাজক অ্যান্ড্রু ব্রুনসনের মুক্তি নিয়ে দু’দেশের মধ্যে বেশ কিছু দিন ধরে টানাপড়েন চলছে৷ সিরিয়ায় কুর্দি যোদ্ধাদের মার্কিন সমর্থন, রুশ মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনতে তুরস্কের আগ্রহ, এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুরস্কে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে উসকানিদাতা হিসেবে অভিযুক্ত ফেতুল্লাহ গুলেনকে ফেরত আনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সংকট চলছে৷
সর্বময় একক কর্তৃত্ব
ওয়াশিংটন ও আঙ্কারার মধ্যে সম্পর্ক তুরস্কের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু এটিই একমাত্র কারণ নয়৷ লিরার দরপতনের ৩০ শতাংশই হয়েছে জুন মাসের পর৷ গত জুনে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান ক্ষমতা আরো সুসংহত করেন৷ এ বছরের জুনে নির্বাচন নিয়েও রয়েছে নানা ধরনের প্রশ্ন৷ এতে নিজ দেশে তাঁর ক্ষমতা দৃঢ় হলেও, দূরে ঠেলে দিয়েছে পশ্চিমা মিত্রদের৷
জামাতা আলবায়রাক
জুনের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিজের নিয়ন্ত্রণ বাড়ান এর্দোয়ান৷ অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কোনো বিশেষজ্ঞের হাতে না ছেড়ে মন্ত্রী বানান নিজ জামাতা বেরাত আল-বায়রাককে৷ এর ফলে তুর্কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপরও আস্থা কমেছে বিনিয়োগকারীদের৷
অর্থনৈতিক যুদ্ধ
লিরার দরপতনের পরও আস্থা ফেরাতে উপযুক্ত ভূমিকা নিতে পারেননি এর্দোয়ান৷ মূল সমস্যা খতিয়ে দেখার চেয়ে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধের’ হুমকি এবং পশ্চিমা বিশ্বের ‘প্রোপাগান্ডাকে’ দায়ী করে চলেছেন৷ সংকট থেকে উত্তরণে বিভিন্ন দেশের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোর বদলে দেশের নাগরিকদের ‘ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকার’ বুলি আওড়ানো হচ্ছে৷