তুরস্কে ভূমিকম্প : আলী ও তার পরিবারের গোরস্থানের জীবন
আলী ডোগরু তুরস্কের এক গোরখোদক৷ ভূমিকম্পের পর কবর খুড়ে মৃতদের শেষ শয্যায় শুইয়ে দেয়ার কাজে ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে৷ আলী ও তার পরিবারের এখন জীবন কাটে মৃতদেহ আর কবর ঘিরে৷ দেখুন ছবিঘরে....
ভূমিকম্প ও আলীর বদলে যাওয়া জীবন
গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে ৫৪ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়৷ অসংখ্য ভবন ধসে পড়ায় কয়েক লাখ মানুষ ঘরছাড়া৷ গোরখোদক আলী ডোগরুর বাড়ি এখন থেকেও নেই৷ নিজের বাড়ি ধসে পড়ছে দেখে দেখে সেই যে সপরিবারে ছুটে বেরিয়েছিলেন, এখনো সেখানে ফেরা হয়নি৷
বাসে বসবাস
ইসকেন্দারুনে নিজেদের বাড়ি থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেরিয়ে শহরের কবরস্থানের কাছেই একটু মাথা গোঁজার আশ্রয় খুঁজছিলেন ৪৬ বছর বয়সি আলী৷ হঠাৎ একটা খালি বাসের দিকে নজর যায় তার৷ অনেক ভেবেচিন্তে সেখানেই সপরিবারে থাকার সিদ্ধান্ত নেন৷
সেই বিভীষিকা
ইসকেন্দারুনের কবরস্থানের কাছের বাসে ওঠার পর থেকে টানা তিনদিন আলীর পরিবারের কারো মুখে খাবার ওঠেনি৷ এমনকি সন্তানদের মুখেও একটুখানি খাবার তুলে দিতে পারেননি আলী আর তার স্ত্রী হাতিস৷ বড় তিন ছেলে খিদের কষ্ট মেনে নিয়েছিল৷ কিন্তু কোলেরটা তো এতকিছু বোঝে না, এক সময় সে শুরু করলো খামচাখামচি আর কান্নাকাটি৷ মায়ের কাছে তার দাবি- এক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে, গিয়ে কিছু খেতে দিতে হবে!
লাশ দাফনের বিশেষ ব্যবস্থা
ভূমিকম্পের রাতে ১২ জনের দাফন সম্পন্ন করলেন আলী৷ তারপর থেকে কবরস্থানে মৃতদেহের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে৷ ভূমিকম্পের পরের প্রথম ১০ দিনে ইসকেন্দারুনের গোরস্থানেই কবর দেয়া হয় মোট ১২১০ জনকে৷ দু-তিনজন গোরখোদক আর দুজন ইমাম এত লোকের জানাজা পড়াতে পারছিলেন না বলে গোরখোদক বাড়াতে হলো, ইমামের সংখ্যাও বাড়লো৷ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে এলেন দশজন ইমাম৷
ভাইয়ের পাশে ভাই
আলী ও তার পরিবার বাসের মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে প্রথম কয়েকটি রাত কাটিয়েছেন৷ তারপর বিছানার ব্যবস্থাও হয়েছে৷ আলীর ছোট ভাই এমরুল্লাহ, তার স্ত্রী আসলি এবং তাদের সন্তান এখন কাছেরই এক তাঁবুতে থাকছে৷ ছবিতে তাঁবুর বাইরে নিজের এবং হাতিসের সন্তানদের সঙ্গে খেলছেন এমরুল্লাহর স্ত্রী আসলি৷
কবরই তাদের খেলার মাঠ
আলী আর তার ভাইয়ের সন্তানদের দিনের অধিকাংশ সময় কাটে গোরস্থানে৷ শুরুর দিকের আতঙ্কের ধাক্কা সামলে সেখানে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে তারা৷ খালি কফিনে শুয়ে-বসে, কবরের পাশ দিয়ে ছোটাছুটি করেই এখন সময় কেটে তাদের৷ ওপরের ছবিতে কবরস্থানে দৌড়ে বেড়াচ্ছে আলী ডোগরুর ১২ বছর বয়সি সন্তান সালিহ এবং তার নয় বছর বয়সি চাচাতে চাচাতো ভাই ইয়াভুজ৷
ভালোবাসার অটুট বন্ধন
গোরখোদকের কাজ কবর খোড়া৷ ছয় বছর ধরে এ কাজ করলেও গত কিছুদিনে এমন সব অভিজ্ঞতা হয়েছে যেগুলো আলীর চিরকাল মনে থাকবে৷ মা বা বাবা সন্তানকে জড়িয়ে ধরে মারা গেছেন, কেউ কেউ প্রিয়জনের হাত ধরেই ফেলেছেন শেষ নিঃশ্বাস৷ কবর দেয়ার আগে তাদের হাত ছাড়ানোর সে কী চেষ্টা! আলী হাত ছাড়াতে যাওয়া ব্যক্তিদের বাধা দিয়ে বলেছেন, ‘‘মৃত্যুও যে শিশু আর তার মা বা বাবার সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেনি, আপনি কেন তা ছিন্ন করতে চাইছেন?’’
শিশুদের ভবিষ্যৎ
আলী আর তার স্ত্রী হাতিস চার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত৷ ভূমিকম্প ও তার পরের অভিজ্ঞতা ওদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে না তো? ইসকেন্দারুনে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে এলেই আলী সন্তানদের মন ভালো করার চেষ্টা করবেন৷ প্রথমেই ছুটি নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবেন৷ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে সাবেক এই কসাই বলেছেন, ‘‘সব ঠিকঠাক হলে ওদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা আমি ভেবে রেখেছি৷’’
হাতিসের সামান্য চাওয়া
ভূমিকম্পে আলীর বাড়ির বেশি ক্ষতি হয়নি৷ দেয়ালে কিছু ফাটল দেখা গেছে, আর জানলার কিছু কাঁচ ভেঙেছে৷ তবে প্রাণভয়ে কেউ এখনো সেই এলাকায় ফিরছে না৷ কিন্তু আলীর স্ত্রী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেদের ঘরে ফিরতে চান৷ হাতিস বলেছেন, ‘‘আমাদের তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই৷ এখান থেকে কোথায় যাবো আমরা? আমি কিচ্ছু চাই না, শুধু আমার বাড়িটা ফিরে পেতে চাই৷’’ ছবিতে নিজেদের বাড়ির রান্নাঘরের ফাটল দেখছেন হাতিস এবং আলী৷