1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঢাকার ভবনগুলো যেন ‘টাইম বোমা’

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৮ মার্চ ২০২৩

সিদ্দিক বাজারে ভবন বিস্ফোরণের তীব্রতা ও হতাহতে বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে পড়েছেন বিশ্লেষকেরা। তার বলছেন ঢাকা শহরে পর পর দুইটি একই ধরনের ভবন বিষ্ফোরণের ঘটনা রাজধানীতে নতুন দুর্যোগের আভাস দিচ্ছে।

https://p.dw.com/p/4OP9T
Bangladesch Explosion eines Gebäudes in Dhaka
ছবি: Mortuza Rashed/DW

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ঢাকা শহরের  শহরের ভবনগুলো যেন এখন টাইম বোমায় রূপান্তরিত হয়েছে। সব অনিয়ম এখন পুঞ্জিভূত হয়ে একটার পর একটা বিপর্যয় ঘটছে। এখন সামনে এসেছে গ্যাস, স্যুয়ারেজ এমনকি ওসাসার পানির লাইন বিষ্ফোলন ইস্যু। এধরনে ঘটনা আরো ঘটবে বলে তাদের আশঙ্কা।

সিদ্দিক বাজারের মঙ্গলবারের ঘটনায় এপর্যন্ত ২০ জন নিহত হয়েছেন, আহত একশতের বেশি।

এরইমধ্যে সেনাবাহিনিসহ সরকারের বিভিন্ন বাহিনির বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করো কোনো নাশকতামূলক বিস্ফোরক বা বিস্ফোরণের আলামত পায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে বেসমেন্টে গ্যাস জমে এই বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক আলি আহমদ খান বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সব কিছু দেখে, শুনে আমার মনে হয়েছে এটা গ্যাসেরই বিস্ফোরণ। ওখানে অনেক গুলো গ্যাস লাইন আছে। একটি লাইন থেকে আরো লাইন নেয়া হয়েছে অবৈধভাবে। লাইনগুলো অনেক পুরাতন। ওখান থেকে বের হওয়া গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ হয়েছে। সামান্য কোনো স্পার্ক বা দাহ্য আগুন এই বিস্ফোরণ ঘটাতে সহায়তা করেছে হয়তো।”

‘পুরাতন লাইনগুলোয় গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ হয়েছে’

তিনি বলেন,"নারায়ণগঞ্জে মসজিদে এবং মগবাজারে একইভাবে বিস্ফোরণ ঘটেছিলো। বাতাসে শতকরা ৫ ভাগ থেকে ১৭ ভাগ গ্যাস থাকলেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আর এর তীব্রতা নির্ভর করে যেখানে বিস্ফোরণ হয় সেই জায়গাটি কতটা বদ্ধ তার ওপর। সিদ্দিকবাজারে বেজমেন্টে বিস্ফোরণ তীব্রতা বাড়িয়েছে। খোলা থাকলে গ্যাস জমতে পারতো না। বের হয়ে যেত।''

তিনি বলেন," আমার অভিজ্ঞতা বলছে এধরনের ঘটনা আরো ঘটবে। কারণ অনেক ভবন আছে যেখানে অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস লাইন আছে।”

ভয়াবহ বিস্ফোরণে তারা বিস্মিত:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম নুরুল আমিন বলেন,"স্যুয়ারেজের লাইন থেকে মিথেন গ্যাস জমেও এধরনের বিস্ফোণের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে সিদ্দিক বাজারের ঘটনায় সেটা হয়নি। কারণ যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছে সেখানে স্যুয়ারেজের লাইন থেকে গ্যাস আসার সুযোগ নেই। সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার ভবনে হয়তো হতে পারে। তবে দুইটি ঘটনায়ই বিষ্ফোরণের যে ভয়াবহতা তা আমাকে অবাক করেছে। তাই গভীর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন যে আরো কোনো ইস্যু এইসব ঘটনায় আছে কী না।”

তিনি বলেন, "আমরা সীতকুন্ডে দেখেছি, ওখানে আরো সিলিন্ডার ছিলো। ফলে ওগুলোও বিষ্ফোরিত হয়ে বিষ্ফোরণের তীব্রতা বেড়েছে। এখানে বিষ্ফোরণের তীব্রতায় আমি বিস্মতি হয়েছি। তাই দেখা প্রয়োজন তীব্রতা বাড়াতে আর কোনো উপাদান কাজ করেছে কী না।”

কেন এত তীব্র বিস্ফোরণ:

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর)-পরিচালক ড. রেজাউল করিম বলেন,"বিষ্ফোরণের তীব্রতার কারণ হলো বিস্ফোরণটি বদ্ধ জায়গায় ঘটেছে। খোলামেলা জায়গায় হলে এতটা তীব্র হতো না। আমাদের অনেক মার্কেট এবং ভবন আছে যেগুলো বদ্ধ। ঠিক মতো আলো বাতাস যায়না, ঘিঞ্জি। ফলে আতঙ্কের কারণ আছে।”

ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. হাসান মোহাম্মদ মোস্তফা আফরোজ বলেন, "তিন কারণে সেখানে বিস্ফোরণ হতে পারে। প্রথমত স্যুয়ারেজ লাইন লিক করে গ্যাস যখন ভবনের মধ্যে বদ্ধ জায়গায় জমতে থাকে তখন সেখান থেকে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। স্যুয়ারেজের গ্যাসের মধ্যে মিথেন ও হাইড্রোজেন সালফায়েড উভয়ই থাকে। এই দুটো গ্যাসে আগুন ধরে যায়। এটা হতে পারে যখন বাসার ওয়াশরুমের কমোড বা বেসিনটা অনেক দিন ধরে ব্যবহার হচ্ছে না, তখন এটা ফ্ল্যাশ না হওয়ায় পাইপের মধ্যে পানি যাচ্ছে না। এর ফলে গ্যাস জমা হতে পারে। এভাবে কোনো ফ্লোরে বা কক্ষে অনেক দিন ধরে গ্যাস জমা হতে থাকলে বিস্ফোরণ হতে পারে। আর তিতাস গ্যাসের লাইনে যদি লিকেজ থাকে তাহলেও গ্যাস জমে আগুন ধরে যেতে পারে বা গ্যাসের পরিমাণ বেশি জমলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। মোট বাতাসের শতকরা পাঁচ ভাগ গ্যাস হলেই বিষ্ফোরণ ঘটবে বা আগুন জ¦লবে। আমার মনে হয় সিদ্দিক বাজারের ভবনটির বেজমেন্টে অনেক বেশি গ্যাস জমেছিলো। তাই এত ভয়াবহ আকারে বিস্ফেরণ হয়েছে। আর সাধারণভাবে গ্যাস লিকেজের কারণে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে এতে ভয়বহতা বেশি ছড়ায়। আর এসি থেকেও বিস্ফোরণ হয়। তবে সাধারণ কোনো কারণে এসি বিস্ফোরণ ঘটে না। মেকানিক যখন এসি মেরামত করে তখন অনেক সময় লিকেজ থেকে যায়। ওই লিকেজ থেকে এসির বিস্ফোরণ ঘটে থাকে।”

শহরে নতুন আতঙ্ক:

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, "এখন শহরে এই প্ল্যাম্বার্স বিস্ফোরণ নতুন আতঙ্ক তৈরি করেছে। ঢাকার শতকরা ৫৫ ভাগ ভবনই ঝুঁকির মধ্যে আছে। সেখানে না আছে অগ্নি নিরাপত্তা, না আছে এই ধরনের বিষ্ফোরণ ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা। শুধু তিতাসের লাইন কেন ওয়াসার লাইনেও গ্যাস জমে তা লিকেজ হয়ে বিষ্ফোরণ ঘটতে পারে। এজন্য রাজউক, তিতাস বা ওয়াসার কোনো দায়িত্ব আছে বলে মনে হয় না। আর নগারিকেরাও উদাসীন। একটি এ্যাপার্টমেন্টের ইলেট্রিক সিস্টেম যা তাতে হয়তো একটি এসি চালানো সম্ভব। কিন্তু চালানো হচ্ছে পাঁচটি। চাপ না নিতে পেরে বিদ্যুতের লাইন জ্বলে যায়, এসি বিস্ফোরণ ঘটে।”

আর বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, "ঢাকার ভবনগুলো যেন এখন টাইম বোমায় পরিণত হয়েছে। যেকোনো ধরনের অপঘাত যেকোনো সময় হতে পারে। মাত্র ১০০ ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট আছে। এটা বিশ্বাস করা যায়! সব ধরনের ব্যবস্থা সঠিক থাকলে এই সার্টিফিকেট দেয়া হয়। আর পাঁচ বছর পর পর তা আবার চেক করে নতুন করে নিতে হয়।

আসলে ভবনগুলো যাদের দেখার কথা তারা দেখছেন না। আমার মনে হয় প্রাইভেট সেক্টরকে এই দায়িত্ব দেয়া যায়।”