ঢাকাই জামদানির ইতিকথা
নান্দনিক ডিজাইন এবং সূক্ষ্ম কারুকাজের জামদানি শাড়ি বাঙালির ঐতিহ্যের অংশ। এ শাড়ির সমাদর বিশ্বব্যাপী। ছবিঘরে ঢাকাই জামদানি সম্পর্কে বিস্তারিত....
জামদানির ইতিহাস
জামদানির প্রাচীনতম উল্লেখ রয়েছে ৩০০ খ্রিষ্টাব্দে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে। ‘জামদানি’ নামকরণ সম্পর্কে একাধিক মতবাদ রয়েছে। ফারসি থেকে জামদানি, যা ‘জামা’, অর্থাৎ কাপড় এবং ‘দানা’, অর্থাৎ বুটি- এই দুই শব্দের যোগফল। আরেকটি মতবাদ অনুযায়ী, ফারসি শব্দ ‘জাম’, অর্থাৎ উৎকৃষ্ট মদ এবং ‘দানি’, অর্থাৎ পেয়ালা- এই দুইয়ের মিলিত ফল জামদানি। জাম পরিবেশনকারী ইরানি সাকীর পরনের মসলিন থেকে জামদানি নামের উৎপত্তি।
জামদানির প্রকারভেদ
জামদানি হলো কার্পাস তুলা দিয়ে তৈরি পরিধেয় বস্ত্র যার বুনন পদ্ধতি অনন্য। জামদানি শাড়ী অনেক রকমের হলেও প্রাথমিকভাবে উপাদান অনুযায়ী এটি তিন প্রকারের- হাফ সিল্ক, ফুল কটন এবং ফুল সিল্ক জামদানি। সুতার মান, কাজের সূক্ষ্মতা, ডিজাইনে নতুনত্ব- এই তিনের তারতম্য ভেদে একটি জামদানি শাড়ির দাম তিন হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
নানা নামের জামদানি
নকশা অনুযায়ী জামদানির নানা নাম হয়ে থাকে। যেমন, তেরছা, জলপাড়, পান্না হাজার, করোলা, দুবলাজাল, সাবুরগা, বলিহার, শাপলা ফুল, আঙ্গুরলতা, ময়ূরপ্যাঁচপাড়, বাঘনলি, কলমিলতা, চন্দ্রপাড়, ঝুমকা, বুটিদার, ঝালর, ময়ূরপাখা, পুইলতা, পানসি, কল্কাপাড়, কচুপাতা, প্রজাপতি, জুঁইবুটি, হংসবলাকা, শবনম, ঝুমকা, জবাফুল- এসব নাম-ই বেশি জনপ্রিয়।
জামদানির হাট
দেশের বিভিন্ন মার্কেট এবং শপিংমলে জামদানি শাড়ি পাওয়া গেলেও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বিসিক জামদানি শিল্প নগরী এবং ডেমরাতে দেশের অন্যতম প্রাচীন পাইকারি ও খুচরা জামদানি শাড়ি বিক্রির হাট বসে। স্থানীয়দের মতে, রূপগঞ্জ জামদানি হাটের বয়স এক যুগ হলেও ডেমরার হাটটি বসছে ব্রিটিশ আমল থেকে।
সুতার কাউন্ট
জামদানি শাড়ি বোনায় সুতি ও সিল্কের সুতা ব্যবহৃত হয়। সুতার সূক্ষ্মতাকে ‘কাউন্ট’ বলে। কাউন্ট যত বেশি, সুতা তত ভালো এবং সুতা যত ভালো শাড়ি তত মসৃণ এবং আরামদায়ক। জামদানি বয়নে সাধারণত ২৬ কাউন্ট থেকে শুরু করে ২৫০ কাউন্টের সুতা ব্যবহৃত হয়। পাকা রং এবং চিকন সুতা হওয়ার কারণে নীল, ধানী সবুজ, আকাশি, মেরুন রংয়ের সুতা ৩০-৩৫ টাকা এবং টিয়া, গাব, পেস্ট, কাঁঠালি, সোনালী রংয়ের মোটা সুতা ১৪ টাকা দরে বিক্রি হয়।
সরঞ্জাম
জামদানি হাটের কাছে জামদানি শাড়ি তৈরির বেশ কিছু সরঞ্জাম দেখা যায়। মনজু মিয়া নামের একজন বিক্রেতা জানান, চরকার দাম ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা, টাক্কু ১০০ টাকা, মাক্কু ৪৫০ টাকা, কান্ডুল ১৫০ টাকা, চাকু ১০ টাকা, ছোট-বড় চরকি ১৬০ টাকা, শাড়ির রোল ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা, শানা ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।
হাটে কোটি টাকার শাড়ি বিক্রি
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বিসিক জামদানি শিল্প নগরী এবং ডেমরার জামদানি হাটে প্রতি শুক্রবার হাট বসে। সপ্তাহব্যাপী তাঁতিরা শাড়ি বোনেন৷ এসব হাটে বিক্রি হয় তাদের শাড়ি৷ বিক্রেতারা জানান, শাড়িগুলো দামি হওয়ায় প্রতি হাটে কোটি টাকার বেশি দামের শাড়ির বেচাকেনা হয়ে থাকে।
কঠোর পরিশ্রম
জামদানি শিল্প সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতি সপ্তাহে শনি থেকে বৃহস্পতিবার তাঁতিরা শাড়ি বুনেন। একটা শাড়ি বুনতে ২ জন শ্রমিককে দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা কাজ করতে হয়। ২০ হাজার টাকা দামের একটি শাড়ি তৈরিতে সময় লাগে প্রায় ১৫ দিন। এছাড়া কাজের সূক্ষ্মতা এবং ডিজাইনভেদে একটি শাড়ি বুনতে সময় লাগতে পারে ৩ দিন থেকে ৬ মাস পর্যন্ত। তাঁতিরা মজুরি পান শাড়ি বিক্রির কমিশন এবং ডিজাইনের ভিত্তিতে।
নারী উদ্যোক্তা
ঢাকার নারায়ণগঞ্জ এবং ডেমরার হাটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একাধিক নারী উদ্যোক্তা শাড়ি কিনছেন। ঢাকার ধানমন্ডি থেকে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী উদ্যোক্তা জানান, তিনি প্রায় ৫ বছর ধরে জামদানি, বেনারশি শাড়ি বিক্রি করছেন। আগে পরিচিতদের কাছে বিক্রি করলেও এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে বিক্রি করছেন।
ইউনেস্কোর স্বীকৃতি
জামদানী নানা স্থানে তৈরি করা হলেও ঢাকাকেই জামদানির আদি জন্মস্থান বলে গণ্য করা হয়। জামদানি বয়নে অতুলনীয় পদ্ধতি ইউনেস্কো কর্তৃক একটি ‘অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ২০১৬ সালে দেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি পায় জামদানি।
আসল জামদানি চেনার উপায়
আসল জামদানি চেনার কয়েকটি উপায় হলো, শাড়ির শুরুতে সাড়ে পাঁচ হাত পর্যন্ত কোনো পাড় থাকে না। শাড়ির ডিজাইন হয় খুব সূক্ষ্ম, নিখুঁত এবং মসৃণ। জামদানি শাড়ির সামনের অংশ আর ভেতরের অংশ পার্থক্য করা বেশ কঠিন। জামদানির সিল্ক সুতায় মাড় দেয়া থাকায় সেটা হবে অপেক্ষাকৃত অমসৃণ। সাধারণ পিওর সিল্কের সুতা টানাটানি করলে ছিঁড়ে যায় এবং আগুনে পোড়ালে চুলের মতো পোড়া গন্ধ বেরোয়।
বিদেশে রপ্তানি
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ বিসিক জামদানি পল্লীতে শাড়ি কিনতে আসা পাইকার মো. সালাউদ্দিন বলেন, তিনি কোলকাতায়ও জামদানি শাড়ি সরবরাহ করেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ছাড়াও ইউরোপ, অ্যামেরিকার বাঙালিদের মধ্যে এ শাড়ির চাহিদা রয়েছে। তার পরিচিত অনেক ব্যবসায়ীই বিভিন্ন দেশে জামদানি সরবরাহ করে থাকেন।
মেশিনে বোনা জামদানি
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল অঞ্চলে মূলত মেশিনে জামদানি তৈরি হয়। মেশিনে বোনা শাড়ি পলেস্টার বা নাইলনের মতো কৃত্রিম সুতোয় তৈরি হয় বলে সেগুলো ভারি এবং খসখসে হয়। মেশিনে বোনা শাড়ি দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায় এবং দামেও সস্তা। মেশিনে বোনা শাড়ির উল্টো পিঠের সুতাগুলো কাটা কাটা অবস্থায় বের হয়ে থাকে, বুনন ঘন এবং পুরো শাড়ি জুড়েই পাড় থাকে। একটি মেশিনে দিনে একাধিক জামদানি শাড়ি তৈরি করা যায় বলে সময়ও শ্রম কম লাগে।
দাম বেশি
অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি জানান, বছর তিনেক আগে যখন এ হাটে এসেছিলেন, তখন খুচরা দোকানের চেয়ে এখানে দাম বেশ কম ছিল। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াসহ অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় এখন তাঁতিরা হাল দাম জানতে পারেন এবং তারাও প্রায় সমান দাম হাঁকান। তাই এবার এসে জামদানির দাম যথেষ্ট বেশি মনে হয়েছে তার কাছে।
বিক্রির মৌসুম
তাঁতি এবং পাইকারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সারা বছর জামদানির মোটামুটি চাহিদা থাকলেও রোজার ঈদের ১৫ দিন আগে থেকে চাহিদা বহুগুণে বেড়ে যায়। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যেমন পহেলা বৈশাখ, বড়দিন, হিন্দুদের পূজা-পার্বনে এ শাড়ির চাহিদা বেড়ে থাকে। তবে হালকা হওয়ায় শীতের সময় এ শাড়ির চাহিদা কম থাকে।
আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা
রোকেয়া জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরির মালিক জামান মিয়া বলেন, জামদানি শিল্পের কদর থাকায় সরকারি এবং বেসরকারি ঋণ পাওয়া যায়। তিনি সরকারিভাবে ১০টি তাঁতের বিপরীতে ৫ লক্ষ টাকা ঋণ পেয়েছেন বলে জানান। প্রতিটি তাঁত বা পডি’তে ছয় মাসে তাকে নয় হাজার টাকা সুদ দিতে হয়। তবে এর চেয়ে কম সুদে ঋণ পেলে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ উপকৃত হতো বলে মনে করেন তিনি।
আছে শিশু তাঁত শ্রমিকও
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ বিসিক জামদানি পল্লীতে প্রতি ঘরেই তাঁতের ব্যবসা বা মেশিন রয়েছে। শিশুরাও পড়াশোনা বন্ধ করে এ পেশায় যোগ দিচ্ছে। এক তাঁতি বলেন, তার ফ্যাক্টরিতে একাধিক শিশু কাজ করেন। প্রথম দুই বছর তাদের শিক্ষানবিশকালীন সময়। এ সময়ে শিশুটির যাবতীয় খরচ মালিকের। এছাড়া কাজ শিখে গেলে বাচ্চার অভিভাবকের হাতে এককালীন টাকা দেওয়া হয়ে থাকে। ঝুঁকিহীন এবং আয় বেশ ভালো বলে এ কাজে অনেক শিশু আসছে বলে জানান তিনি।
সকাল নয়টার মধ্যেই বেচাকেনা শেষ
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ বিসিক জামদানি হাট এবং ডেমরার হাটে বেচাকেনা শুরু হয় ভোরের আলো ফোটার আগেই। বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারি ক্রেতা, বিক্রেতা এবং তাঁতিরা ভিড় করতে থাকেন হাটে। হাটগুলোতে হাজার হাজার শাড়ি বিক্রি হয় এবং সকাল ৯টার মধ্যেই বেচাকেনা শেষ হয়ে যায়।
হাটে কিভাবে যাবেন
যারা ঢাকা থেকে ডেমরা অথবা রূপগঞ্জের জামদানি হাটে যেতে চান, তারা বাসে গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ডেমরা রুটে অথবা মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে কাঁচপুর ব্রিজ হয়ে তারাব বিশ্বরোডে গিয়ে নামতে পারেন। সেখান থেকে ১ কিলোমিটার ভিতরেই রূপগঞ্জ বিসিক জামদানি পল্লী। এছাড়া ৩০০ ফিটের রাস্তা হয়েও সেখানে যাওয়া যায়।