ঢাকা মেডিকেল : বিশ্বমানের চিকিৎসক আছে, অবকাঠামো নেই
২২ মার্চ ২০২২মোট তিনবার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লাবিবা-লামিসাকে আলাদা করা হয় সোমবার৷
এই হাসপাতালে বিরল রোগের চিকিৎসা ও সফল অস্ত্রোপচার আগেও অনেক হয়েছে৷
লাবিবা-লামিসার ১২ ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে যুক্ত ছিলেন ৩৮জন চিকিৎসক৷ চিকিৎসকরা আশা করছেন এই দুই শিশু এখন থেকে আলাদাভাবে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে৷
তাদের জন্ম ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার যদুনাথপুর গ্রামে৷ তাদের যোনীদ্বার, মলদ্বার, প্রস্রাবের রাস্তা জোড়া লাগানো ছিল৷ মেরুদণ্ডও জোড়া লাগানো ছিল৷
চিকিৎসক দলের সদস্য এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. অসিত চন্দ্র সরকার বলেন, ‘‘১০-১২ দিনের মধ্যেই আশা করছি শিশু দুটি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে৷ কোনো ইনফেকশন হয় কিনা তা দেখার জন্য এখন আমরা তাদের পর্যবেক্ষণে রেখেছি৷’’
তবে ঢাকা মেডিকেলে জোড়া শিশুকে আলাদা করার অস্ত্রোপচার এটাই প্রথম নয়৷ এর আগে গাইবান্ধার জোড়া লাগা জমজ শিশু তোফা-তহুরাকেও ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট আলাদা করা হয়েছিল এই হাসপাতালে৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটাই ছিল প্রথম কোনো ‘পাইগোপেগাস’ শিশুকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করা৷ তাদের মাথা-হাত-পা সব কিছু আলাদা থাকলেও পিঠের নীচ থেকে কোমর পর্যন্ত জোড়া লাগানো ছিল৷ জোড়া লাগানো ছিল ভিতরের আরো কয়েকটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ৷ ওই অস্ত্রোপচারে ২২ জন চিকিৎসকের মোট ৯ ঘণ্টা সময় লেগেছিল৷
এর আগে ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই মুক্তামণি নামে আরেক শিশুর ডান হাতে সফল অস্ত্রোপচার হয়৷ মুক্তামণির রক্তনালিতে টিউমার হয়েছিল, যার প্রতিক্রিয়ার তার ডান হাতটি ফুলে কোলবালিশের মতো হয়ে যায়৷ সেই খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়৷ প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে তারা মুক্তামণির হাত কেটে শরীর থেকে বাদ দেয়ার পরামর্শ দেন৷ কিন্তু বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা তার হাতটি টিকিয়ে রাখতে নিজেরাই চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপচারের উদ্যোগ নেন৷ সেই অস্ত্রোপচারে ডা. সামন্ত লাল সেনসহ ১১ জন চিকিৎসক অংশ নেন৷ একবার নয়, ধাপে ধাপে ছয়বার অস্ত্রোপচার করে মুক্তার হাতটি রক্ষা করা হয়৷ মুক্তামণির রক্তনালির টিউমার কেটে বাদ দেয়া হয়৷ প্রায় দুই থেকে আড়াই কেজি ওজনের মাংসপিন্ড তার হাত থেকে কেটে ফেলা হয়৷ মুক্তামণি যে বিরল রোগে ভুগছিল তার নাম ‘হোমানজিওমা’৷ মুক্তামণির অপারেশন সফল হলেও দুঃখজনকভাবে ২০১৮ সালের ২৩ মে সে রক্তশূণ্যতায় ভুগে মারা যায়৷
বৃক্ষমানব হিসেবে পরিচিতি পাওয়া খুলনার পাইকগাছার আবুল বাজানদারের অস্ত্রোপচারও সারাদেশে আলোচিত হয়েছিল৷ ২০১৬ সালে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে তার দুই হাতে কয়েক দফা অস্ত্রোপচার হয়৷ ১০ বছর ধরে ‘ট্রিম্যান সিন্ড্রোম’ নামের বিরল রোগে ভোগা আবুল বাজানদারের দুই হাত ও পায়ে গাছের শিকড়ের মতো গজিয়ে উঠেছিল, যা তার হাত-পা-কে অকেজো করে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত করেছিল৷ ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত তার হাত ও পায়ে মোট ছয় বার অস্ত্রোপচার করে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়৷ বাংলাদেশের চিকিৎসকরা তখন জানান, এর আগে পুরো পৃথিবীতে আর মাত্র দুইজন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে তাদের জানা আছে৷
শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, ‘‘আবুল বাজানদার এখন মোটামুটি ভালো আছেন৷ মাঝেমধ্যে আমাকে ফোন করেন৷ তবে মুক্তামণির মৃত্যু আমাকে কষ্ট দেয়৷’’
এইসব বিরল রোগের চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপচার দেশের চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের প্রতি আস্থা তৈরি করছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা৷ তবে চিকিৎসার অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে আরো অনেক জটিল রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা সহায়তা দেয়া সম্ভব হবে বলে তারা মনে করেন৷
অধ্যাপক ডা. অসিত চন্দ্র সরকার বলেন, ‘‘আমরা যে সব পারি তা নয়৷ তবে এখন অনেক জটিল অস্ত্রোপচার এবং জটিল রোগের চিকিৎসা এখানে সম্ভব হচ্ছে৷ প্রশিক্ষিত চিকিৎসক দল তৈরি হয়েছে, হচ্ছে৷ তবে আমাদের অবকাঠামোগত সমস্যা আছে৷ পর্যাপ্ত অপারেশন থিয়েটার নেই৷ ফলে অনেক রোগীকে আমরা সময়মতো অপারেশন করতে পারি না৷ তাদের হাসপাতালে বসিয়ে রাখতে হয়৷ ফলে অনেক সময়ই আমরা মানুষের প্রত্যাশার জায়গা পূরণ করতে পারি না৷’’
তবে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের চিকিৎসক ও চিকিৎসার ওপর দেশের মানুষ ধীরে ধীরে আস্থাবান হচ্ছে৷ আমাদেরই সিনিয়ররা, যারা দেশের বাইরে যেতেন বা রোগীকে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দিতেন, তারা এখন দেশেই চিকিৎিসা নিচ্ছেন এবং চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন৷’’
আর অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘‘এই ধরনের জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা, অপারেশন যে এখন বাংলাদেশে সম্ভব, তা গ্রামের মানুষ জানেন না৷ সবাই তো চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন না৷ মুক্তামণিকে তো দীর্ঘদিন ধরে গ্রামে কবিরাজি চিকিৎসা করিয়েছে৷ তাই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এই ধরনের রোগের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ইউনিট করা দরকার৷ তারাই তখন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন৷ শুরুতেই চিকিৎসা হলে হয়ত অস্ত্রোপচারেরও প্রয়োজন হয় না৷’’
তার কথা, ‘‘এটা শুধু ঢাকা মেডিকেল বা দুই-একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করলে হবে না৷ আমাদের বিশ্বমানের চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে৷ কিন্তু অবকাঠামো নেই৷ যে অস্ত্রোপচারগুলোর কথা আপনি বললেন, সেই রোগীদের কথা যদি সংবাদমাধ্যমে না আসতো, তাহলে আমরা তো জানতামই না৷ চিকিৎসা বা অপারেশন তো দূরের কথা৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এরকম আরো অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষ আছে, যাদের কথা আমরা জানি না৷’’