‘ডার্টি বম্ব’এর বিপদ
১৯ এপ্রিল ২০১০সম্প্রতি ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হল পারমাণবিক নিরাপত্তা বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন৷ কিন্তু সন্ত্রাসবাদীদের হাতে পরমাণু অস্ত্র চলে আসার আশঙ্কা নিয়ে দুশ্চিন্তা এখনো যাচ্ছে না৷
প্রেক্ষাপট
শীতল যুদ্ধ চলাকালীন পরমাণু অস্ত্রসম্ভার নাটকীয় মাত্রায় বেড়ে গেলেও দুই শিবিরের মধ্যে এক অটুট ভারসাম্যের ফলে পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের ঝুঁকিও ছিল অত্যন্ত কম৷ কিন্তু আজ পরিস্থিতি বদলে গেছে৷ স্বীকৃত ৫ পরমাণু শক্তি ছাড়াও ভারত-পাকিস্তান এবং অন্যান্য কিছু দেশের হাতে হয় পরমাণু অস্ত্র এসে গেছে, কিংবা প্রায় এসে গেছে বলে ধারণা করা হয়৷ তার উপর গজিয়ে উঠেছে আল কায়েদার মত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন, যা পরমাণু অস্ত্র হাতে পেতে ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা দাবি করছে৷ রাষ্ট্রের মত পরিকাঠামো না থাকলেও সুযোগ পেলে সন্ত্রাসবাদীরা কোনোক্রমে জনপদের মধ্যে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অভাবনীয় মাত্রার প্রাণহানি ঘটাতে বদ্ধপরিকর বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ এমন অস্ত্রের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডার্টি বম্ব'৷
সন্ত্রাসবাদীদের হাতে এমন ‘ডার্টি বম্ব' আসার সম্ভাবনা কতটা? সন্ত্রাসী হামলার নিত্য নতুন ফন্দির দিকে তাকালে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন৷ পরমাণু অস্ত্র সুরক্ষিত রাখতে রাষ্ট্রীয় স্তরে একাধিক স্তরে অত্যন্ত জটিল এক জাল রয়েছে৷ ফলে অস্ত্র চুরি করা সহজ নয়, বা করতে পারলেও তা প্রয়োগ করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা আরও কঠিন কাজ৷ কিন্তু সর্ষের মধ্যেই ভুত থাকলে বিষয়টি ততটা কঠিন হবে না৷ পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত কোন বিজ্ঞানী এভাবে অন্য কোন রাষ্ট্র বা সন্ত্রাসবাদীদের মদত করতে পারেন – যেমনটা দেখা গেছে পাকিস্তানের আবদুল কাদের খানের ক্ষেত্রে৷ অন্য অনেক ক্ষেত্রেও এমন প্রচেষ্টার খবর পাওয়া গেছে৷
সহজলভ্য তেজস্ক্রিয় পদার্থ
তবে এমন নাটকীয় প্রচেষ্টা ছাড়াও পরমাণু অস্ত্রের উপাদান সংগ্রহ করার আরও কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে৷ দুই ছিঁচকে চোর ব্রাজিলের এক পরিত্যক্ত হাসপাতাল থেকে কিছু পুরানো যন্ত্রপাতি চুরি করার মতলব করছিল৷ অন্যান্য অনেক জিনিসপত্রের সঙ্গে চোরাই মালের মধ্যে তারা হাতে পেল তেজস্ক্রিয় পদার্থ ‘সেজিয়াম ১৩৭', যা চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা হয়৷ উজ্জ্বল ঐ পদার্থ দেখে মুগ্ধ হয়ে চোরাবাজারের দোকানের মালিক তা সবাইকেই দেখানোর সিদ্ধান্ত নেন৷ এই পদার্থের সংস্পর্শে এসে ৪ জনের মৃত্যু হয়, ২৪৯ জনের শরীরে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ধরা পড়ে এবং প্রায় ১১২,০০০ মানুষের শরীরে পরীক্ষা চালানো হয়৷ ঐ ঘটনার পর ২৩ বছর কেটে গেলেও গোটা এলাকায় তেজস্ক্রিয়তা পুরোপুরি দূর হয় নি৷ মাত্র একটি যন্ত্রের মধ্যে রাখা তেজস্ক্রিয় পদার্থ কতটা মারাত্মক হতে পারে, ঐ ঘটনা তা স্পষ্ট করে দিয়েছিল৷ সেদিনের ঘটনা ইচ্ছাকৃত ছিল না৷ কিন্তু সন্ত্রাসবাদিদের হাতে যথেষ্ট মাত্রার তেজস্ক্রিয় পদার্থ এলে তারা জনবহুল এলাকায় সেই পদার্থ ছড়িয়ে দিয়ে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে৷ এমনকি সাধারণ বোমার মধ্যে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ভরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা বিস্তীর্ণ এলাকায় এই ক্ষতির মাত্রা ছড়িয়ে দিতে পারে৷ প্রশ্ন হল, আমরা এমন হামলার জন্য কতটা প্রস্তুত? সরকার বা প্রশাসন এমন অবস্থার জন্য কোন পাল্টা পদক্ষেপের পরিকল্পনা করে রেখেছে কি?
বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা
আন্তর্জাতিক স্তরে এই বিপদ সম্পর্কে সচেতনতার ক্ষেত্রে বেশ কিছু ঘাটতি রয়েছে৷ যেমন মার্কিন প্রশাসন মূলত এমন আণবিক পদার্থের প্রসার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছে, যা দিয়ে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা যায়৷ প্লুটোনিয়াম বা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম নিয়েই তাদের মাথাব্যথা৷ সন্ত্রাসবাদীদের হাতে এমন পরমাণু অস্ত্র চলে এলে কোনো বড় শহরে কী হতে পারে, তার ভয়াবহ এক চিত্র বার বার তুলে ধরা হচ্ছে৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপদের আশঙ্কার এই চিত্র অত্যন্ত সীমিত৷ বাস্তবের ‘ডার্টি বম্ব'এর চরিত্র অনেক রকম হতে পারে৷ সন্ত্রাসবাদীদের হাতে চোরাই পরমাণু অস্ত্র চলে আসা বা তা প্রয়োগ করার মত ক্ষমতা পাওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে অনেক কম৷ তাছাড়া গোটা বিশ্বে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়ামের ভাণ্ডারের উপর আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার কড়া নজর রয়েছে৷ ফলে এই পদার্থের নাগাল পাওয়া কঠিন৷ কিন্তু এছাড়া আরও অনেক তেজস্ক্রিয় পদার্থ রয়েছে, যা যথেষ্ট বিপদের কারণ হতে পারে৷ ব্রাজিলের হাসপাতালে রাখা ‘সেজিয়াম ১৩৭' ছাড়াও ‘কোবল্ট ৬০' বা ‘ইরিডিয়াম ১৯২'র মত পদার্থ বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়৷ শিল্পোন্নত বিশ্বে এই সব পদার্থ ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হয়৷ এর অপব্যবহার প্রতিরোধ করার জন্য তেমন কড়া নজরদারিরও ব্যবস্থা নেই৷ এতকাল তেমন কোন অঘটন ঘটে নি বলে এবিষয়ে দুশ্চিন্তার মাত্রাও কম৷ এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বিশ্বের সব তেজস্ক্রিয় পদার্থের উপর কড়া নজরদারি ব্যবস্থা চালু করার পক্ষে সওয়াল করে চলেছেন৷ এতকাল যে কোনো দুষ্কৃতি সহজলভ্য এই সব তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করে কোন বিস্ফোরণ কেন ঘটায় নি, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যথেষ্ট বিস্মিত৷ এমন বিস্ফোরণ ঘটলে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি বা প্রাণহানির মাত্রা তেমন মারাত্মক হবে না৷ তবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়লে তখন হামলার সঠিক মাত্রা বোঝা যাবে৷ তখন আর বিশেষ কিছু করণীয় থাকবে না৷ সন্ত্রাসবাদীরা শুধু এই পদার্থ যতটা সম্ভব বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে৷ তবে আশার কথা, এই কাজটাই তাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন, সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল ফারূক