1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

টার্গেটে তীর নাকি তীর মেরে টার্গেট নির্বাচন?

সুশান্ত সিনহা
১৯ মার্চ ২০২১

ভিজ্যুয়াল মিডিয়া হলো শব্দ ছবির খেলা৷ যেখানে ২/৩ সেকেন্ডের হেরফেরে অনেক কিছুর পার্থক্য গড়ে দেয়!

https://p.dw.com/p/3qqkQ
ছবি: picture-alliance/dpa

কখনও সংবাদকর্মীর সামান্য উদাসীনতা-অবহেলায় নিজের ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির শংকা থাকে৷ অতি-উৎসুক হয়ে গিয়ে বক্তব্য দেয়া-নেয়ায় সংশ্লিষ্ট বক্তাও পড়তে পারেন বিপত্তিতে৷

আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন শেষ৷ অনেক সংবাদকর্মীই হল রুম ছেড়ে গেছেন৷ আমি ও অন্য একটি টেলিভিশনের প্রতিবেদক, নিজেদের বিশেষ প্রতিবেদনের জন্য সময় চেয়েছিলাম প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের কাছে৷ সংবাদ সম্মেলন শেষে তিনি সময় দেয়ায় আমরা তার কক্ষে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছিলাম যৌথভাবে৷ আমাদের নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার শেষে হন্তদন্ত হয়ে মহাপরিচালকের কক্ষে এলেন অন্য একটি টেলিভিশনের সংবাদকর্মী  ও ক্যামেরাপার্সন৷ এসেই তিনি বললেন, স্যার আমিও একটু আপনার বক্তব্য নিতে চাই৷ উত্তরে মহাপরিচালক বললেন, আমি তো ওনাদের বলে ফেলেছি৷ প্রতি-উত্তরে সেই প্রতিবেদক বললেন, না স্যার, আমি সংবাদ সম্মেলনটা মিস করেছি তাই আপনার আজকের বক্তব্যটা নিতে এসেছি৷ বক্তব্য পেতে নাছোড়বান্দা মনোভাব প্রতিবেদকের৷ তাই নিমরাজী হওয়ার পরও বক্তব্য দেয়া শুরু করলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার৷

অতি সম্প্রতি ঘটা এ ঘটনা৷ এমন নয় যে, এধরনের ঘটনা এই প্রথম দেখছি৷ গেল ১২ বছরের টেলিভিশন সাংবাদিকতায় বেশ কয়েকবার এমন ঘটনা দেখেছি৷ দাতা ও গ্রহীতার উভয়েরই আগ্রহ ছিল এধরনের বক্তব্য দেয়া-নেয়ার৷ দিন শেষে চ্যানেলে যখন ‘বক্তব্য দেয়া-নেয়ার’ সংবাদটি সম্প্রচার হয় তখন কেউ তা খেয়াল করে না৷ সংবাদ সম্মেলনের নাকি পড়ে আলাদাভাবে নেয়া হয়েছে তা জিজ্ঞাস করার প্রয়োজনও বোধ করেন না বার্তাকক্ষের দায়িত্বশীলরা৷ সংবাদ বুলেটিনে যাচ্ছে একটা কিছু এতেই সন্তুষ্ট তারা৷

আর এই বক্তব্য দেয়ার নেয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিদের চেয়ে তাদের সাগরেদদেরও আগ্রহ কম থাকে না৷ তারাও মূলত বসকে খুশি করাতে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে এনে বক্তব্য দেয়ার ব্যবস্থা করেন৷  উইন উইন সিচ্যুয়েশনের মতো মন্ত্রীও খুশি আবার সাংবাদিকও খুশি৷ দু'জনের দুই ধরনের উদ্দেশ্য মিলে যায় এক বিন্দুতে৷ যদিও এসব বিষয় দেখভাল করা বা নজরদারি করার বিন্দুমাত্র আয়োজন নেই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে৷

পরিস্থিতি অনেকটা সেই তীরন্দাজের প্রথম দিনেই শতভাগ সাফল্যের মতো৷ দেশ সেরা অভিজ্ঞ এক তীরন্দাজ প্রতিদিন সকালে মাঠে গিয়ে তীর নিক্ষেপের প্র্যাকটিস করে৷ তার তীর ছোঁড়ার লক্ষ্যভেদ রেট ৭৫ থেকে ৮০ এর মধ্যে, হঠাৎই একদিন মাঠে গিয়ে দেখেন নতুন এক তীরন্দাজ প্র্যাকটিস করছেন এবং যার লক্ষ্যভেদ হয়েছে শতভাগ!  প্রতিটি টার্গেট পয়েন্টে এমন লক্ষ্যভেদী তীর অবস্থা দেখে অভিজ্ঞ তীরন্দাজের চক্ষু চড়কগাছ৷

অভিজ্ঞ তীরন্দাজ বেশ বিস্ময়ের সাথে নতুন তীরন্দাজের কাছে জানতে চাইলেন, ভাই আমি এত বছরের চেষ্টায় ৭০/৮০ শতাংশের বেশি লক্ষ্যভেদ করতে পারিনি৷ অথচ আপনি দেখছি- শতভাগ টার্গেটে তীর মেরেছেন? কতদিনের চেষ্টায় এই সাফল্য আপনার?

উত্তরে নতুন তীরন্দাজ বলেন, কেন, আজই প্রথম তীর-ধনুক হাতে নিয়েছি৷ আর এটাতো খুবই সহজ শতভাগ টার্গেটে তীর মারা!

উত্তরে আগের চেয়ে বেশি হতবাক অভিজ্ঞ তীরন্দাজ৷ তার চোখে মুখে বিস্ময় দেখে নতুন তীরন্দাজ আবারও বলেন, কেন আপনি কীভাবে তীর মারেন ?

উত্তরে অভিজ্ঞ তীরন্দাজ বলেন, কেন আমি খেলার নিয়ম অনুযায়ী টার্গেটে তীর নিক্ষেপ করি ?

হে হে করে এক গাল হেসে নতুন তীরন্দাজ র্নিলিপ্তভাবে বলেন, এখানেই তো আপনি ভুল করেন৷ আপনি টার্গেটে তীর নিক্ষেপ করেন; আর আমি তীর মারার পর প্রতিটি তীরকে কেন্দ্র করে গোল দাগ দিয়েছি৷ ব্যাস, একটু পরে যারা আসবে তারাতো আর দেখতে পাবেন না, টার্গেটে তীর মেরেছে নাকি তীর মেরে টার্গেট করা হয়েছে৷ তারা দেখবে শতভাগ লক্ষ্যভেদী হয়েছে আমার তীর!

ঐ নতুন তীরন্দাজের মতোই আমাদের অবস্থা নিউজ রুমগুলোর৷ কোনটা আগে আর কোনটা পরে সেটা দেখার প্রয়োজন পড়ে না৷ ঘটনাস্থলে সংবাদটি কাভার করতে গিয়ে যথাযথ বক্তব্যটি পেয়েছেন কিনা এবং তা সম্প্রচার হচ্ছে কিনা তা যাচাই করা হয় না৷ ফলে কোনো কোনো প্রতিবেদক সময় মতো অনুষ্ঠানটি কাভার করেছে কিনা,  নিউজরুম তা জানতে পারে না৷ এমনকি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো বক্তা বা অতিথির বক্তব্য আলাদাভাবে নিয়ে সম্প্রচার করার বিষয়টি উহ্য থেকে যায়৷ প্রতিবেদকও ঘটনাটি চেপে যান যে তিনি আসলে মিস করেছেন অনুষ্ঠানটি, তাই জোড়াতালি দিয়ে একটা কিছু বানিয়ে দিয়ে দায় সেড়ে ফেলেন৷

বিষয়টা তুলনা করলে দেখা যায়, বক্তার বক্তব্য হুবুহু লাইন বাই লাইন একরকম দেখা যায় প্রিন্ট বা পত্রিকাগুলোতে৷ ট্রিটমেন্ট আলাদা হলেও মূল বক্তব্য, বক্তা ও অনুষ্ঠানসহ সবকিছুই মিল আছে জাতীয় দৈনিকগুলোর সংবাদে৷ কিন্তু টেলিভিশনগুলোর সংবাদে সেই ঐকতান থাকে না৷ এটা ঠিক, সবাই  যার যার হাউস পলিসি অনুযায়ী সংবাদ ঠিক করবে৷ কিন্তু সেখানে বক্তবের মূলসুরটা একই থাকবে৷ বেদনাদায়ক হলেও সত্যি আমাদের দেশে টেলিভিশনগুলোর মধ্যে সেই ঐকতান নেই সংবাদভাষ্যের৷ মাধ্যম আলাদা হতে পারে কিন্তু সংবাদ সংবাদই৷

সবশেষ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় প্রার্থীর এমন বক্তব্য নিয়ে বেশ বিপত্তিতে পড়েছিলাম৷ খিলগাঁও এলাকায় একট কেন্দ্রে এক বিদ্রোহী প্রার্থী বারবার ক্যামেরায় কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করছেন এবং যু্ক্তি হিসেবে তার নির্বাচনী এজেন্টসহ অন্যদের ওপর হামলার কথা বলছেন৷ যে কোনো মূল্যে তার এ বক্তব্য সে প্রচারের বেশ তৎপর৷ কয়েক দফায় সেই প্রার্থীর আগ্রহের কারণেই তার বক্তব্য নিয়েছিলাম খানিকটা বাধ্য হয়েই৷ কিন্তু খানিক পরে দেখি তিনি বা তার লোকের অস্তিত্ব নেই ঐ কেন্দ্রে৷ অনেকটা রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশে যেভাবে কিছু মানুষ শত-শত মানুষের মধ্যে নিজেদের হাজিরা দিয়ে একটু পড়ে কেটে পড়ে৷ ঠিক তেমনি নির্বাচনের সময় ঐ প্রার্থী তার বক্তব্য টেলিভিশনে দিয়ে বিদায় নিয়েছেন৷ ভাবটা এমন,আমরা যা বলার আমি বলে দিয়েছি!

সুশান্ত সিনহা, বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন
সুশান্ত সিনহা, বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশনছবি: private

মনে পড়ে বিএনপি-জামাত জোটের ২০১৩/১৪ সালে টানা অবরোধের সংবাদ সংগ্রহের একটি ঘটনা৷ আমিসহ প্রায় ৮/১০ টি টেলিভিশনের সাংবাদিক রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে শনির আখড়া পর্যন্ত কাভার করছি৷ বিএনপি-জামায়াতের তেমন মিছিল মিটিং চোখে না পড়লেও অবরোধের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ি এলাকায় প্রতিহতকরণ মিছিল করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা৷ শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল শেষে যাত্রাবাড়ী এলাকায় পথসভায় কর্মসূচি শেষ৷ কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর শুরু হয় মিডিয়া ম্যানেজ বা তদবির কর্মসূচি৷ মিছিলকারীদের এক স্থানীয় নেতা ঘুরে ঘুরে কথা বলছেন টেলিভিশন সংবাদিকদের আর নিশ্চিত করতে চাইছেন তাদের সংবাদটি যেন দেখা হয়  চ্যানেলগুলোতে৷ এজন্য সামান্য বিনিয়োগ হিসেবে চা-নাস্তা আর গাড়িভাড়ার হিসেবে খামের বন্দোবস্তও করেছেন৷ দু'একজন ছাড়া বেশিরভাগ সংবাদকর্মীই সেদিন প্রত্যাখান করেছিলেন সেই খাম৷ তবে গোটা দু'য়েক সাংবাদিকদের মনোভাব ছিল আরও ভাই ওনারো খুশি হয়ে দিচ্ছে; আমরা তো চাইনি৷ তাই নিলে সমস্যা নেই এবং তারা নিলেন৷ জানি না সেই বিনিয়োগের সংবাদটি সেই দুটি চ্যানেলে সম্প্রচার হয়েছে কি না৷ দিন যত যাচ্ছে ততই সাংবাদিকদের ম্যানেজ করে বক্তব্য দেয়ার প্রবণতা বাড়ছে৷

সাংবাদিক হিসেবে আমার দায়িত্ব সংবাদ তুলে ধরা৷ ফলে আন্তরিকভাবে সচেতন না থাকলে যে কোনো সময় খামপার্টির খপ্পড়ে পড়ার শংকা থাকে৷ আর এ শংকা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও নিরন্তর জারি রাখতে হবে যতদিন সাংবাদিকতায় আছেন৷ নিজের স্বার্থে, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে, সাংবাদিকতা পেশার স্বার্থে যা অত্যন্ত জরুরি৷ নাহলে আর পাঁচটা পেশার মতো সাংবাদিকতা হবে কিন্তু থাকবেনা এ পেশার নান্দনিকতা-পেশাদারিত্ব৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য