জোড়া কাণ্ডে ভোটের সময় অস্বস্তিতে জোড়াফুল
২০ এপ্রিল ২০১৯‘ভবিষ্যতের ভূত' ঘিরে অস্বস্তি
লোকসভা ভোটের প্রচার এখন তুঙ্গে৷ ১৮ এপ্রিল দ্বিতীয় দফার নির্বাচন হয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে৷ নানা বিষয়ে রাজনৈতিক তরজার মধ্যে দুটি বিতর্ক তৃণমূলের মাথাব্যথা বাড়িয়েছে৷ প্রথম বিষয়টি একটি চলচ্চিত্রের প্রদর্শন ঘিরে৷ অনীক দত্ত পরিচালিত ‘ভবিষ্যতের ভূত' ছবির প্রদর্শন কলকাতায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল৷ হল মালিকরা জানান, পুলিশের নির্দেশে ছবির প্রদর্শন বন্ধ করে দিতে হয়েছে৷ পরে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র ভবিষ্যতে্র ভূত প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে৷ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করতে হবে, যাতে দর্শক বা প্রেক্ষাগৃহের ক্ষতি না হয়৷ গত ১১ এপ্রিল আর এক নির্দেশে সর্বোচ্চ আদালত বলে, এ জন্য ছবির প্রযোজক ও হল মালিকদের ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাজ্য সরকারকে৷ পরিচালক অনীক দত্তের সঙ্গে একমত হয়ে আদালতও বলেছে, যে ছবিকে সেন্সর বোর্ড অনুমোদন দিয়েছে, তার প্রদর্শন বন্ধ করা বাক্ স্বাধীনতা হরণ ছাড়া কিছু নয়৷
শিল্প জগতের একটা বড় অংশও এই ভাবনার সঙ্গে সহমত৷ গায়ক, লেখক ও অভিনেতা পল্লব কীর্তনিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সব শাসকই চায় নিঃশর্ত আনুগত্য৷ তাদের বিরুদ্ধে শিল্প, সংস্কৃতি জগতে কিছু হলেই তা বন্ধ করে দেওয়াটাই রেওয়াজ৷ পশ্চিমবঙ্গের সুনাম ছিল, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এখানেও তাই হচ্ছে৷ আমি নিজে ভুক্তভোগী৷ আমার গান দিয়ে শাসকদলের বিরোধিতা করেছি, তাই বাম আমলেও যেমন আমার অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তৃণমূল আমলেও তা করা হয়েছে৷''
দায় এড়াচ্ছে তৃণমূল
তৃণমূলের তরফে কেউই এ কথা স্বীকার করতে চাননি যে, সরকারের প্রত্যক্ষ মদতেই পুলিশ বিভিন্ন হলে ছবিটির প্রদর্শনে বাধা দিয়েছে৷ তৃণমূল নেতা নির্বেদ রায় বলেন, ‘‘বন্ধ করার জন্য তৃণমূল সরকারের কোনো সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রচার হয়নি৷ যারা বন্ধ করেছে, তারা কি সরকারের নাম বলেছে?'' তাহলে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে ২০ লক্ষ টাকা জরিমানা করল কেন? নির্বেদ বলেন, ‘‘এর উত্তর সুপ্রিম কোর্টই ভালো বলতে পারবে৷ তবে রাজ্য সরকার বন্ধ করেছে, এটা সুপ্রিম কোর্ট হয়তো বলতে চায়নি৷ কোনো প্রমাণ নেই৷ রাজ্য সরকার হয়তো প্রোটেকশন দিতে পারেনি বলে এই জরিমানার ব্যবস্থা৷'' লোকসভা ভোটের বাজারে ‘ভবিষ্যতের ভূত' ছবির প্রদর্শন বন্ধ নিয়ে তৃণমূল ধাক্কা সামলে ওঠার জন্য সবরকম দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে৷ কিন্তু বিরোধীরা পিছু ছাড়ছে না৷
লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুরের বামপ্রার্থী আইনজীবি বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এ বিষয়ে বলেন, ‘‘মমতার সরকার সবসময়েই ধাক্কা খাচ্ছে৷ ‘ভবিষ্যতের ভূত' উনি বন্ধ করতে চেয়েছিলেন লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই৷ সুপ্রিম কোর্ট একদমই ঠিক রায় দিয়েছে৷ তবে আমাদের দাবি, এই জরিমানার টাকাটা রাজ্যের মানুষের পকেট থেকে নেওয়া হবে কেন? মুখ্যমন্ত্রী আর ওঁর চিফ সেক্রেটারির পকেট থেকে এই টাকা নেওয়া হোক৷'' পল্লব কীর্তনিয়ার মতে, ‘‘সরকার খুবই পরিকল্পিতভাবে এটা বন্ধ করেছে, যার জন্য কোনো প্রমাণ রাখেনি৷ কারা বন্ধ করেছে, সেটার কোনো হদিশই নেই৷ কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এটা মানেনি৷ পরিষ্কার বলেছে, সরকারের নির্দেশেই পুলিশ বন্ধ করেছে৷ তাই সরকারের কাছে এটা তো একটা ধাক্কা৷''
সোনা নিয়ে ঝামেলা
দ্বিতীয় বিতর্কে সরাসরি যুক্ত তৃণমূল নেতৃত্ব৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলের যুব সভাপতি৷ তিনি এবারও লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী৷ অভিষেকের স্ত্রী রুজিরা ১৬ মার্চ থাইল্যান্ড থেকে ফেরার সময় সোনাসহ কলকাতা বিমানবন্দরে শুল্ক বিভাগের আধিকারিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন৷ অভিযোগ, তিনি অনুমোদিত পরিমাণের থেকে বেশি সোনা সঙ্গে এনেছিলেন৷ সেই সময় রাজ্য পুলিশ রুজিরাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়৷ এ ব্যাপারে কাস্টমস ও রুজিরা উভয়ই পুলিশে অভিযোগ জানান৷ এই খবর প্রকাশ্যে আসে অভিষেকের সাংবাদিক বৈঠকের সূত্রে৷ নতুন বিতর্ক তৈরি হয় ভোটের মরসুমে৷ বিধানসভার বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী এ নিয়ে ট্যুইট করেন, তিনি আদালতের নজরদারিতে সিবিআই তদন্তের দাবি তোলেন৷ তাঁর অভিযোগ, রাজ্য পুলিশ ও কাস্টমস এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেও ব্যবস্থা নেয়নি৷ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বোঝাপড়ায় বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষই হাত গুটিয়ে রেখেছে৷ পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ও বিজেপি আঁতাত করেছে বলে বামেরা অভিযোগ তুলছে৷ সেই পরিপ্রেক্ষিতেই সোনা-কাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন সুজন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি বলেছিলাম, বালিপাচার, কয়লাপাচারের মতো এবার আন্তর্জাতিক সোনা পাচারে তৃণমূল সরকার নাম তুললো৷ আমার এই কথার পরিপ্রেক্ষিতেই মামলার হুমকি আসে৷''
বাস্তবিকই বাম নেতার ট্যুইটের পর তাঁকে মানহানির মামলার হুমকি দেওয়া হয়৷ সুজন এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একজন বিদেশে গিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে এফআইআর আর জিডি হবে কেন? সবাই বোঝে৷ আমার বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি ছিল, কিন্তু সে মামলা আজও হয়নি৷ কারণ, মামলা করতে গেলে আসল সত্য যদি বেরিয়ে আসে, সেই ভয়টা তো আছে৷''
সুপ্রিম কোর্টে গড়িয়েছে সোনা-কাণ্ডও৷ সেখানে তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-এর আইনজীবী বলেছেন, কলকাতার প্রাক্তন নগরপাল রাজীব কুমারের ঘটনার মতো সোনা সংক্রান্ত তদন্তেও বাধা দিচ্ছে রাজ্য সরকার৷ পশ্চিমবঙ্গে সাংবিধানিক সঙ্কটের পরিস্থিতি চলছে৷ এ বিষয়ে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাধারন মানুষ এয়ারপোর্টে কাস্টমসের মুখে পড়লে, নিশ্চয়ই রাজ্য পুলিশ ছুটে যাবেন না৷ এঁদের ক্ষেত্রে যখন সেটা হচ্ছে, তার মানে এতে দুর্নীতি আছে৷ প্রত্যেক মুহূর্তে সাংবিধানিক সংকট তৈরি করতে চাইছে এঁরা৷ কেন্দ্রে মোদী ধর্ম নিয়ে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি করছে৷ রাজ্যে মমতা একইরকম পরিস্থিতি তৈরি করছে৷ যৌথভাবে এঁরা এটা করছে, রাজীব কুমার থেকে শুরু করে এয়ারপোর্টে সোনা কাণ্ড সবটাই এর মধ্যে পড়ছে৷''
সরকারের ধাক্কা?
চলচ্চিত্রের মতো এই মামলাতেও আদালতে ধাক্কা খেয়েছে রাজ্য সরকার৷ বিষয়টিকে ‘খুব গুরুতর' আখ্যা দিয়ে গত শুক্রবার রাজ্যকে নোটিস পাঠিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ ভারতের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বেঞ্চ মন্তব্য করে, বিষয়টি খুব গুরুতর৷ তবে তৃণমূল নেতা নির্বেদ রায় মনে করেন, ‘‘এটা দলের কোনো বিষয়ই নয়৷ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী দলের কোনো সদস্য নয় যে, দল তাঁর কাজের জবাবদিহি করবে৷ অভিষেক যে প্রেস বৈঠক করেন, সেটা দলের বাইরে গিয়ে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত৷'' নির্বাচনি মরশুমে যে এই দুটো কাণ্ড ভোটের তাপমাত্রা বাড়িয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই৷ একদিকে নির্বেদ বলেন, ‘‘অন্য কিছু না পেয়ে এই দুটো কাণ্ডই সংবাদমাধ্যমগুলো প্রচার করছে৷ তাতে দলের কিছু এসে যায় না৷'' অন্যদিকে সুজন বলেন, ‘‘এই দুটো কাণ্ড শুধু নয়, তোলাবাজি, বিভাজন, লুটপাট সব কিছুতেই তৃণমূলের স্বরূপ মানুষ বুঝতে পেরেছে৷ তাই তৃণমূল মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে চায়৷ আপাতত ভোট ঠিকঠাক দিতে দিলেই সেটা বোঝা যাবে৷''