1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জোনিং যেন আরেক প্রহসন না হয়

৯ জুন ২০২০

মহামারি মোকাবিলায় চিকিৎসা খাতের নানা সংকটের পাশাপাশি সবচেয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে নিজস্ব নীতির সংকট৷ অন্য অনেক দেশের চেয়ে নানা ফ্যাকটর আলাদা হলেও নীতিগুলো নেয়া হচ্ছে উন্নত দেশগুলো থেকে অনেকটা কপি-পেস্ট এর মতো করে৷

https://p.dw.com/p/3dXU5
‘জোনিং ব্যবস্থাও যাতে সাধারণ ছুটি আর কোয়ারান্টিনের মতো তামাশায় পরিণত না হয়’
‘জোনিং ব্যবস্থাও যাতে সাধারণ ছুটি আর কোয়ারান্টিনের মতো তামাশায় পরিণত না হয়’ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan

এর ফলে স্বভাবতই কার্যকর না করতে পারায় তা পড়ছে মুখ থুবড়ে৷

একদিকে ভ্য়াকসিন ও ওষুধ নিয়ে গবেষণা চলছে বিশ্বজুড়ে, আবার কিভাবে সামাজিকভাবে সংক্রমণ কমানো যায় সে চেষ্টাও চলছে৷ এই সব বিষয় সমন্বয় করার চেষ্টা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ অন্যদিকে প্রতিটি দেশ নিজেদের বিভিন্ন ফ্যাকটর বিবেচনায় নানা ব্যবস্থা নিচ্ছে৷

প্রায় সব দেশই সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য শুরুতেই সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, বা কড়াকড়ি আরোপ করেছে৷ ধীরে ধীরে সংক্রমণের মাত্রা কমার পর শিথিল করা হচ্ছে বিধিনিষেধ৷ চীন বা ইটালি, সর্বোচ্চ আক্রান্ত দেশগুলোর গ্রহণ করা নীতির দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে সংক্রমণ ছড়ানোর শুরুতেই হটস্পট ঘোষণা করে তা ঠেকানোর প্রয়াস ছিল৷ চীন উহান ও অন্য় কয়েকটি শহরকে পুরো লকডাউন করে ক্ষেত্রে এতে সাফল্য পেয়েছে, ইটালি দেরি করায় তা পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে৷ ফলে একসময় পুরো দেশকেই নিতে হয় লকডাউনের আওতায়৷

আবার জার্মানির ক্ষেত্রে শতভাগ লকডাউন না দিলেও পুরো দেশে কন্টাক্ট ব্য়ান ঘোষণা দিয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়৷ সংক্রমণ কমার পর ধীরে ধীরে শিথিল করা হয় নিষেধাজ্ঞা৷ কিন্তু কোনো অঞ্চলে সংক্রমণ বাড়লেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে জোনভিত্তিক লকডাউনের৷

বাংলাদেশে শুরুতে উহান থেকে ফিরিয়ে আনা শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টিনে রাখা হলেও পরবর্তীতে সে কড়াকড়ি আরোপে ব্যর্থ হয় সরকার৷ এরপর যখন নারায়ণগঞ্জের মতো হটস্পট তৈরি হয়, তখন স্বয়ং মেয়র কারফিউ ঘোষণার অনুরোধ করলেও তা মানা হয়নি৷ নারায়ণগঞ্জের মতো হটস্পটগুলোতে সর্বোচ্চ কড়াকড়ি ও সেবা নিশ্চিত করা গেলে এত দ্রুত তা সারাদেশে নাও ছড়াতে পারতো৷

তা না করে বরং দেশজুড়ে ঘোষণা করা হয় সাধারণ ছুটি৷ স্কুল-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়৷ ফলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ রওয়ানা হয় গ্রামের বাড়িতে৷ সচেতনতা সবার মধ্যে সমান না হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ ফলে যাকে ছুটিকে বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে ‘ছুটি' হিসেবে নেওয়াটাই স্বাভাবিক৷ হয়েছেও তাই৷ ছুটি ঘোষণা করা হলেও পরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত আসে পরে৷ ফলে নারায়ণগঞ্জের পোশাক শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান পটুয়াখালীতে গিয়ে ৷

মাঠে কাজ করা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও জানতেন না তাদের প্রতি সুনির্দিষ্ট নির্দেশটা কী! ফলে কোথাও মানুষকে পুলিশ পিটিয়েছে, কোথাও দোকানে তালা দেয়া হয়েছে, কোথাও বৃদ্ধদের কানে ধরানো হয়েছে৷ একদিকে যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা, অন্যদিকে গার্মেন্টস খোলা-না খোলা নিয়ে অস্পষ্টতা৷ এই ‘সাধারণ ছুটি' আসলে কী, সেটা নিয়েই তৈরি হয় জটিলতা৷

অন্য সব দেশ লকডাউন দিয়েছে, সব বন্ধ করে দিয়েছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পেরেছে বলেই যে বাংলাদেশেও কি ‘সাধারণ ছুটির' নামে সেটিই করতে হতো? বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশে সেটা সম্ভব? এ নিয়ে রীতিমতো বিশেষজ্ঞদের গবেষণার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত থাকলেও তা হয়েছে বলে কোথাও শুনতে পাইনি৷

অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলে
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

এখনও একেক দেশ তার নিজের পরিস্থিতি বিবেচনায় শিথিলতার মাত্রা নির্ধারণ করছে৷ কোনো কোনো দেশে স্কুল খুলেছে বিশেষ ব্যবস্থায়, কোথাও বন্ধ রয়েছে৷ সুইডেনে শিশুরা স্কুলে খেলাধুলাও করেছে, আবার স্পেনে তাদের বাসার বাইরেই যেতে দেয়া হচ্ছে না৷ ফ্রান্সে লকডাউন উঠে গেলে সন্তানকে স্কুলে পাঠাবেন কিনা সে সিদ্ধান্ত অভিভাবকদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে৷ তবে কেউ স্কুলে না গেলেও তার কোনো শাস্তি হবে না৷ কোনো কোনো দেশে দুই মাস ধরে সেলুন পর্যন্ত বন্ধ, আবার কোথাও কেবল মাস্ক পরলে সবকিছুই করা যাচ্ছে৷

বেশিরভাগ দেশেই রাজনীতিবিদ, প্রশাসন এবং বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে৷ এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও খুব সতর্কতার সঙ্গে নিজেদের পরিস্থিতি বিবেচনায় সব দেশকে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে৷ বাংলাদেশে কি সেটিই হচ্ছে? শুরুতেই জোন ঘোষণা করে অর্থনীতি চাঙ্গা রেখে দেশব্যাপী চাপ কমানো যেত৷ সেক্ষেত্রে সফল না হলে পরবর্তীতে সারা দেশে অস্পষ্ট ছুটির বদলে সুস্পষ্ট লকডাউন কার্যকর করা যেত

এখনও যে রেড-ইয়েলো-গ্রিন জোন ঘোষণা করা হচ্ছে, সেটিও আসলে কতটুকু কার্যকর হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো গবেষণা দেখতে পেলাম না৷ আইইডিসিআর প্রতিদিনের মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যা জানানো ছাড়া নিজেরা কী গবেষণা করছে ওয়েবসাইটে গিয়েও সে তথ্য পেলাম না৷ বাংলাদেশ এই ভাইরাস কেমন আচরণ করছে তিন মাসেও সেটা আমরা জানি না৷

রেড জোনে ওষুধ-খাবার বাসায় পৌঁছে দেয়ার কথা বলা হলেও সেটা নিয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা মাঠ প্রশাসনের কাছে আছে বলেও শুনিনি৷ সেসব এলাকায় অর্থনৈতিকভাবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাদের কী হবে? খাবার ও অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ কিভাবে নিশ্চিত করা হবে? রেড জোনে কী চিকিৎসাসেবাও অন্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে­? নাকি সবাইকে চিকিৎসার জন্য ঢাকাতেই নিয়ে আসা হবে? প্রতি লাখে ৩০ জনের বেশি মানুষ আক্রান্ত কিনা সেটা বুঝতে সে পরিমাণ টেস্ট করা প্রয়োজন৷ সে সামর্থ্য কি অর্জন করা হয়েছে? টেস্ট করা নিয়েও জল ঘোলা তো কম হলো না৷

এসমস্ত প্রশ্নের উত্তর না মিললে জোনিং ব্যবস্থাও ‘সাধারণ ছুটি’ আর ‘কোয়ারান্টিনের’ মতো তামাশা ছাড়া আর কিছুই হবে না৷