‘জীবন বদলাতে' ভাসানচরে যেতে রাজি রোহিঙ্গারা
২৪ অক্টোবর ২০১৯স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছেন - এমন সাড়ে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবারের তালিকা হাতে পাওয়ার কথা ডয়চে ভেলের কাছে স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা৷ আগামী মাস থেকে তাদের সেখানে স্থানান্তর করা শুরু হতে পারে৷
টেকনাফের নয়াপাড়া ও লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের কর্মকর্তা আবদুল হান্নান এই বিষয়ে বলেন, ‘‘ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের বেশ সম্মতি পাওয়া যাচ্ছে৷ আমার শিবির থেকে অর্ধশতাধিক পরিবার আগ্রহ প্রকাশ করেছে৷ ভাসানচরে কী কী সুবিধা আছে তা তাদের জানাচ্ছি৷ এর আগে বৈঠক করে মাঝিদের আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছি৷ এখন মাঝিরাও সাধারণ রোহিঙ্গাদের বোঝাচ্ছে৷৷''
তিনি আরও বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যেতে সরকার আগে থেকেই কাজ করছিল৷ কেউ স্বেচ্ছায় রাজি না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে এগোনো যায়নি৷ যেহেতু এবার রোহিঙ্গারা নিজে থেকেই সেখানে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করছে, তাই গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি৷''
কয়েকজন রোহিঙ্গা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন যে সরকারের পক্ষে থেকে তাদের বোঝানো হচ্ছে তারা সেখানে এখানকার চেয়ে সুযোগ সুবিধা বেশি পাবে৷ আবার কেউ কেউ সেখানে নিরাপদ ভেবে চলে যাচ্ছেন৷
লেদা শরণার্থী শিবিরের মরিয়াম খাতুন ভাসানচরে যেতে নাম নিবন্ধন করেছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের জীবন-তো শেষ, এখন ছেলে মেয়েদের কথা ভাবতে হবে৷ অন্তত ওদের জীবনে যাতে কষ্ট না আসে, সেজন্য চলে যাচ্ছি৷ যে কষ্ট আমরা পেয়েছি, সেই কষ্ট যেন সন্তানদের জীবনে না আসে৷''
তিনি বলেন, ‘‘ক্যাম্পে দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ক্যাম্পের মাঝি বলেছেন, সেখানে তাদের ছেলে মেয়েরা শিক্ষা, বড় বড় ঘর ও কাজের সুযোগ পাবে৷ তাই আমি পরিবারের পাচঁ সদস্য নিয়ে সেখানে যেতে রাজি হয়েছি৷’’
আরেক রোহিঙ্গা মোহাম্মদ সৈয়দ আমিন বলেন, ''ভাসানচরে বড় বড় পুকুর রয়েছে সেখানে মাছ চাষ করতে পারবো৷ পাশাপাশি হালচাষ করার সুযোগ রয়েছে বলে শুনেছি৷ তাছাড়া এখানকার ঘরগুলো খুব ছোট৷ আটজন পরিবারের সদস্যদের গাদাগাদিভাবে থাকতে সমস্যা হচ্ছে৷ ভিডিওতে দেখেছি, ভাসানচরের ঘরগুলো অনেক বড় বড়, সেখানে গেলে ঘুমাতে আর সমস্যা হবে না৷ তাই আমরা স্বেচ্ছায় সেখানে চলে যাচ্ছি৷”
রোকেয়া বেগম নামে আরেক রোহিঙ্গা নারী বলেন, ‘‘মিয়ানমারে স্বামীকে হারিয়ে এখানে চলে এসেছি৷ ছেলে-মেয়ে বড় হচ্ছে, তাদের জন্য খুব চিন্তা করি৷ কেন না এখানে প্রায় সময় খুনখারাপি হয়৷ ক্যাম্পগুলো পাহাড়ের তীরে হওয়ায় ডাকাতরা ধরে নিয়ে মুক্তপণ চায়, না দিলে মেরে ফেলে৷ এমন কি ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে মারধর করে লুট করে নিয়ে যায় সহায় সম্বলটুকু৷ রাত আসলে মেয়েদের চিন্তায় ঘুম আসেনা৷ কেন না এই ক্যাম্পে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷ তাই ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাবার খবর শুনে মাঝিকে দেখে সর্বপ্রথম আমার নাম লিখতে বলেছি৷ অন্তত সেখানে সন্তানরা নিরাপদ থাকবে৷ চিন্তামুক্ত ভালোভাবে ঘুমাতে পারবে৷ তাছাড়া শুনেছি অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে৷ সে কারণে পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে সেখানে যেতে রাজি হচ্ছি৷”
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভাসানচরে নির্মিত ঘরবাড়ি নিয়ে তৈরি ভিডিও রোহিঙ্গাদের দেখানো হয়েছে৷ সেগুলো উখিয়া-টেকনাফের ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবিরের চেয়ে ভালো মনে করছেন তাদের কেউ কেউ৷ সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকবে বলে জানানো হচ্ছে, যা কক্সবাজারে নেই৷ তবে, অনেক রোহিঙ্গা সেখানে বসবাসের আগে চরটি শুধু ঘুরে দেখতে চান৷
এদিকে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের পরিবর্তে ভাসানচরকে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে দেখছে কিনা এবং তারা সেখানে গেলে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আরও বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহাবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘‘এরকম কোনও আশঙ্কা করছি না৷ রোহিঙ্গারা তো বোঝে বাংলাদেশে তাদের স্থায়ীভাবে থাকা সম্ভব না৷ মিয়ানমারও তাদের জন্য এখন নিরাপদ হয়ে উঠছে৷ কক্সবাজার এলাকার চাপ কমানোর জন্য এবং রোহিঙ্গারা যাতে একটু ভালোভাবে থাকতে পারে, সেজন্যই তাদের ভাসানচরে নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে৷ তবে এটা স্থায়ী কোনও ব্যবস্থা নয়৷ এর জন্য প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত হবে না৷''
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে প্রথম ভাসানচরে শরণার্থীদের বসবাসের জন্য আবাসন গড়ার পরিকল্পনা করা হয়৷ সেসময় চরটিতে কোনও জনবসতি ছিল না৷ কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের চাপ কমাতে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে উন্নত সুবিধাসহ নোয়াখালীর ভাসানচরে ৪৫০ একর জমির ওপর আশ্রয় শিবির নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার৷ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী৷
তবে, মেঘনা নদীর মোহনায় দুই দশক আগে জেগে ওঠা চরটি এখনো বসবাসের উপযুক্ত নয় বলেও মত দিয়েছেন একাধিক বিশেষজ্ঞ৷ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে গত পাঁচ দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন৷