জার্মানিতে মৃতদেহ সৎকার
জার্মানিতে মৃতদেহ সৎকারের বেশ কড়া নিয়মকানুন রয়েছে৷ বাধ্যতামূলক কফিন থেকে শুরু করে খাবার আয়োজনের ঐতিহ্য, মানতে হয় নানা নিয়মকানুন৷ কবর খননকারীদের নিতে হয় বিশেষ প্রশিক্ষণ, রয়েছে একটি জাদুঘরও৷
জীবন বেশিদিনের নয়
ফেডারেল পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে ২০১৮ সালে জার্মানিতে নয় লাখ ৫৪ হাজার ৯০০ মানুষ মারা গিয়েছেন৷ জার্মানির প্রায় সব অঞ্চলেই কবরস্থানে সৎকার বাধ্যতামূলক, কিন্তু সে প্রক্রিয়া দিনে দিনে পাল্টাচ্ছে৷ কোনো কোনো এলাকায় ১৫ থেকে ২০ বছরের জন্য মৃতদেহ কবর দেয়ার জমি বরাদ্দ দেয়া হয়৷ কিন্তু প্রথমবারের লিজ শেষ হয়ে গেলে অনেকেই তা আর নবায়ন করেন না৷
ঐতিহ্য পালনে অনীহা
সৎকার প্রক্রিয়ার খরচ দিন দিন বেড়ে চলেছে৷ ফলে প্লট কিনে পারবারিক কবরস্থান বানানোর প্রতি আগ্রহ কমছে৷ বরং শহরাঞ্চলে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন জার্মানরা৷ সেক্ষেত্রেও অবশ্য কফিন বা কোনো বন্ধ পাত্র দরকার হয়৷ চাইলেই মরদেহের ছাই নিজের বাগানে ছড়িয়ে দিতে পারবেন না৷ সাধারণত এই ছাইভর্তি পাত্র কোনো কবরস্থানে বা নির্দিষ্ট বনে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়৷
নানা ধরনের বিকল্প
ছাই ভরে রাখার জন্যও রয়েছে নানা ধরনের পাত্র৷ সিরামিক, ধাতু, কাঠ এবং মাটিতে মিশে যায় এমন উপাদান দিয়ে তৈরি হয় এসব পাত্র৷ বর্তমানে জার্মানির প্রায় অর্ধেক মৃতদেহই পুড়িয়ে, ছাইভর্তি পাত্রে রাখা হয়৷ শহরে এ হার আরো বেশি৷ জার্মানির সবচেয়ে ছোট প্রদেশ ব্রেমেন এক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে গিয়েছে৷ ২০১৫ সাল থেকে প্রিয়জনের মরদেহের ছাই নিজের বাড়ির পেছনের বাগানে ছড়িয়ে দেয়ার অনুমতি দিয়েছে রাজ্যটি৷
ফেরত চলো শেকড়ে
সৎকারের পর বনকে শেষ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিচ্ছেন অনেক জার্মান৷ এমন কিছু নির্দিষ্ট বনে গাছের শেকড়ের মধ্যে মাটিতে পুঁতে দেয়া হয় দেহাবশেষ৷ ৮০ সেন্টিমিটার নিচে ধীরে ধীরে মাটিতে মিশে যায় সবকিছু৷ এজন্য আলাদা করে কোনো যত্ন নিতে হয় না৷ কিন্তু এসব বনে কোনো ফুল বা মোমবাতি জানিয়ে প্রিয়জনকে স্মরণ করতে দেয়া হয় না৷
নিজের হাতে নিজের কফিন
জার্মানিতে এখনও এই আইডিয়া খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি৷ কিন্তু ছবিতে দেখানো লিডিয়া ব়্যোডার এবং আন্না আডাম এর মতো কিছু কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কফিন তৈরির কর্মশালার আয়োজন করে৷ ছবির কফিন তৈরিতে চার বর্গমিটারের গাছের গুঁড়ি এবং কয়েকশ ইউরো প্রয়োজন হয়েছে৷ বাজারে কফিন কিনতে গেলে তার দাম হতো এক হাজারের ওপর৷
শেষ দর্শন
বিভিন্ন দেশে প্রিয়জনদের শেষবার দেখার সুযোগ করে দিতে মরদেহ কফিনে রাখা হয়৷ কিন্তু জার্মানিতে এই আচার তেমন একটা পালন করা হয় না৷ সুগন্ধি আগরবাতি জ্বালানোর চর্চাও নেই জার্মানিতে৷
সহমর্মিতা, সহানুভূতি
ডয়চে পোস্ট কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃতের প্রতি সম্মান জানাতে বিশেষ ডাকটিকেট প্রকাশ করে, মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে নোটিশও পাঠায়৷ বিভিন্ন পত্রিকায় মৃত্যুসংবাদ ছাপানোর ব্যবস্থা রয়েছে৷ এছাড়া পরিচিত জনদের বাসায় শেষকৃত্যের সময় ও স্থান জানিয়ে চিঠিও পাঠানোর ব্যবস্থা রয়েছে৷ সহানুভূতি জানাতে আসা ব্যক্তিদের কাছে ফুল, নাকি ধর্মশালার জন্য অনুদান প্রত্যাশা করা হচ্ছে সেটিও অনেকক্ষেত্রে উল্লেখ করে দেয়া হয়৷
খাওয়ার ব্যবস্থা
সৎকারের পর যোগ দিতে আসা কাছের মানুষদের নিয়ে কাছেই কোনো রেস্টুরেন্টে খাওয়ার আয়োজন করা হয়৷ এর মূল লক্ষ্য মৃতের নানা স্মৃতি স্মরণ করা, তাকে শ্রদ্ধা জানানো৷ ‘লাইখেনশমাউস’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ- মৃতের উপলক্ষে খাবার৷ সাধারণত এক কাপ কফি, স্যুপ, স্যান্ডউইচ এবং ছোটখাট কেক এর আয়োজন থাকে এসব আয়োজনে৷
প্রশিক্ষণ
জার্মানিতে সব কিছুর জন্যই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে৷ একই কথা খাটে শেষকৃত্যের আয়োজনেও৷ ২০০৫ সালে বাভারিয়া রাজ্যের ম্যুনারস্টাড্ট শহরে ফেডারেল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করা হয়৷ শেষকৃত্যের আয়োজন ছাড়াও মৃতের স্বজনদের সান্ত্বনা দেয়া এবং মরদেহ প্রস্তুত করার নানা দিক তিন বছর ধরে প্রশিক্ষণার্থীদের হাতেকলমে শেখানো হয়৷ চীন ও রাশিয়া থেকেও প্রতিবছর প্রচুর শিক্ষার্থী আসেন এই কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিতে৷
বাস্তব প্রয়োগ
বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করে কিভাবে কবর খুঁড়তে হয়, তা শেখানো হয় ভবিষ্যত কবর খননকারীদের৷ কেউই চান না মরদেহ নামানোর আগেই কবরের দেয়াল ভেঙে পড়ুক, বা সৎকারের পর ওপরের স্মৃতিস্তম্ভ কাত হয়ে পড়ুক৷
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জাদুঘর
কাসেল শহরে সকার সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ও সংস্কৃতির প্রদর্শনী নিয়ে একটি জাদুঘর রয়েছে৷ কফিন থেকে শুরু করে মরদের বহনকারী যান, চিত্রকর্ম এবং নানা ধরনের স্মৃতিস্তম্ভের ডিজাইন শোভা পাচ্ছে এ জাদুঘরে৷ ১৯৯২ সালে চালু হওয়া এ জাদুঘরে ১৮০০ সালের একটি শববাহী যান এবং ১৯৭৮ সালের একটি কফিনও রয়েছে৷