জাদুঘরে বাংলাদেশের টাকা-পয়সার ইতিহাস
বাংলাদেশের টাকা-পয়সার ইতিহাস জানতে হলে ঢাকার এই টাকা জাদুঘরে ঢুঁ মারতেই হবে৷ আবহমানকাল থেকে মুদ্রার ক্রমবিকাশের ধারাকে সংরক্ষণ করা হয়েছে এখানে৷ ছবিঘরে দেখে নিন বিস্তারিত..
টাকার গাছ!
জাদুঘরটির মূল দরজা দিয়ে ঢুকে একটু উপরে তাকালে চোখে পড়ে ভবনের দেয়ালে সাজানো টাকার গাছ! প্রাচীন বাংলা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রচলিত মুদ্রা ও টাকার রেপ্লিকা দিয়ে স্টিলের কাঠামোতে গাছের মতো রূপ দেওয়া হয়েছে শিল্পকর্মটিকে৷ প্রবেশপথের ডানপাশের দেয়ালে টেরাকোটায় (পোড়ামাটির ফলকচিত্র) ফুটে উঠেছে প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত লেনদেনের ধারাবাহিক বিবর্তনের চিত্র৷
টাকা-পয়সার শো-কেস
টাকা জাদুঘর হলো মুদ্রা সম্পর্কিত একটি বিশেষ জাদুঘর৷ ২০১৩ সালের ২৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক শিলান্যাসের মাধ্যমে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়৷ সেই বছরের ৫ অক্টোবর সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী এটি উদ্বোধন করেন৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ২০০৯ সালে স্থাপিত কারেন্সি মিউজিয়ামের সম্প্রসারিত এবং আধুনিক রূপ বলা যায় এটিকে৷
বাংলাদেশের প্রথম কাগজের নোট
১৯৭২ সালের ৪ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কাগজের নোট চালু হয়৷ ১ টাকার নোটটি ছাপা হয়েছিল ইন্ডিয়ান সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে৷ দ্বিতীয় সিরিজে ১ টাকার নোট ইস্যু করা হয় ১৯৭৩ সালের ২ মার্চ৷ ১৯৭২ সালের ২ জুন ১০ টাকার নোট এবং ১ সেপ্টেম্বর ইস্যু করা হয় ১০০ টাকার নোট৷ একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ৫ টাকা চালু হয়েছিল৷ ১০ টাকার নোটের মধ্য দিয়ে বাংলা সিরিয়ালযুক্ত নোট প্রথম চালু হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি৷
বিশ্বের সুন্দরতম নোট
এক পিঠে গাছের ডালে থাকা জাতীয় পাখি দোয়েল, অন্য পিঠে ভাষা আন্দোলনের স্মারক শহিদ মিনার–বাংলাদেশের ২ টাকার নোটের কথা বললেই ভেসে ওঠে এই ছবি৷ ১৯৮৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর এটি প্রথম মুদ্রিত হয়৷ রাশিয়ার অনলাইন এন্টারটেইনমেন্ট আউটলেট পরিচালিত একটি সমীক্ষায় বিশ্বের সুন্দরতম নোটের স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশের ২ টাকার নোট৷
বাংলাদেশের টাকা-পয়সার জন্ম
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে ৫, ১০, ২৫ এবং ৫০ পয়সা মূল্যের ধাতব মুদ্রা চালু হয়েছিল৷ ১৯৭৪ সালে ১ পয়সা এবং ১৯৭৫ সালে ১ টাকা মূল্যের ধাতব মুদ্রা চালু হয়৷ ১৯৯৪ সালে ৫ টাকা এবং ২০০৪ সালে আসে ২ টাকা মূল্যের ধাতব মুদ্রা৷ ১৯৭৬ সালের ১ মার্চ ৫০ টাকার নোট এবং ১৫ ডিসেম্বর ৫০০ টাকার নোট চালু হয়৷ ২০ টাকার নোট বাজারে এসেছিল ১৯৭৯ সালের ২০ আগস্ট৷ ২০২০ সালে মুজিব-বর্ষ উপলক্ষে চালু হয় ২০০ টাকার বিনিময়যোগ্য নোট৷
বাংলাদেশের টাকা ছাপানোর প্রেস
গাজীপুর সদরের শিমুলতলিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস কর্পোরেশনে ১৯৮৮ সালে ১ টাকা মূল্যমানের কারেন্সি নোট এবং ১০ টাকা মূল্যমানের ব্যাংক নোট উৎপাদন শুরুর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম কাগজের টাকা উৎপাদন হয়৷ ১৯৮৯ সালে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর কালক্রমে অন্যান্য মেশিনপত্র স্থাপন এবং সফলভাবে অন্যান্য মূল্যমানের নোট ছাপা শুরু হয় দেশের টাঁকশালে৷
অর্থসচিব এবং গভর্নরের স্বাক্ষর
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মুদ্রা হিসেবে ‘টাকা’ প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এক টাকা ও দুই টাকার নোট এবং ধাতব মুদ্রা বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে চালু হয়৷ এজন্য এগুলোতে অর্থসচিবের স্বাক্ষর থাকে৷ পাঁচ, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচলন করে বলে এগুলোতে গভর্নরের স্বাক্ষর দেখা যায়৷
টাকার নকশা
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন মূল্যমানের নোট, যেমন—এক টাকা, পাঁচ টাকা ও ১০ টাকার দুটি করে এবং ১০০ টাকার একটি নোটের নকশা করেছেন শিল্পী কে. জি. মুস্তাফা৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মজয়ন্তী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার ৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মুদ্রিত তিনটি রুপোর স্মারক মুদ্রা এবং বাংলাদেশের বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মুদ্রিত একটি স্মারক নোটের নকশাও তার৷
স্মারক মুদ্রা ও নোটের সম্ভার
টাকা জাদুঘরে বেশকিছু স্মারক নোট রয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর, বাংলাদেশের বিজয়ের ৪০ বছর, জাতীয় জাদুঘরের ১০০ বছর পূর্তি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসের ২৫ বছর পূর্তি৷ বিভিন্ন মূল্যমানের এসব স্মারক নোটের অনুমোদিত নকশাও আছে৷ এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন মাইলফলক ও দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত স্বর্ণ, নিকেল ও রৌপ্য মুদ্রা প্রদর্শিত হয় এখানে৷
টাকা-পয়সা বহনের বাক্স-সিন্দুক
টাঁকশাল থেকে মুদ্রা বাঁধাই ও বহন করে আনার বাক্স রাখা আছে শো-কেসে৷ একসময়ের মহাজনদের মুদ্রা ও টাকা রাখার নানান রঙের সুদৃশ্য থলেও রয়েছে৷ এছাড়া আছে টাকা-পয়সা সংরক্ষণের বিশেষ উপকরণ, বাটি, পিতলের ছোট কলস, মুদ্রা জমা রাখার লোহার সিন্দুক এবং এসব কাজে ব্যবহৃত হাতুড়ি, সুতা ও অন্যান্য সরঞ্জাম৷
মুদ্রা তৈরির ডাইস
জাপান, জার্মানি ও ক্রেমনিকা (স্লোভাকিয়া) টাঁকশালের দেওয়া মুদ্রা তৈরির ডাইস টাকা জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজন উপলক্ষে জারিকৃত ১০ টাকা মূল্যমানের স্মারক রৌপ্য মুদ্রা তৈরির জার্মান টাঁকশালের মাস্টার ডাইস দেখা যায় এই জাদুঘরে৷ আরো কয়েকটি মুদ্রার ডাইস রয়েছে ঢাকার টাকা জাদুঘরে৷
লেনদেনের একাল-সেকাল
এক নম্বর গ্যালারি দিয়ে ঢুকে সোজা হেঁটে শেষ পর্যন্ত গেলে দেখা যায় তিনটি ডিওরামা৷ শিল্পীর নিপুণ হাতে এগুলোতে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে বাংলার হাজার বছরের লেনদেন প্রথা৷ একসময় মানুষ ধানের বিনিময়ে গরু এবং চালের বিনিময়ে মুরগি নিতো৷ আরেকটিতে দেখা যায় নদীর পাশে হাটে বেচাকেনা হচ্ছে সোনালি পাট৷ অন্যটিতে ফুটে উঠেছে পুরোনো দিনে মানুষের মুদ্রা রাখার ছবি৷
ডিজিটাল প্রযুক্তি সংযোজন
টাকা জাদুঘরের শো-কেসে প্রদর্শনের জন্য রাখা মুদ্রার ভিডিওচিত্র ও তথ্য জানানো হয় ডিজিটাল সাইনেজে৷ ডিজিটাল কিয়স্কের মাধ্যমে দর্শনার্থীরা আঙুলের স্পর্শে মুহূর্তে পেয়ে যাবেন যে-কোনো নোট বা মুদ্রার তথ্য৷ থ্রিডি পর্দায় দেখা যায় মুদ্রার ত্রিমাত্রিক রূপ৷ এলইডি টিভিতে দেখানো হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড৷ অডিও গাইড প্রযুক্তির মাধ্যমে দর্শনার্থীরা শুনতে পারেন, জানতে পারেন বিভিন্ন মুদ্রার ইতিহাস৷
টাকায় দর্শনার্থীদের ছবি
টাকা জাদুঘরের দুই নম্বর গ্যালারিতে রয়েছে ফটো কিয়স্কের (ছোট ঘর) প্রতিলিপি৷ আরেকটি গ্যালারিতে মূল ফটো কিয়স্কে দর্শনার্থীরা ৫০ টাকার বিনিময়ে নিজেদের আবক্ষ ছবি সম্বলিত স্যুভেনির নোট ছাপিয়ে নিতে পারেন৷ নীচতলায় জাদুঘরের স্যুভেনির শপ থেকে বিভিন্ন সময়ে মুদ্রিত স্মারক মুদ্রা ও নোট, বিভিন্ন ধরনের স্যুভেনির দ্রব্য এবং টাকা জাদুঘরের বিভিন্ন প্রকাশনা কেনার সুযোগও রয়েছে৷
ঘুরে আসুন টাকা জাদুঘর
ঢাকার মিরপুর-২ নম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিংঅ্যাকাডেমি ভবনে অবস্থিত টাকা জাদুঘর৷ শনি থেকে বুধবার সকাল ১১টা থেকে বিকাল পাঁচটা, শুক্রবার বিকাল চারটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে টাকা জাদুঘর৷ বৃহস্পতিবার এবং সরকারি ছুটিতে জাদুঘরটি বন্ধ থাকে৷ সর্বসাধারণের জন্য এটি উন্মুক্ত, তাই কোনো প্রবেশমূল্য নেই৷ শুধু প্রবেশের সময় দর্শনার্থীদের নাম ও মোবাইল নম্বর লিখে রাখা হয়৷
লেখা জনি হক, ছবি রাজিব পাল