1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জাতীয়তাবাদের বিপরীতে জাতীয় মুক্তির প্রশ্ন

আনু মুহাম্মদ
২৩ জুলাই ২০১৮

বাংলাদেশে দু'ধরনের জাতীয়তাবাদের কথা শোনা যায়৷ ১. বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ২. বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ৷ মনে হতে পারে, প্রথমটি বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি জাতির স্বার্থ নিশ্চিত করার মতবাদ ও দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের স্বার্থ৷ আসলে কি তাই?

https://p.dw.com/p/31rTL
BG 60 Jahre Peace-Zeichen
ছবি: Imago/IPON

‘জাতীয়তাবাদ' শব্দটির বহুমাত্রিক অর্থ আছে৷ স্থান, কাল এবং পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী এর তাৎপর্য্যেরও পরিবর্তন হয়৷ একই ধারণা একসময়ে নিপীড়িতের আশ্রয় হতে পারে, আধিপত্যবিরোধী রাজনীতির বাহন হতে পারে৷ আবার এই একই আওয়াজ অন্য সময়ে অন্য জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নের বাহন হতে পারে৷ এই দুই অভিজ্ঞতাই গত কয়েক শতকে অনেক পাওয়া যাবে৷ পাওয়া যাবে বাংলাদেশেও৷

রাজনৈতিক নীতি দর্শনে এই ধারণা ও চর্চার জন্ম ইউরোপে৷ জাতি ও জাতি রাষ্ট্রের পাশাপাশি ‘জাতীয় চেতনা'ও ইউরোপে পুঁজিবাদের অভ্যুদয়ের সময়ই স্পষ্ট হতে থাকে৷ পুঁজিবাদের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে সমাজ অর্থনীতি গঠন, নতুন শ্রেণীর উদ্ভব এবং সমাজ চেতনার মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো আসে, তার মধ্য দিয়ে জাতি, জাতি চেতনা এবং জাতীয় রাষ্ট্রের চেহারা স্বচ্ছ হতে থাকে৷ জাতীয় সীমানা, রাষ্ট্র, বাজার, সরকার ইত্যাদির উদ্ভব যে সবদেশে একইভাবে হয়েছে, তা নয়৷ কোথাও ভাষা, কোথাও ধর্ম, কোথাও রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে৷

ইউরোপে অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকেই পুরনো সাম্রাজ্যগুলোর ভাঙন স্পষ্ট হতে থাকে৷ দূর বাণিজ্য, উপনিবেশ বিস্তার, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যে বণিক শ্রেণীর উদ্ভব ও বিস্তার ঘটে তারাই পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া শ্রেণী হিসেবে ক্রমে সামন্তবাদের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে সংগঠিত হয়৷ ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের পর সামন্ত রাজত্বের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক লড়াই বিস্তৃত হয়৷

পুঁজিবাদের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ বুর্জোয়া শ্রেণীকে নিজ ভূখন্ডের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে তাড়া করে নিয়ে যায়৷ এর মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে অসম বিকাশ ছাড়াও দুর্বল রাষ্ট্র বা জনগোষ্ঠীর ওপর বৃহৎ সংগঠিত বুর্জোয়া শ্রেণীর দমন দখল আধিপত্য পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বৈশিষ্ট হয়ে ওঠে, পুঁজিবাদ প্রবেশ করে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের পর্বে৷ সেখানে নিপীড়ক জাতীয়তাবাদ, আর এর বিরুদ্ধে নিপীড়িতের জাতীয়তাবাদের মুখোমুখি অবস্থান দেখা যায়৷

সাধারণভাবে একটি জাতি-রাষ্ট্র গঠনে একটি স্থিতিশীল জনগোষ্ঠী প্রয়োজন হয়, যারা অভিন্ন ভাষা, ভূখন্ড, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে ঐক্যবদ্ধ থাকে৷ তবে এর ভিন্নতাও আছে৷ একাধিক ভাষাভাষীর মানুষ নিয়ে রাষ্ট্র আমরা অনেকই দেখি, যেমন ভারত৷ ঔপনিবেশিক শাসন কখনো কখনো একটি জাতীয় পরিচয় দেয়৷

বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত বরাবরই ‘ভারতীয় জাতি' পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদ' পরিচয় দিয়ে অন্যসব পরিচয় আড়াল করতে চায়৷ কিন্তু তাতে এর ভেতরের বহু জাতির কন্ঠ চাপা পড়ে না৷ হিন্দি চলচ্চিত্র, গান আর হিন্দুত্ববাদ দিয়ে যখন ভারতীয় পরিচয় দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়, তখন অহিন্দি দক্ষিণ তা প্রত্যাখ্যান করে, মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মের বিক্ষোভ নানাভাবে প্রকাশিত হয়, উচ্চবর্ণের আধিপত্যের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের কন্ঠস্বর প্রতিবাদ করে ওঠে৷

বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে ‘জাতীয়' ঐক্য অপরিহার্য, কিন্তু পুঁজিবাদ যে বৈষম্য ও নিপীড়নের ওপর ভিত্তি করে বিকশিত হয় তার কারণে স্বতস্ফূর্ত ঐক্য সম্ভব হয় না৷ তখনই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের জন্য বলপ্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে৷ ভারতের ক্রমবর্ধমান সামরিকীকরণ এবং আভ্যন্তরীণ যুদ্ধের বিস্তার এরই ফলাফল৷ ভারতের মতো বহু দেশে পুঁজির স্বার্থে রাষ্ট্রই হয়ে দাঁড়াচ্ছে নিজ নাগরিকদের বিরুদ্ধে বড় সন্ত্রাসী৷ এসব ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ হলো নিপীড়ন, বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদের আরেক নাম৷

বিশ্ব পুঁজিবাদী কাঠামোতে, জাতিসংঘসহ বহু ধরনের তৎপরতা সত্ত্বেও, বিভিন্ন প্রান্তে যে জাতি সমস্যা টিকে থাকছে, তা এর অন্তর্গত বৈষম্য ও নিপীড়ন ভিত্তির কারণে৷ প্যালেস্টাইন আর কাশ্মীর সমস্যা সংঘাত গণহত্যার কথা আমরা শুনছি ছোটবেলা থেকেই৷ তার সমাধানের নানা লেফট রাইটের পর যথারীতি সমস্যা যেখানে ছিল সেখানেই আছে৷ শুধু প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, রোহিঙ্গাসহ বিশ্বের আরও বহু রক্তাক্ত অধ্যায় নয়, ইউরোপে, উত্তর আমেরিকায় বর্ণবাদ, শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থি তৎপরতাও তৈরি করছে নতুন নতুন রক্তাক্ত অধ্যায়৷ দেশে দেশে খ্রীষ্টান, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ সব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই বাড়ছে ধর্মোন্মাদনা, চরমপন্থি অন্য ধর্মবিদ্বেষী সন্ত্রাসী তৎপরতা৷

২০০১ সাল থেকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ' মডেলে বিশ্বজুড়ে হামলা জোরদার করবার অজুহাত আরও বেড়েছে৷ একে একে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে৷ বিশ্বের বৃহত্তম সন্ত্রাসী শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যখন সন্ত্রাস দমনের অভিযানের কথা বলা হয়, তখন নিশ্চিত হয় যে, শান্তি মানে যুদ্ধ, সন্ত্রাস দমন মানে সন্ত্রাস বিস্তার৷ ইউরোপে শরণার্থীপ্রবাহ এসবেরই পরিণতি৷

বর্তমান বিশ্ব তাই জাতিগত, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক সংঘাত, ঘৃণা ও বিদ্বেষে জর্জরিত৷ জগত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না দেখলেও এসব ঘিরে যুদ্ধ, সন্ত্রাস আর চরমপন্থার বিস্তার দেখছে৷ অসহিষ্ণুতা, সহিংসতায় প্রতিদিন মরছে মানুষ৷ হঠাৎ করেই যেন মানুষ অনেক ক্ষুদ্র হয়ে গেছে৷ হয়ে গেছে নিরাশ্রয়৷ তাই বৃহৎ কোনো স্বপ্ন দেখার বদলে সে এখন নিজেকেই খোঁজে, মানুষে মানুষে সংহতির সম্ভাবনা দেখা ভুলে গিয়ে জাতি, ধর্ম বা অঞ্চলের পরিচয়ে নিজেকে সাজায় আর বাকি সবার বিরুদ্ধে৷ এখন যেন সবাই সবার শত্রু৷

জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করে নিজেরাই সংখ্যালঘু জাতির ওপর নব্য নিপীড়ক হিসেবে হাজির হবার ঘটনাও আছে৷ এর সাক্ষাৎ দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ৷ গত কয়েক দশকে বাঙালি ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আওয়াজে ক্ষমতায় বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রান্তিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি, বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিসমূহের অবস্থান আরও প্রান্তিক হয়েছে৷ জাতিগত, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, হামলাও বিভিন্নভাবে বেড়েছে৷

Deutschland Anu Muhammad
আনু মুহাম্মদ, কলামিস্টছবি: DW/Muhammad Mostafigur Rahman

গত ৪৭ বছরে, ‘বাঙালি' ও ‘বাংলাদেশি' শাসনকালে, বাংলাদেশে উন্নয়ন কর্মসূচি কম হয়নি, উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যাও অগণিত৷ উন্নয়নের নাম করে করে স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষত গত তিন দশকে, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, চিকিৎসা, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ বন্দর, রেলওয়ে, পাট, নদী, পানি ইত্যাদি অর্থাৎ বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রায় সর্বক্ষেত্রে বহু নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হয়েছে৷ এসব ক্ষেত্রে সরকার ভেদে, জাতীয়তাবাদ ভেদে, তেমন কোনো পার্থক্য হয়নি৷ কারণ, এসব নীতি প্রণয়নে যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে তারা ছিল অভিন্ন৷ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্থা হলো বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি৷ সুবিধাভোগীদের মধ্যে বহুজাতিক পুঁজি, দেশি বৃহৎ ব্যবসায়ী, আমলা, কনসালট্যান্ট এবং লুটেরা দখলদার গোষ্ঠী৷

এসবের মধ্যদিয়ে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আমরা পেয়েছি অনেক ভবন, যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার ঘটেছে অভূতপূর্ব হারে, জিডিপি বেড়েছে অনেক৷ সেইসাথে আরও পেয়েছি, (১) বিপুল চোরাই টাকার মালিক একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী; (২) একটি ক্ষুদ্র সচ্ছল মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী; (৩) অনিশ্চিত জীবন ও জীবিকায় ক্লান্ত নিম্নমধ্যবিত্ত গোষ্ঠী; (৪) প্রাক্তন শিল্পশ্রমিক ও বর্তমান কর্মসন্ধানীদের বিপুল সমাবেশ; (৫) মানব দারিদ্র্য সীমার নীচে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ; (৬) ভোগবাদিতা আর অমানবিকতার অশ্লীল সমাবেশ; (৭) শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ বিভিন্ন গণদ্রব্যের বাজারীকরণ; (৮) রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ও সাধারণ সম্পত্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তর; (৯) নদী-নালা, খাল-বিল, বন, পাহাড়ে দখলদারিত্বের বিস্তার; (১০) তেল, গ্যাসসহ জনগণের সম্পদ কতিপয় দেশি-বিদেশি কোম্পানির হাতে জিম্মি; (১১) বাণিজ্য বা মুনাফালোভী তৎপরতার দাপটে বিপর্যস্ত আবাদি জমি, জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান; এবং (১২) প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশধ্বংসী তৎপরতার বিস্তার৷

সুতরাং এই মডেলের বাইরেই আমাদের তাকাতে হবে৷ তাই বাংলাদেশের জন্য জাতীয় মুক্তির লড়াই বা এই দেশের মানুষের জন্য এইদেশকে বাসযোগ্য বিকশিত করার কর্মসূচি এখনও জরুরি৷ কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, শাসকদের জাতীয়তাবাদী প্রহসন থেকে জাতীয় মুক্তির লড়াই গুণগতভাবেই ভিন্ন৷ ‘জাতীয় বুর্জোয়া', ধনিক শ্রেণীর ‘দেশপ্রেমিক দল' কিংবা বাঙালি জাতির একক আধিপত্যের শৃঙ্খলে আত্মসমর্পণ করে এই লড়াই চালাতে গেলে তা শাসক শ্রেণীর পুরনো কাঠামো থেকে কখনোই বের হতে পারবে না৷

এর বিপরীতে বর্তমান সময়ে জাতীয় মুক্তির প্রথম শর্ত এই রাষ্ট্রের কাঠামোতে বসবাসরত সকল জাতি, ভাষা ও ধর্মের মানুষদের স্বীকৃতি, বৃহৎ ঐক্য এবং সকলের মুক্তির এজেন্ডা হাজির করা; শ্রেণি ও লিঙ্গীয় বৈষম্য – নিপীড়ন বিরোধী অবস্থান নিশ্চিত করা৷ দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারতের বৈশ্বিক আঞ্চলিক আধিপত্যের নানা আয়োজন থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখা৷ তৃতীয়ত, ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তানসহ এই অঞ্চলের নিপীড়িত জনগণের সাথে সংহতির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক দক্ষিণ এশিয়ার জন্য অগ্রসর হওয়া; চতুর্থত, সকল প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সর্বজনের মালিকানা প্রতিষ্ঠা; এবং পঞ্চমত, মানুষ ও পরিবেশকে কেন্দ্রে রেখে, সামাজিক মালিকানা গুরুত্ব দিয়ে, শিক্ষা চিকিৎসায় সর্বজনের অধিকার নিশ্চিত করে উন্নয়নের নতুন পথ নকশা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নের লড়াই৷

বলাই বাহুল্য,  সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং সবধরনের উগ্র পরিচয়ের (জাতি, ধর্ম ইত্যাদি) রাজনীতির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লড়াই এর অপরিহার্য অংশ৷

লেখকের সঙ্গে কি আপনি একমত? লিখুন নীচের ঘরে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান