1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জন্মশতবর্ষে ভুলে যাওয়া মোহিনীকে স্মরণ

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

মোহিনী চৌধুরীর লেখা ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’, ‘দিনদুনিয়ার মালিক তোমার’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে’-সহ অনেক গান এখনো মুখে মুখে ফেরে৷ কিন্তু কালজয়ী গীতিকার জন্মশতবর্ষেও  অনেকটাই উপেক্ষিত৷

https://p.dw.com/p/3iejP
মোহিনী চৌধুরীছবি: Privat

সংগীতের চর্চায় বরাবরই গীত রচয়িতাদের একটু লঘু চোখে দেখা হয়৷ গান হয়ে যায় কণ্ঠশিল্পীর৷ কখনো-সখনো জনপ্রিয় গানের সুরকার কিছুটা কৃতিত্ব পেলেও আড়ালে থেকে যান গীতিকার৷ এই আড়ালে থাকার বেদনা সারা জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন মোহিনী চৌধুরী৷ স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের বাংলা আধুনিক গানের জগতে বহু জনপ্রিয় গানের রচয়িতার জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে চলতি বছরে৷

১৯২০ সালে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে জন্ম মোহিনী চৌধুরীর৷ চল্লিশের দশকের গোড়া থেকে তাঁর গীতিকার জীবনের শুরু৷ এক দশক না ঘুরতেই বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল গীতিকবির লেখা অনেক গান৷ ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ থেকে ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’ আজো বাঙালির শ্রুতির সঙ্গী হয়ে আছে৷ তিনি বেঁচে আছেন ‘দিনদুনিয়ার মালিক তোমার দীনকে দয়া হয় না’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানি’, ‘শুনি তাকদুম তাকদুম বাজে বাজে ভাঙা ঢোল’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’-এর মতো কালজয়ী, জনপ্রিয় গানের মধ্যে৷ সিনেমার গানেও তিনি প্রতিভার ছাপ রেখেছেন৷ ‘নায়িকা সংবাদ’ ছবিতে ‘কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি’ বা ‘কেন এ হৃদয় চঞ্চল হলো’ আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে৷

জন্মশতবর্ষে এসে উপেক্ষা কিছুটা দূর হয়েছে: দিগ্বিজয় চৌধুরী

কিন্তু ক’জন জানেন, এসব গানের গীতিকার কে?

জীবদ্দশায় অনেক উপেক্ষা সহ্য করেছেন মোহিনী চৌধুরী৷ তাঁর লেখা গান ‘প্রচলিত’ তকমা নিয়ে বাজারে চলেছে৷ তিনি যে গান লিখেছেন, তার গীতিকার হিসেবে প্রচারিত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম, মীরা দেববর্মন বা কখনো প্রিয়ব্রতর নাম৷

এজন্য তার বেদনা কতটা গভীর ছিল, তা দেখেছেন প্রয়াত গীতিকারের পুত্র দিগ্বিজয় চৌধুরী৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বেঁচে থাকতেই তিনি যথেষ্ট উপেক্ষা সহ্য করেছেন৷ ১৯৮৭ সালে বাবার প্রয়াণের আগে অনেকে জানতেন না, তিনি বেঁচে আছেন৷ তিনি অর্থ চাইতেন না, চাইতেন নিজের কাজের স্বীকৃতি৷’’

আত্মবিস্মৃত বলে বদনাম আছে বাঙালির৷ তাই বাবার জন্য বারবার বিভিন্ন জায়গায় দরবার করেও স্বীকৃতি আদায় করতে পারেননি দিগ্বিজয়৷

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বেহালায় ‘মোহিনীকুঞ্জ’ নামে একটি পার্ক তৈরি হয়েছে৷ হয়েছে বুস্টার পাম্পিং স্টেশন৷

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখানকার শীর্ষ সংবাদপত্র মোহিনী চৌধুরীর পংক্তি নিয়ে শিরোনাম করেছিল, ‘মানবের তরে মাটির পৃথিবী, দানবের তরে নয়৷’

বাংলা গানকে আমি-তুমির প্রেমগাথা থেকে মোহিনী চৌধুরী দেশভাবনা ও গণচেতনার দিকে এনেছিলেন: শুভেন্দু মাইতি

কিন্তু তাতেও কি প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে? সংগীতশিল্পী শুভেন্দু মাইতি বলেন, ‘‘বাংলা গানকে আমি-তুমির প্রেমগাথা থেকে মোহিনী চৌধুরী দেশভাবনা ও গণচেতনার দিকে এনেছিলেন৷ অন্য মাত্রা যোগ করেছিলেন৷ এ জন্যই তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত৷ কিন্তু আমরা তাকে ভুলে গিয়েছি৷’’

শুভেন্দু মাইতি বলেন, কণ্ঠশিল্পীরা গানের আসরে গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর গান গাওয়ার সময় তার নাম বলতেন না৷ এ কারণে অনেক বিভ্রান্তি দেখা দিতো৷ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন সবিতাব্রত দত্ত৷ তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সময় মোহিনী চৌধুরীর নাম উল্লেখ করতেন৷ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষে কলকাতার ব্রিগেড ময়দানের সভায় এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ সেখানে শিল্পী সবিতাব্রত গীতিকারের নাম বলে গেয়েছিলেন মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ ৷ প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন আবেগরুদ্ধ মোহিনী৷ শুধু মঞ্চে নাম উল্লেখ নয়, সবিতাব্রতই ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় গীতিকার মোহিনী চৌধুরীকে নিয়ে প্রবন্ধও লিখেছিলেন৷

মোহিনী চৌধুরীর জীবন ছিল বর্ণময়৷ সংগীত রচনা থেকে চলচ্চিত্র পরিচালনার জগতে এসে সাফল্য পাননি৷ তারপর সৃষ্টিশীলতার দুনিয়া ছেড়ে দেন৷ বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহার সংসদীয় সচিবের দায়িত্ব নেন৷ তারপর এক বাঙালি শিল্পপতির আপ্ত সহায়কের চাকরিও করেছেন৷ দীর্ঘ বিরতির পর গানের জগতে ফিরে আসেন৷ এইচএমভি-র প্রাক্তন কর্তা ও হিন্দুস্তান রেকর্ডস-এর উপদেষ্টা অমল মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গীতিকার হিসেবে তার প্রতিষ্ঠা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল৷ তিনি অন্য পেশায় যুক্ত হয়ে পড়ার অনেক বছর পর যখন ফিরে আসেন, তখন অন্য গীতিকাররা সেই স্থান দখল করে নিয়েছেন৷’’

Indien Kolkata 100. Geburtstag Lyriker Mohini Chowdhury
মোহিনী চৌধুরী পরিচালিত একটি চলচ্চিত্রের পোস্টারছবি: Payel Samanta/DW

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, শচীন দেববর্মন, কৃষ্ণচন্দ্র দে, কমল দাশগুপ্ত প্রমুখ সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি৷ তাহলে এই বিস্মৃতি কি স্বাভাবিক? দিগ্বিজয় চৌধুরী মনে করেন, ১৯৬১সালে আকাশবাণীর সঙ্গে রেকর্ড কোম্পানির সংঘাতেরও শিকার হতে হয়েছিল তার বাবাকে৷ গীতিকার হিসেবে যথাযোগ্য সম্মান কখনোই পাননি, পাননি রয়্যালটি৷ গানপ্রতি মাত্র ৬ টাকা সাম্মানিক পেয়েছেন৷

১৯৮৭ সালের ২১ মে রেকর্ডিং স্টুডিও থেকে ফেরার পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান৷ এ বছর তাঁর স্মরণে কিছু আয়োজন হয়েছে বটে৷ বেহালা শরৎ সদনে দু'দিনের অনুষ্ঠান হয়েছে কানায় কানায় ভরা প্রেক্ষাগৃহে৷ গেয়েছেন এই বাংলার নামী শিল্পীরা৷ করোনার বাধায় বাকি অনুষ্ঠানের আয়োজন থমকে গেলেও এখনো বাতিল হয়নি৷ বাংলাদেশের শিল্পীদের উদ্যোগে হয়েছে মোহিনী স্মরণ৷ গত ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিনের প্রাক্কালে ওপার বাংলার একটি সংস্থার উদ্যোগে ফেসবুকে সাড়ে ৫ ঘণ্টা লাইভ সংগীতানুষ্ঠান হয়েছে৷ দিগ্বিজয় জানান, জন্মশতবর্ষের আগে থেকেই বাংলাদেশ স্মরণ করেছে তার বাবাকে৷ বিটিভিতে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান হয়েছে জন্মমাসে৷ অথচ পশ্চিমবঙ্গের টিভি চ্যানেলগুলো মোহিনী চৌধুরীকে বলতে গেলে স্মরণই করেনি৷ 

জন্মশতবর্ষের আয়োজনে খেদ সামান্য মিটেছে গীতিকারের পরিবারের৷ দিগ্বিজয় চৌধুরী বলেন, ‘‘জন্মশতবর্ষে এসে উপেক্ষা কিছুটা দূর হয়েছে৷ তাঁকে ঘিরে অনুষ্ঠান হয়েছে, আলোচনা চলছে৷ কিন্তু যে যন্ত্রণা নিয়ে তিনি চলে গিয়েছেন, সেই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার সুযোগ আর নেই৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য