1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘জঙ্গিদের বিষয়ে সচেতন না হলে ভবিষ্যতে আরো ভুগতে হতে পারে’

সমীর কুমার দে ঢাকা
২৫ নভেম্বর ২০২২

২০১৬ সালে গুলশানে হোলিআর্টিজানে হামলার পর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে জঙ্গিদের অনেকটাই নেটওয়ার্ক ভেঙে গিয়েছিল৷ কিন্তু ছয়বছর পর ঢাকার আদালতে কিভাবে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল?

https://p.dw.com/p/4K5HS
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার তৌহিদুল ইসলামছবি: Samir Kumar Dey

এর উত্তর খোঁজা হয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার তৌহিদুল ইসলামের সঙ্গে৷

ডয়চে ভেলে : আপনি তো জঙ্গিবিরোধী অনেকগুলো বড় অভিযানে অংশ নিয়েছেন৷ এসব অভিযানে গিয়ে কী ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে?

তৌহিদুল ইসলাম : এই অভিযানগুলো অত্যন্ত রিস্কি৷ মূলত হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর আমরা জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা পাই৷ এর আগে থেকেই জানতাম, তবে ওই সময় পুরোপুরি ধারণাটা পাই৷ ওই সময় আমরা দেখেছি, নব্য জেএমবি সারাদেশকে চারভাগে ভাগ করে চারটি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেছিল৷ একটা সিলেটে, একটা চট্টগ্রামের পটিয়ায়, একটা ঝিনাইদহে এবং আরেকটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ৷ এগুলো খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল৷ পটিয়াতে তো অপারেশনে আমাদের সোয়াতের ৯ জন আহত হয়েছিলেন৷ তাদের একজন তো এখনো পুরোপুরি সুস্থ না৷ প্রতিটি আস্তানায় তাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ থাকতো৷ তাদের খুঁজে পাওয়াটাও ছিল চ্যালেঞ্জ৷ তারা সিকিউরিটি ব্যাপকভাবে মেনটেন করতো৷

‘ঢিলেমি করেছি কিনা সেটা তদন্ত করতে একাধিক কমিটি হয়েছে’

যখন আস্তানায় সরাসরি অপারেশনে ঢুকে গেছেন, সেখানে কী ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছেন?

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি প্রতিষ্ঠার পর ২৩টি হাইরিস্ক অপারেশন হয়েছে৷ এই অপারেশনগুলো করেছে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সোয়াত৷ তবে তথ্য উপাত্তে যদি আমরা দেখতাম হাইরিস্ক নেই, সেখানে আমরা অপারেশন করতাম৷ আমি গাজীপুরের একটি অপারেশনের কথা বলি৷ আমরা একজনকে ধরলাম৷ তার কাছ থেকে তথ্য পেলাম, সে সকালে বের হয়েছে, যদি দুপুর ২টার মধ্যে বাসায় না ফেরে, তাহলে সঙ্গীরা ধরে নেবে সে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে৷ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ একজন জঙ্গি ছিল৷ সময় মিস করলে তারা সেখান থেকে চলে যাবে৷ সেই পরিস্থিতিতে আমরা সোয়াতের সহযোগিতা নিতে পারিনি৷ এমনকি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটও নিতে পারিনি৷ হাতে সময় ছিল খুব কম৷ সেই পরিস্থিতিতে আমরা অপারেশনে যাই৷ একজন সামনে থেকে দরজা নক করবে, খোলার পর এক মিনিটিও সময় তাদের দেওয়া যাবে না৷ পরে আমরা দেখেছি, যে দরজা খুলেছে তার হাতের কাছে ৪টি চাপাতি, বোমা ও লোডেড একাধিক অস্ত্র ছিল৷ ফলে সে একমিনিট না ঘোরার সময় পেলেও আমরা কেউ ফিরে আসতে পারতাম না৷ এমন ঝুঁকি নিয়েও অপারেশন করতে হয়েছে৷ এমন পরিস্থিতিতে উপস্থিত বুদ্ধিটা কাজে লাগানো জরুরি হয়ে যায়৷

জঙ্গিরা যে অস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহ করতো, সেই চ্যানেল কি বন্ধ করা গেছে?

এগুলো তারা ব্ল্যাক মার্কেট থেকে সংগ্রহ করতো৷ এটা কখনোই বন্ধ হবে না৷ বর্ডার সিকিউরিটিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে৷ এখনো তারা আর্মস সংগ্রহ করছে, মাদক সংগ্রহ করছে৷ এটা আসলে বন্ধ করা সম্ভবও না৷ তবে আমরা সতর্ক আছি৷ বর্ডার গার্ডকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে৷ যে যার জায়গা থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি তাদের নিবৃত্ত করার জন্য৷

হোলিআর্টিজানের পর আপনারা অনেকগুলো বড় অপারেশন করেছেন৷ এখন অনেকদিন কোনো বড় অপারেশন নেই৷ তারপর এই ঘটনা ঘটে গেল৷ তাহলে কি আপনারা ওদের তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না?

তখন আইএসের মতাদর্শে নব্য জেএমবি সংগঠিত হচ্ছিল৷ আমরা ২০১২-১৩ সাল থেকেই তাদের ব্যাপারে তথ্যগুলো পাচ্ছিলাম৷ সেই সূত্র ধরেই সিটিটিসি প্রতিষ্ঠা হয়৷ তখনই আমরা বুঝতেছিলাম সামনে ভয়ঙ্কর সময় আসছে৷ ওই সময় আমাদের অপারেশনে ৭৮ জন জঙ্গি হয় নিজেদের বোমায় নিজেরা উড়িয়ে দিয়েছে, অথবা সোয়াতের অপারেশনে মারা গেছে৷ নব্য জেএমবির ক্ষেত্রে ওই সময় যারা দায়িত্বে ছিল, তাদের নেটওয়ার্ক কিন্তু ভেঙে গিয়েছিল৷ আর আনসার আল ইসলাম ২০১৩ সাল থেকে ব্লগার এবং মুক্তমনা লেখকদের উপর ১৭টি আক্রমন করেছে৷ তখন তাদের সামরিক টিমের যে ১৭-১৮ জন ছিল, তাদের মধ্যে ১০-১২ জনকে আমরা ধরে ফেলেছিলাম৷ তখন তাদের শক্তি অনেকটাই কমে গিয়েছিল৷ সিটিটিসি সাড়ে ৫শ' জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে৷

আপনারা ধরতে পারেননি, কিন্তু তথ্য আছে এমন জঙ্গিদের সংখ্যা কেমন হবে?

এটা বলা মুশকিল৷ একেকজনকে গ্রেফতারের পর কিছু তথ্য পাওয়া যায়৷ আমরাও কিছু তথ্য পাই৷ এখন চারটি সংগঠন সক্রিয়৷ এর মধ্যে নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম, হুজি এবং হিযবুত তাহরীর৷ এর মধ্যে হিযবুত তাহরীর এখনও কোনো অপারেশনে যায়নি৷ তারা মানুষকে মোবিলাইজ করছে৷ এই সংগঠনগুলোর আইডোলোজিক্যাল মিল আছে৷ অপারেশনাল কিছু পার্থক্য থাকলে উদ্দেশ্য একই৷

ত্রিশাল থেকে যে তিনজনকে জঙ্গিরা ছিনিয়ে নিয়েছিল, তাদের সবাই কি ধরা পড়েছে?

সালাহউদ্দিন সালেহীন এখনও বাইরে আছে৷ সে পুরোনো জেএমবির নেতৃত্ব দেয়৷ অনেকবার কাছাকাছি গিয়েও তাকে ধরতে পারিনি৷ ভারতে কিছুদিন ছিল৷ যখন বোমা মিজান ভারতে ধরা পড়ে, তখন সে ব্যাঙ্গালুরুতে ছিল৷ সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অল্পের জন্য তাকে ধরতে পারেনি৷ আমরা অল্পের জন্য তাকে ধরতে পারিনি৷ সে কখনও দেশে, কখনও বিদেশে অবস্থান করে অত্যন্ত সিকিউরিটি নিয়ে৷ প্রযুক্তির কারণে তারা এমন কিছু অ্যাপ তৈরি করেছে যেগুলোর প্রবেশাধিকার আমাদের কাছে নেই৷ ফলে আমাদের কাজের ধরনও টাফ হয়ে যাচ্ছে৷

মেজর জিয়া এখন কোথায়?

আমরা তো তাকে নিয়ে অনেকদিন ধরেই কাজ করছি৷ দেশের বাইরে থেকে যে ধরনের কাজ করা যায়, তার কার্যক্রমে আমাদের মনে হচ্ছে না সে দেশের বাইরে আছে৷ আমরা ধারণা করছি, সে দেশেই আছে৷

ত্রিশালের পর আদালত চত্তরে যেটা ঘটে গেল তাতে কি মনে হচ্ছে জঙ্গিদের হ্যান্ডেল করতে আমরা বেশি ঢিলেমি করেছি?

এই বিশ্লেষণ জরুরি৷ ঢিলেমি করেছি কিনা সেটা তদন্ত করতে একাধিক কমিটি হয়েছে৷ তবে ত্রিশালের পর গাজীপুরে মুফতি হান্নানকেও ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল৷ সেটা কিন্তু তারা পারেনি৷ কিছু লুপহোলস তো ছিলই৷ তা না হলে এখান থেকে তো নিয়ে যেতে পারতো না৷ এ নিয়ে কাজ হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর না ঘটে সেই চেষ্টা করা হচ্ছে৷

এখন তাদের সামর্থ্য কোন পর্যায়ে?

কিছুদিন আগে আনসার আল সার্কিয়া নামে একটি সংগঠন সবাইকে এক প্ল্যাটফরমে নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছিল৷ তারা কিন্তু কুকিদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিচ্ছিল৷ তার অর্থ তারা বসে নেই৷ শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে৷ তারা যাদের টেনিংয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাদের আমরা সনাক্ত করেছি৷ বান্দরবানের সেই আস্তানাও আমরা শনাক্ত করে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছি৷ তারা যাতে নেটওয়ার বিস্তার করতে না পারে, সে চেষ্টা আমরা সর্বদাই করে যাচ্ছি৷

প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে৷ সর্বশেষ আদালতের ঘটনায় যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি এক সময় সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন৷ এখন এই প্রবণতা কমেছে, নাকি বেড়েছে?

আমাদের সচেতনতার জায়গা বাড়াতে হবে৷ শুধু অভিযান দিয়ে হবে না৷ সিটিটিসি সেই জায়গা থেকে ৪৮ জেলায় কাজ করেছে৷ জঙ্গিবাদী তথ্য এখন অনলাইনে পাওয়া যায়৷ টেকনোলজির কারণে সব তথ্য আমরা আটকাতে পারি না৷ জঙ্গিরা কিন্তু তাদের স্ট্র্যাটেজি থেকে সরে এসেছে৷ আগে ছিল মাদ্রাসা কেন্দ্রিক, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে৷ আমরা গ্রেফতারকৃত ৩০০ জন জঙ্গিকে নিয়ে গবেষণা করে দেখেছি, এর ৪৬ শতাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷ তাদের রিক্রুটমেন্ট পলিসি থেকে সরে এসেছে৷ হোলিআর্টিজানে আমরা দেখেছি সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেরা এই অপারেশনে গেছে৷ হিযবুত তাহরীরের সরাসরি রিক্রুট পলিসিতেই আছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সেনাবাহিনী থেকে রিক্রুট করা৷ আনসার আল ইসলামও এই পলিসি নিয়েছে৷ এমনকি বিচারালয়েও রিক্রুট করতে তারা চেষ্টা করছে৷ আমরা সচেতন না হলে ভবিষ্যতে আরো ভুগতে হতে পারে৷