1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘চাকরির সুযোগ না বাড়িয়ে বয়স বাড়ানো কোনো সমাধান না'  

সমীর কুমার দে ঢাকা
১১ জুন ২০২১

করোনা সংকটে অনেকটা সময় চলে গেলেও চাকরিতে যোগ দেয়ার সর্বোচ্চ বয়স বাড়ানোকে সব সমস্যার সমাধান মনে করেন না বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর৷ কারণটা সবিস্তারে বলেছেন ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে৷

https://p.dw.com/p/3um9O
Bangladesch Dhaka | Coronavirus | Test-Zentrum
ছবি: Reuters/M.P. Hossain

ডয়চে ভেলে : শিক্ষার্থীরা চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবি করছে, এই দাবি কি যৌক্তিক?

ফাহিম মাশরুর : বাংলাদেশের বর্তমান যে চাকরির বাজারের অবস্থা তাতে যারা গ্র্যাজুয়েট, তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে৷ বিভিন্ন গবেষণাও বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে একটি৷ বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ থেকে প্রতি বছর যে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে তার মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বেকার থাকছে৷ এটা সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে৷ এর কারণও আছে৷ আমাদের গ্র্যাজুয়েটদের জন্য যথেষ্ট চাকরির বাজার তৈরি হচ্ছে না৷ এখানে যত বেশি মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে, তত বেশি চাকরিহীন থাকছে৷ গত ১০ বছরে দুই-তিনবার সরকারি বেতন স্কেলে দুই থেকে তিনগুণ বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে৷ সেই অর্থে প্রাইভেট সেক্টরে বেতন অতটা বাড়েনি৷ কারণ, প্রাইভেট সেক্টরের ইনকাম ওই অর্থে বাড়েনি৷ গত ৫-৭ বছরে আমরা দেখেছি, বেসরকারি সেক্টরে চাকরির প্রতি আগ্রহ অনেক কমে গেছে৷ সবাই সরকারি চাকরি করতে চায়৷ 

চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর আন্দোলনকে আপনি কীভাবে দেখেন?

গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে: মাশরুর

এটাকে আমি দেখি, অন্য সবকিছুর একটা বহিঃপ্রকাশ৷ কেউ হয়ত দুই-তিনবারেও বিসিএসে ঢুকতে পারলো না৷ সে মনে করছে, আরো হয়ত সুযোগ পেলে সে ঢুকতে পারবে৷ এই কারণে সে আন্দোলন করছে, সুযোগ চাচ্ছে৷ আমার মনে হয়, এটা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান না৷ আমাদের আসলে গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরির সংস্থান করতে হবে৷ আমরা যদি প্রাইভেট সেক্টরে এই গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে এই ধরনের ডিমান্ড এমনিতেই কমে যাবে৷ আসলে যারা আন্দোলন করছে, সুযোগ বাড়লেই যে তারা চাকরি পাবে তার কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই৷ এখানে সরকারি চাকরির জন্য যে আবেদন পড়ে সেটা পদের চেয়ে দুই-তিনশ' গুণ বেশি৷ বয়স বাড়ানো হলে দুই-তিনজনের হয়ত চাকরি হবে৷ বাকি ৯০ বা ৯৫ জনের কিন্তু চাকরি হবে না৷ ফলে বয়স বাড়ানো একমাত্র সমাধান না৷ 

এখন চাকরির বাজারের যে অবস্থা তাতে এটা করা হলে সংকট বাড়বে না কমবে?

আমার মনে হয়, বয়স বাড়ানো বা কমানোর উপর সংকটের সমাধান নির্ভর করে না৷ এটা হলে যেটা হবে, একজন শিক্ষার্থী এখন হয়ত দুই বা তিনবার বিসিএস দেওয়ার সুযোগ পায়, বয়স বাড়ানো হলে তারা হয়ত ৫ বার এই সুযোগ পাবে৷ তার মধ্যে হাতে গোনা সৌভাগ্যবান কয়েকজন এই সুযোগ পাবে৷ আসলে যে পরিমান আবেদন পড়ে বিসিএসের জন্য, তার চেয়ে চাকরি অনেক কম৷ চাকরির সুযোগ না বাড়লে বয়স বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান হবে না৷  

প্রতিবেশী দেশগুলোতে চাকরির বয়সসীমা কেমন? করোনা পরিস্থিতিতে তারা কি নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে?

প্রতিবেশী দেশগুলোতেও চাকরির বয়সসীমা আমাদের মতোই৷ আমি মনে করি, এখন তো মানুষের কর্মক্ষমতা বেড়েছে৷ অর্থাৎ, আগে যে বয়সে অবসরে যেতো, এখন সেই বয়সের পরও তার কর্মক্ষমতা থাকে৷ সেই অর্থে আমরা হয়ত বয়সসীমা বাড়াতে পারি৷ আগে কিন্তু সেশনজটের কারণে অনেকেই চাকরিতে ঢোকার সময় খুব বেশি পেতো না৷ এখন কিন্তু সেশনজট কমে গেছে৷ এতে ২৩-২৪ বছর বয়সেই পড়াশোনা শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ এরপর কিন্তু সে চাকরির জন্য বেশ কয়েক বছর সুযোগ পাচ্ছে৷ করোনা পরিস্থিতির কারণে সর্বোচ্চ এক বছর বয়স বাড়ানো যেতে পারে৷ খুব বেশি বাড়ানোর পক্ষপাতি আমি না৷

পাশ করার পর চাকরির জন্য একজন শিক্ষার্থীর কত বছর সুযোগ পাওয়া উচিত?

আমি মনে করি, পাশ করার পর সরকারি চাকরির জন্য সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ বছর তার সুযোগ পাওয়া উচিত৷ যে এই ৫ বছরে ঢুকতে পারবে না, তাকে যদি ১০ বছর সুযোগ দেওয়া হয় তারপরও তার সম্ভাবনা কম৷

বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কেমন?

বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক বা আইএলও'র সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর ৫ থেকে ৬ লাখ গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বের হচ্ছে৷ এদের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ বেকার থাকছে৷ সেই অর্থে প্রতি বছর ৩ লাখের মতো বেকার তৈরি হচ্ছে৷ এটা আশঙ্কাজনক৷ আমার হিসেবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা পরিসংখ্যাগতভাবে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ৷ দেশে হয়ত সামগ্রিক বেকারের সংখ্যা ১০ শতাংশের কম৷ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা এখন সামাজিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে৷

এই সংকট সমাধানের উপায় কী?

আমরা যে প্রতি বছর ৫-৬ লাখ গ্র্যাজুয়েট বের করছি এটা আমাদের দেশের অর্থনীতির তুলনায় অনেক বেশি৷ কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় অনেক বেশি ছাত্র-ছাত্রীর আসা উচিত৷ যাতে সে টেকনিক্যাল বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে৷ এদিকে আরো বেশি বিনিয়োগ ও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে৷ যারা টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশন থেকে বের হচ্ছে, তাদের মধ্যে কিন্তু বেকারত্ব অনেক কম৷ এখানে কিন্তু ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী চাকরি পেয়ে যায়৷ এটা একটা উপায়৷ আরেকটা হলো, যেহেতু আমরা একটা ইয়াং কান্ট্রি, সেখানে প্রতি বছর ২৪ লাখের মতো মানুষ চাকরির বাজারে আসছে৷ তাদের বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে৷ যেমন তাদের উদ্যোক্তা বানানোর ব্যাপারে আরো বেশি কাজ করতে হবে৷ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাই কিন্তু বেশি চাকরির ব্যবস্থা করে থাকেন৷ অনেক গ্রাজুয়েট কিন্তু এখানে আসছে৷ তারা কৃষি বা গরুর খামার করছে৷ তাদের সহায়তা করতে হবে৷

কারিগরি শিক্ষার দিকে সরকারের মনোযোগ কতটুকু?

গত ৫ থেকে ১০ বছরে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেড়েছে৷ প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হচ্ছে৷ শুধু অবকাঠামো বানালে হবে না, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে ধরনের স্কিল দরকার সেই ধরনের করে তাদের তৈরি করতে হবে৷ আমাদের সোশ্যাল মাইন্ডসেট চেঞ্জ করতে হবে৷ আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণি মনে করে, তার ছেলে বা মেয়েকে গ্র্যাজুয়েট হতেই হবে৷ অথচ আমরা দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একটা শিক্ষার্থীর ১০-১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি হয় না৷ অথচ একটি পলিটেকনিক থেকে পাশ করে বেরিয়ে ১৫-২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি পেয়ে যাচ্ছে৷ অভিভাকদের এটা বুঝতে হবে৷ 

দেশের চাকরির বাজারে কতভাগ সরকারি আর কতভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে?

আমাদের হিসাবে সরকারি চাকরির সংখ্যা খুবই কম৷ আমাদের যে ৫ লাখ শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েশন করে বের হচ্ছে, তার ১০ ভাগেরও কম, অর্থাৎ ৫০ হাজারেরও কম শিক্ষার্থী সরকারি চাকরিতে ঢুকছে৷ বাকি সাড়ে ৪ লাখ সরকারি চাকরিতে ঢোকার সুযোগই পায় না৷ প্রাইভেট সেক্টরে চাকরির জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান যেন আরো তৈরি হয় সেদিকে নজর দিতে হবে৷

সরকারি চাকরিতে বয়স বাড়ালে বেসরকারি সেক্টরে কোনো প্রভাব পড়বে?

আমার মনে হয় না কোনো প্রভাব পড়বে৷ তবে যেটা হয়েছে, গত ১০ বছরে সরকারি চাকরিতে বেতন তিনগুণ বেড়ে গেছে৷ সেটার প্রভাব প্রাইভেট সেক্টরে পড়েছে৷ এখন ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাইভেট সেক্টরে যোগ দিতে চায় না৷ সবাই সরকারি চাকরিমুখি হয়ে গেছে৷ এ কারণে আমরা দেখছি, প্রাইভেট সেক্টরে ট্যালেন্টেড লোক খুঁজে পাচ্ছি না৷ ট্যালেন্টেডরা আগে প্রাইভেট সেক্টরে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হলেও এখন আর হচ্ছে না৷ ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান যোগ্য লোক খুঁজে পাচ্ছে না৷ এখন তারা দেশের বাইরে থেকে বহু মানুষকে চাকরি দিচ্ছে৷ এতে একটা বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে৷

করোনা পরিস্থিতিতে তো পরীক্ষা না নিয়েই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে৷ তাহলে এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার বিষয়টা আসছে কেন?

আমি মনে করি, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর খুব একটা ভিত্তি নেই৷ এখন যেটা আছে, ৩০ বছর সেটা যথেষ্ট বলেই আমি মনে করি৷ কোভিডের পরও কিন্তু একজন শিক্ষার্থী ২৪-২৫ বছরে সার্টিফিকেট পেয়ে যাবে৷ তারপরও সে ৫ বছর চাকরির পরীক্ষার সুযোগ পাবে৷ শিক্ষার্থীরা যে দাবিটা তুলছে, সেটা হয়ত তার দিক থেকে ঠিক আছে৷ কিন্তু সামগ্রিকভাবে যদি আপনি দেখেন, তাহলে এই দাবির যৌক্তিক ভিত্তি আছে বলে আমার মনে হয় না৷

এখন তো বিসিএসেও এক ধরনের জট লেগে গেছে, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের পথ কী?

করোনা পরবর্তী সময়ে এই জটগুলো ছোটানোর ব্যবস্থা করতে হবে৷ অল্প সময়ের মধ্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে৷ অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে৷ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হয়৷ পাশাপাশি সরকারি চাকরির প্রতি সবাই যেন আগ্রহী না হয়ে প্রাইভেট সেক্টরেও যায়, সে ব্যাপারে প্রাইভেট সেক্টরকে প্রনোদনা দিয়ে তৈরি করতে হবে৷ এর আসলে সামগ্রিক সমাধান দরকার৷