নতুন শঙ্কায় শিক্ষক শ্যামল কান্তি
২৭ এপ্রিল ২০১৭গত বছরের ১৪ মে ইসলাম ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে বিদ্যালয়ের ভেতরে অবরুদ্ধ করে মারধর করা হয়৷ পরে স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমানের উপস্থিতিতে তাঁকে কান ধরে ওঠবস করানো হয়৷ এরপর তাঁকে ওই স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়৷ এ ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ নানা ঝড়-ঝঞ্জা পেরিয়ে চাকরি ফিরে পান শ্যামল কান্তি ভক্ত৷ তাঁর বিরুদ্ধেই ঘুসের অভিযোগে দায়ের করা এক মামলায় গোপনে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ৷
এ বিষয়ে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিতারিত করার নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ নতুন করে হুমকিও দিচ্ছে ওসমান পরিবার৷ শামীম ওসমান তো আমাদের মামলা তুলে নিতেও বলেছেন৷ এর মধ্যে লোকও পাঠিয়েছেন৷ কিন্তু আমি তাকে বলেছি, মামলার বাদি সরকার৷ আমি কী করতে পারি? তারপরও তিনি আমার সঙ্গে বসতে চান৷ আমার নিরাপত্তার জন্য একজন পুলিশ সদস্য আছেন৷ তিনি আমার কথা শোনেন না৷ কোথায় থাকেন, ডাকলেও আসেন না৷ ফলে আমাকে হত্যা করা হতে পারে এমন শঙ্কার মধ্যে আমি দিন পার করছি৷''
ঘুসের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, বন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হারুনুর রশিদ গত ১৪ এপ্রিল শ্যামল কান্তি ভক্তকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছেন৷ আগামী ২৪ মে এ বিষয়ে শুনানি হবে৷ হারুনুর রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমি তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি৷ ফলে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছি৷ চারজন সাক্ষীও আছে৷ অভিযোগকারী ছাড়াও তার স্বামী ও স্কুলের একজন অভিভাবক প্রতিনিধি এই মামলার সাক্ষী হয়েছেন৷ এখানে অভিযোগকারী শিক্ষক মোর্শেদা বেগমের সঙ্গে এমপি সাহেবের কোনো সম্পর্ক নেই৷ আমি নিরপেক্ষভাবে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছি৷''
শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে এমপিওভুক্ত করে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে স্কুলের ইংরেজি শিক্ষিকা মোর্শেদা বেগমের কাছ থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে৷ এ মামলায় ৪ জনকে সাক্ষী দেখিয়ে গোপনে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ৷
নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিক তানভির হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা শুরু থেকেই আশঙ্কা করেছিলাম শ্যামল কান্তিকে ফাঁসাতে এমন কিছু করা হতে পারে৷ সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো৷ শ্যামল কান্তি তো আগে থেকেই বলে আসছেন, তাঁকে ফাঁসানোর চক্রান্ত হচ্ছে৷ তাঁকে লাঞ্ছিত করার পর থেকেই তো বিভিন্ন ধরনের মামলা দেয়া হয়৷ তিনটি মামলার মধ্যে দু'টি মামলায় কোনো অভিযোগের সত্যতা মেলেনি৷ আর ঘুসের মামলায় পুলিশ চার্জশিট দিল৷''
এদিকে বিচার বিভাগীয় তদন্তের পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে মামলাটি ঢাকার চিফ ম্যাট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচার শুরু হচ্ছে৷ আগামী ১৪ মে সেলিম ওসমানের হাজিরার দিন নির্ধারিত রয়েছে৷ নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে অবিলম্বে জিডির নথি ঢাকায় প্রেরণ করতে বলা হয়েছে৷ তাঁকে এই নির্দেশনা পালন করতে বলেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি জেবিএম হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনের ওপর শুনানি শেষে আদালত এই আদেশ দেন৷
নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের নির্দেশে বন্দর থানার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক শ্যামল কান্তি ভক্ত কান ধরে উঠবস করতে বাধ্য হয়েছেন বলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷ ভিডিও ফুটেজ দেখে বিষয়টি প্রতীয়মান হয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়৷
আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়, জনগণের দাবির মুখে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে উঠবস করান সেলিম ওসমান৷ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, উপস্থিত স্থানীয় জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এমপি ওই নির্দেশ দেন৷ পরে এই প্রতিবেদন নিয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়৷ শুনানি শেষে আদালত শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছনার ঘটনায় করা জিডি, এ সংক্রান্ত নথিপত্র এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকা চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজিএম) আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট৷
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১০ আগস্ট, অর্থাৎ শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করানোর প্রায় তিন মাস পর সেই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান জড়িত কিনা তা জানতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট৷ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়৷ আদালত আদেশে বলে, কান ধরে উঠবসের ঘটনায় স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের সম্পৃক্ততা নেই মর্মে পুলিশের প্রতিবেদনে প্রকৃত সত্য তুলে ধরা হয়নি৷