1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

খেলার মাঠ কত প্রয়োজন তা শিশুও বোঝে, কিন্তু...

প্রভাষ আমিন
২৯ এপ্রিল ২০২২

কদিন ধরে ঢাকা নিয়ে কিছু বই পড়ছি৷ ঢাকা আমার জন্মস্থান নয়৷ তবে জীবিকার সন্ধানে গত ৩৩ বছর ধরে ঢাকায় আছি৷ তাই এই শহরের প্রতি এক ধরনের মায়া পড়ে গেছে৷

https://p.dw.com/p/4AdL6
ছবি: DW

চোখের সামনে বদলে যেতে দেখেছি ঢাকাকে৷ ৪০০ বছরের পুরোনো এই শহর অনেক উত্থান-পতনের সাক্ষী৷ রাজধানী হলে একটু সমৃদ্ধি আবার রাজধানী মুর্শিদাবাদে চলে গেলে স্থবিরতা৷ এভাবে এগোতে এগোতে ঢাকা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী, একটি মেগা শহর৷ বুড়িগঙ্গার তীর ধরে ৮ মাইল লম্বা, ২ মাইল চওড়া ঢাকাকে আজ দুই সিটি কর্পোরেশনও সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে৷ ছেলেবেলায় আমরা পড়েছি ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত৷ এখন এটা লিখলে ভুল হবে৷ ঢাকার অনেক মানুষ জীবনে বুড়িগঙ্গা দেখেইনি হয়তো৷ উত্তরার বাসিন্দাদের যদি বলা হয়, ঢাকা বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত, তারা হয়তো মানতে চাইবেন না৷ এটা ঠিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার কারণে একসময় সভ্যতা গড়ে উঠতো নদীর পাড়েই৷ শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের পুরোনো বড় সব শহরই কোনো না কোনো নদীর তীরে গড়ে ওঠা৷ বুড়িগঙ্গার তীর ছিল একসময় ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা৷ ঢাকার নবাব এবং বিত্তশালীরা বাস করতেন নদীর তীরে৷ আহসান মঞ্জিল, রূপলাল হাউস, লালবাগের কেল্লা, বড় কাটরা- সবই বুড়িগঙ্গার্ তীরে৷ ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ছিল ওয়ারী৷ তখন ঢাকার শেষ সীমানা ছিল ফুলবাড়িয়া৷ রমনা থেকে ঘন জঙ্গল৷ তারপর ঢাকা দ্রুত বেড়েছে৷ ওয়ারী থেকে ধানমন্ডি, তারপর বনানী, গুলশান, বারিধারা, উত্তরা, পূর্বাচল৷ ঢাকা শুধু বড়ই হচ্ছে৷

ঢাকা যত বড় হচ্ছে, ততই এর বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে৷ বিশ্বে বাসযোগ্যতার বিবেচনায় ঢাকার স্থান বরাবরই নীচের দিকে৷ ঢাকা বেড়ে উঠছে অপরিকল্পিতভাবে৷ ঢাকা শুধু বুড়িগঙ্গার তীরে নয়, বৃহত্তর ঢাকা সৃষ্টিকর্তার এক আশীর্বাদ হতে পারতো৷ ঢাকার চারপাশে চারটি মিঠা পানির নদী- বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা৷ ঢাকার বুকে জালের মতো ছড়ানো ছিল খাল৷ সেই খালগুলো অনেক আগেই আমরা গিলে খেয়েছি৷ চারপাশের চারটি নদীও দখলে-দূষণে মৃতপ্রায়৷ সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদকে আমরা পরিণত করেছি অভিশাপে৷ হাতিরঝিলকে রক্ষা করা গেলেও মতিঝিলে যে একসময় সত্যি সত্যি ঝিল ছিল, এটা বললে লোকে হাসবে৷ দিলখুশা বা শাহবাগ যে চমৎকার বাগানের নাম, বললে কেউ বিশ্বাস করবে না৷ হাতির আবাস পিলখানা থেকে যে হাতির পাল এলিফ্যান্ট রোড হয়ে হাতিরপুল পেরিয়ে হাতিরঝিলে গোসল করতে যেতো- এটা কল্পকাহিনি মনে হবে৷ একসময় বর্ষাকালে শ্যামলী রিং রোডে দাঁড়ালে পশ্চিমে সাগর মনে হতো৷ এখন সেখানে ভবনের সাগর৷ সেখানে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো আবাসিক এলাকা৷ কোথাও কোনো মাঠ নেই, পার্ক নেই৷ সেখানে ‘জাপান গার্ডেন সিটি’ নামে একটি আবাসিক এলাকা আছে৷ নামে ‘গার্ডেন’ থাকলেও সেখানে গার্ডেনের ‘গ’-ও নেই৷ গায়ে গায়ে লাগানো কতগুলো আকাশছোঁয়া ভবন৷ গুলশানের কাছে ‘নিকেতন’ নামে একটি অভিজাত আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে, যেখানে ঢুকলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে৷ ছিমছাম আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি এখন আবাসিক এলাকা না বাণিজ্যিক এলাকা বোঝা মুশকিল৷

আবাসিক এলাকা বলতে আমরা এখন বুঝি আকাশ ঢেকে দেয়া উঁচু উঁচু ভবন আর তাতে ম্যাচবাক্সের মতো ফ্ল্যাট, যেখানে আমরা একা একা থাকি, পাশের ফ্ল্যাটের খবরও রাখি না৷

মানুষের বাস করতে হলে যে খেলার জন্য একটু মাঠ লাগে, হাঁটার জন্য একটু পার্ক লাগে, গোধুলির আকাশ দেখার জন্য একটু ফাঁকা জায়গা লাগে, বুষ্টিতে ভেজার জন্য একটু সবুজ লাগে, মন খারাপ হলে বসার জন্য একটু পানি লাগে; আমরা ভাবিই না৷ তাই তো আমরা খাল ভরাট করে রাস্তা বানাই, জলাধার-পুকুর ভরাট করে আবাসিক এলাকা বানাই৷ আর এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে তিন ঘণ্টা জলাবদ্ধতা হলে ওয়াসা আর সিটি কর্পোরেশনকে গালি দেই৷

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪১টিতে কোনো খেলার মাঠ নেই৷ একটি আধুনিক শহরে প্রতি আধা বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য একটি করে খেলার মাঠ দরকার৷ সে হিসাবে ঢাকায় মাঠ থাকার কথা অন্তত ৬১০টি৷ জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকায় মাঠ দরকার ১ হাজার ৪৬৬টি৷ কিন্তু ঢাকায় মাঠ আছে সাকুল্যে ২৫৬টি৷ তাও সব মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত নয়৷ কিছু মাঠ বেসরকারি ক্লাবের দখলে, কিছু মাঠ ব্যবহৃত হচ্ছে মেলার কাজে, কিছু বন্ধ উন্নয়নকাজের জন্য৷ পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ধুপখোলা মাঠের একপাশে বহুতল মার্কেট হচ্ছে৷

এই যে পর্যাপ্ত মাঠ নেই, মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে৷ এর জন্য দায় কিন্তু পুলিশ বা সরকারকে দিয়ে পার পাওয়া যাবে না৷ এটা আমাদের সম্মিলিত দায়৷ আমাদের উন্নয়ন ভাবনায় পার্ক, মাঠ, লেক, খালি জায়গা থাকে না৷ আমরা কোথাও খালি জায়গা দেখলেই সেখানে কত উঁচু ভবন করা যাবে, তাতে কয়টি ফ্ল্যাট হবে; তা দিয়ে সমৃদ্ধি মাপি৷ সেখানে মাঠের কোনো ভূমিকা নেই৷ আমাদের সন্তানদের আসলে মাঠে যাওয়ার সময় কোথায়? ক্লাস, পরীক্ষা, কোচিঙেই ঠাসা আমাদের সন্কানদের সকল সময়৷ দিনের রুটিনে কোথাও খেলা নেই৷ আর থাকলেও খেলা মানে কম্পিউটার গেমস, ভার্চুয়াল জগত৷

গল্পটা আমি আগেও লিখেছি৷ বর্তমানে চাকরি সূত্রে জার্মানিতে থাকা বন্ধু খালেদ মুহিউদ্দীনের ঢাকার বাসা ছিল বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে৷ এক শুক্রবার সকালে আমি বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাচ্ছিলাম তরুপল্লবের গাছ চেনানোর অনুষ্ঠানে৷ ভাবলাম খালেদকেও নিয়ে যাই৷ খালেদ বললেন, দাঁড়ান, শব্দিতাকে জিজ্ঞেস করে নেই৷ একটু পরে খালেদ রিং ব্যাক করে বললো, শব্দিতাকে জিজ্ঞেস করেছি৷ ঘুম ঘুম চোখে সে খুব বিরক্ত হয়ে আমাকে বলেছে, বিরক্ত করো না তো বাবা, সারা সপ্তাহ আমি হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করি, একটা ছুটির দিনে একটু ঘুমাতে দাও৷ পাঁচ বছরের শব্দিতার কণ্ঠে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো ভেবে পাচ্ছিলাম না৷ আপনারা নিশ্চয়ই হাসছেন৷ আমি কিন্তু হাসতে পারিনি, আমার কান্নাই পাচ্ছিল৷ শব্দিতা কি খুব ভুল বলেছে? আমার ছেলে প্রসূন আমিনের রুটিন দেখেও আমার প্রতিদিন কান্না পেতো৷ প্রসূন বা শব্দিতার জন্য আমার মায়া হয়৷ নিজের ছেলেবেলার কথা ভেবে নিজেকেই অপরাধী মনে হয়৷ আমরা স্কুল থেকে ফিরে কোনোরকমে নাকেমুখে খেয়ে মাঠে ছুটে যেতাম৷ তারপর মাগরিবের আজান পর্যন্ত স্বাধীন- ফুটবল, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, সাতচাড়া, মার্বেল; কতরকমের খেলা যে ছিল ইয়ত্তা নেই৷ আমাদের সন্তানেরা সব খেলার নামই জানে না৷ খেলার সময়ই যদি না থাকে, তাহলে আর মাঠ দিয়ে কী হবে! দোষটা আসলে তাদের নয়, আমাদের৷ আমরাই তাদেরকে অনন্ত প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দিয়েছি৷ আমি ঠিক জানি না, আমরা কিসের পেছনে ছুটছি, সন্তানদের ঠেলে দিচ্ছি কিসের রেসে৷ সাফল্য মানে আসলে কী? জীবনে আমরা আসলে কী চাই৷ জীবন তো একটাই এবং সেটাও খুব বড় নয়৷ আমরা যে আমাদের সন্তানদের শৈশব চুরি করছি, কিসের জন্য৷ জীবনের শুরুতেই রেসে নামিয়ে দিচ্ছি কেন? কোথায় গন্তব্য?

আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাংসদ জয়নাল হাজারী একবার বলেছিলেন, যে বাঘ মানুষ মারে, সে বাঘ রক্ষায় এত আয়োজন করতে হবে কেন? সব বাঘ গুলি করে মেরে ফেললেই মানুষ নিরাপদ থাকবে৷ আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় যারা বসে আছেন, তাদের ভাবনাটা মনে হয়, জয়নাল হাজারীর মতো৷ এত মাঠ, খালি জায়গা রেখে লাভ কী! বড় বড় ভবন বানালেই তো বেশি বেশি টাকা, বেশি বেশি উন্নয়ন, বেশি বেশি গড় আয়, বেশি বেশি জিডিপি৷

প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক ও লেখক
প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক ও লেখকছবি: DW

কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ নামে পরিচিত ছোট্ট এক চিলতে খালি জায়গাকে পুলিশের গ্রাস থেকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ লেগেছে৷ মাঠ যে দরকার, সেটা পুলিশ বোঝেনি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বোঝেননি৷ সবার ভাবনা, জায়গা খালি রেখে লাভ কি, থানা বানাও৷ মাঠে খেলতে না পারলে শিশু-কিশোরদের শারীরিক, মানসিক বিকাশ হবে না৷ তারা মাদকে আসক্ত হবে, অপরাধে জড়াবে৷ তখন তো পুলিশ লাগবেই৷ তার চেয়ে একেবারে থানা বানানোই ভালো৷ রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যানই বা রাখার দরকার কী? সেখানেও থানা, পুলিশ লাইন বানিয়ে ফেলা হোক৷ আমরা দেশটাকে পুলিশী রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলার সব আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছি৷ সবার ওপরে পুলিশ সত্য৷ মাঠ বাঁচাতে আন্দোলন করলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে৷ জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করতে চাই পুলিশের কঠোর অভিযান৷ কিন্তু আরো বেশি মাঠ থাকলে, খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকলে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটালে জঙ্গিবাদ-সাম্প্রদায়িকতা ঢোকারই সুযোগ পাবে না৷ আমরা সব বন্ধ করে দিয়ে জঙ্গিবাদকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি৷ আর নিষ্পাপ তরুণদের মগজ ধোলাই হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ দিয়ে দমন করতে চাই৷ আমাদের স্বপ্ন ছিল এমন একটা রাষ্ট্র, যেখানে আইনের শাসন থাকবে, পুলিশের প্রয়োজনীয়তা কম থাকবে৷ কিন্তু সব আয়োজন করছি এমনভাবে যাতে আরো বেশি পুলিশ লাগে, আরো বেশি থানা লাগে৷

খেলার মাঠ কেন দরকার? এই প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু একটি পত্রিকাকে বলেছেন, ‘‘সুদূরপ্রসারী চিন্তার অভাবে ঢাকার মাঠ পর্যায়ক্রমে কমে গেছে৷ যখনই যারা শাসন করেছেন, তারা কখনো ভাবেননি তাদের নাতিদেরও একসময় খেলার প্রয়োজন হবে, বৃদ্ধ বয়সে তাদেরও হাটার প্রয়োজন হবে৷ শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ, নৈতিকতা ও সৌহার্দ্যের জন্যও মাঠের প্রয়োজন৷’’ লিপু ভাই কিন্তু ঢাকার আসাদ গেট এলাকার মাঠে খেলে বড় হয়েছেন৷ দেশ সেরা ক্রিকেটার হয়েছেন৷ তবে মাঠ কেন দরকার? এই প্রশ্নের উত্তরে পুরান ঢাকার এক ছোট্ট শিশু যা বলেছেন, তারপরে আর কোনো কথা নেই৷ ছবিটি বছর দুয়েক আগের৷ সম্ভবত বকশিবাজার এলাকার কোনো মাঠ বাঁচানোর আন্দোলনে নেমেছিল শিশুটি৷ তবে এখন তেঁতুলতলা মাঠের আন্দোলনে প্রাসঙ্গিক বলে তার কথাটি নতুন করে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে৷ নাম না জানা সেই শিশুটি আসলে পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, ‘‘আমরা এই ময়দানে খেলতে না পারলে কোথায় খেলবো? এই ময়দানে তো আমরা খেলতেই পারি না৷ আমরা খেলা খেলবো না. তাহলে পড়ালেখার অবস্থা কী হবে? মোবাইল চালাবো, কম্পিউটার চালাবো৷ তারপর ব্লু হোয়েল খেলে যখন মরবো, তখন বলা হবে যে তোমরা কেন ব্লু হোয়েল খেলছিলা? আপনারা কেন মাঠ বন্ধ করতাছেন?’’

এই শিশুর প্রশ্নের উত্তর কি আছে আমাদের বড়দের কাছে?

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য