1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ক্ষমতা সীমিত, তবে সম্মান এখনো আছে

গৌতম হোড়
৭ জানুয়ারি ২০২২

ভারতে রাষ্ট্রপতির হাতেও যে ক্ষমতা আছে, তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন সাবেক ও প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী।

https://p.dw.com/p/45G9l
ছবি: picture-alliance/AP Photo/G. Osan

১৯৯৮ সাল। দুই বছর আগে ১৩ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন বাজপেয়ী। তার পক্ষে সংখ্য়াগরিষ্ঠতা জোগাড় করা কঠিন বা কার্যত অসম্ভব জেনেও রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মা বাজপেয়ীকে সরকার গঠনের জন্য ডেকেছিলেন। কারণ, বিজেপি তখন বাকি সব দলের থেকে বেশি আসন পেয়েছেন বা তারা একক সংখ্য়াগরিষ্ঠ দল, যদিও ম্যাজিক নম্বর ২৭২-এর ধারেকাছে নেই তারা। তা সত্ত্বেও বাজপেয়ীকে সরকার গঠনের ডাক দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি এবং তিনি তা সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। তখন তার সঙ্গে শিবসেনা ও অকালি ছাড়া আর কোনো দল ছিল না। বাকি দলের কাছে তখনো বিজেপি ছিল অস্পৃশ্য। 

কিন্তু দুই বছর পর ১৯৯৮ সালে ইন্দ্রকুমার গুজরাল সরকারের পতনের পর আবার ভোট হলো। আবার বিজেপি সব চেয়ে বড় দল। শুধু বড় দলই নয়, একদা অস্পৃশ্য বিজেপি-কে তখন সাদরে বরণ করে নিয়েছে অনেক দল। যার মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের তৃণমূল কংগ্রেস এবং জর্জ ফার্নান্ডেজ ও নীতীশ কুমারের সমতা পার্টিও ছিল। তখন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন। দক্ষিণ ভারতের দলিত এবং রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে যিনি কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। দলিত বলে যার পিতামহের ছায়া পর্যন্ত উচ্চবর্ণ এড়িয়ে চলত। নারায়ণন সংবিধানকে হুবহু অনুসরণ করতেন। বিদেশ সফরে তার সঙ্গী হয়ে, তার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম, আপাদশির ভদ্রলোক নারায়ণন ছিলেন কপিবুক প্রেসিডেন্ট।

তিনি বাজপেয়ীকে জানিয়ে দিলেন, ২৭২ জন সাংসদের লিখিত সমর্থন দিতে হবে। তারপর তিনি তাকে ডাকবেন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেয়ার জন্য। কিন্তু এআইএডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা কিছুতেই সমর্থনের চিঠি দিচ্ছেন না। তিনি তখন সমর্থনের বিনিময়ে নানান দাবি জানাচ্ছেন বিজেপি নেতৃত্বের কাছে।

বিজেপি নেতাদের মধ্যে টেনশন চরমে। বাজপেয়ীর বিশ্বস্ত বন্ধু যশবন্ত সিং এবং অনুগামী প্রমোদ মহাজনকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হলো, চিঠি জোগাড় করার। না হলে তীরে এসে তরী ডুবে যেতে বসেছে। বেশ কয়েকদিনের টানাপোড়েনের পর বাজপেয়ী সহ বিজেপি নেতাদের হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়ে জয়ললিতা চিঠি দিলেন। বাজপেয়ী সমর্থনের সব চিঠি নিয়ে দেখা করলেন নারায়ণনের সঙ্গে। তারপর রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রাঙ্গনে স্বভাবসিদ্ধ রসিকতা করে বললেন, চিঠ্ঠি আয়ি হ্যায়', মানে চিঠি এসে গেছে। সেই সময়ে বলিউডের এই 'চিঠ্ঠি আয়ি হ্যায়' গান প্রবল জনপ্রিয়। টেনশনমুক্ত বাজপেয়ী তখন সেই গানের কলি তুলে ধরে জানিয়ে দিলেন, তার দ্বিতীয়.বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে আর বাধা নেই।রাষ্ট্রপতি সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

সেজন্যই বলছিলাম, বাজপেয়ী বুঝেছিলেন, রাষ্ট্রপতিরও কিছু ক্ষমতা আছে, একেবারো ঠুঁটো জগন্নাথ নন তিনি। ভারতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্য়ে সংঘাতের সেরা উদাহরণ হলো জ্ঞানী জৈল সিং বনাম রাজীব গান্ধী। এর আগে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি  রাজেন্দ্রপ্রসাদ কিছু বিষয়ে একমত হতে পারেননি। সবচেয়ে বড় বিরোধ ছিল, সোমনাথ মন্দির পুনরুদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে। নেহরুর মত ছিল, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সরকারি পয়সায় কেন মন্দিরের পুনরুদ্ধার হবে? রাজেন্দ্রপ্রসাদের বক্তব্য ছিল, সরকারি টাকায় এই পুনরুদ্ধার করতে হবে। শেষ পর্যন্ত নেহরু মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তার নাতি রাজীবের সঙ্গে জৈল সিংয়ের বিরোধটা ছিল ক্লাসিক পর্যায়ের।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর জৈল সিং বলেছিলেন, ''আমার নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমায় প্রেসিডেন্ট করেছেন। তিনি যদি একটা ঝাড়ু হাতে আমায় ঘর সাফ করতে বলতেন, আমি তাই করতাম।'' এহেন ইন্দিরা-ভক্ত জৈল সিং অপারেশন ব্লু স্টারের পরে শিখ নেতাদের প্রবল চাপ সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দেননি।  তিনিই সেই ইন্দিরা-পুত্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে গিয়েছিলেন।

বিরোধটা শুরু হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং-কে বিদেশ সফর সেরে এসে রাজীব কিছু না জানানোয়। তাছাড়া দেশের ক্ষেত্রে বড় বড় সিদ্ধান্ত নিলেও নিয়মমাফিক তা জৈল সিংকে জানাতেন না রাজীব। এই নিয়ে বিরোধ বাড়তে বাড়তে ভয়ংকর অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাজীব বলছেন, তিনি বিদেশ সফর সেরে প্রেসিডেন্টকে ব্রিফ করেছেন। জৈল সিং বলছেন, এক বিদেশি অতিথিকে অভ্য়র্থনা জানানোর সময় রাজীব ঘরোয়াভাবে কয়েকটা কথা বলেছেন মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। জৈল প্রশ্ন তুলেছেন, পাঞ্জাব, নাগা, মিজো চুক্তি নিয়ে কেন তাকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে? রাজীব সংসদে যা বলেছেন, চিঠি লিখে তাকে খণ্ডন করছেন জৈল।

সংবাদিক বীর সাংভি তার বই 'আ রুড লাইফে'-এ শুনিয়েছেন জৈল সিং সম্পর্কে রাজীবের মনোভাবের কথা। একবার অরুণাচল যাওয়ার পথে বিমানে রাজীব তাকে বলেছিলেন, জৈল সিং দ্বিতীয়বার রষ্ট্রপতি হতে চান। আর তিনি কিছুতেই তাকে আর প্রেসিডেন্ট করবেন না। রাজীবের অভিযোগ ছিল, রাষ্ট্রপতি ভবনে বসে পাঞ্জাবের রাজনীতি পরিচালিত করতে চান জৈল। আর তার বিদেশ সফর মানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের রাতের ঘুম ছুটে যাওয়া। বাংলাদেশ সফরে গিয়ে জৈল বলেছিলেন, তিনি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্য়ে বিরোধ মেটাতে মধ্যস্থতা করতে পারেন। তারপর রাজীবের কাছে অসংখ্য ফোন আসে। রাজীব জানিয়ে দেন, প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা কোনোভাবে হস্তক্ষেপ করবেন না। বীর সাংভির এই স্মৃতিচারণ থেকে রাজীব-জৈল সিং বিরোধের চরিত্র কিছুটা বোঝা যাবে।

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

শেষ পর্যন্ত রাজীব গিয়ে জৈলের সঙ্গে দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বৈঠক করেছিলেন। তাতে বিরোধ কিছুটা কমে। একসময় কংগ্রেস নেতাদের আশঙ্কা ছিল, জৈল আবার রাজীবের বিরুদ্ধে কোনো চরম পদক্ষেপ নেবেন না তো? জৈল অবশ্য সেই চরম জায়গায় যাননি।

এমনিতে রাষ্ট্রপতি দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারী, কিন্তু এই পদটা মূলত আলংকারিক। একথা ঠিক, ভারতের রাষ্ট্রপতি হলে যে রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকা য়ায়, তার তুল্য বাসভবন সারা দেশে একটাও নেই। একদা বড়লাটের আবাস এখন রাষ্ট্রপতি ভবন। দিল্লির রাইসিনা হিলসের চূড়ায় ৩২০ একর জমিতে ৩৪০টি ঘরের রাষ্ট্রপতি ভবন। তার মধ্যে রাষ্ট্রপতির আবাস, গেস্ট রুম, বিদেশি অতিথিদের জন্য ঘর, দরবার হল, অশোক হল, লাইব্রেরি, ফুলের বাগান, যার মধ্য়ে সবচেয়ে বিখ্যাত মুঘল গার্ডেনস, ঘোড়সওয়ার বাহিনী, জুড়িগাড়ি, কর্মীদের থাকার জায়গা, কী নেই সেখানে। রাষ্ট্রপতি ভবনের মিউজিয়ামে চাঁদের পাথর পর্যন্ত আছে। সব আছে, তবে ক্ষমতা সীমীত।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা যে পরামর্শ দেবে তা তিনি মানতে বাধ্য। খুব বেশি হলে কিছু ক্ষেত্রে তিনি আরেকবার বিবেচনার জন্য বিল সই না করে ফেরত পাঠাতে পারেন। কিন্তু সরকার আবার তা ফেরত পাঠালে তিনি সই করতে বাধ্য। বিলে সই না করে ফেরত পাঠানোর কয়েকটি উদাহরণ আছে। এপিজে আব্দুল কালাম বিহারে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত সই না করে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। প্রণব মুখোপাধ্য়ায় মোদী সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তারা সমানে কেন অর্ডিন্যান্স করছে, কেন তারা সংসদে বিল পাস করাচ্ছে না। প্রত্য়েক রাষ্ট্রপতিই কমবেশি এই ধরনের প্রশ্ন তুলেছেন। তাতে সরকার কিঞ্চিত বিড়ম্বনায় পড়ে, তার বেশি কিছু নয়। এখানে যত ক্ষমতা সব প্রধানমন্ত্রীর। অতীতে এমন প্রশ্নও উঠেছে, রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপালের মতো পদগুলি থাকার দরকার কি?

রষ্ট্রপতিকে অল্প কিছু ক্ষমতা নিয়েই তুষ্ট থাকতে হয়। তার সম্মান আছে, ক্ষমতা বিশেষ নেই। তবে ভারতে একসময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ, রাধাকৃষ্ণন, জাকির হোসেনের মতো ব্যক্তিত্ব। পণ্ডিত মানুষ,  বিচক্ষণ, দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। নারায়ণনের মতো দলিত ব্যক্তিত্ব রষ্ট্রপতি হয়েছেন, আবার এপিজে আব্দুল কালামের মতো বিজ্ঞানীও হয়েছেন। তবে ইউপিএ আমলে প্রতিভা পাতিলের মতো তুলনায় কম পরিচিত ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। নরেন্দ্র মোদীও স্বল্প পরিচিত দলিত নেতা রামনাথ কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতি করেছেন। তাদের ক্ষমতা কম থাকতে পারে, কিন্তু ভারতে রাষ্ট্রপতির পদ এখনো সম্মানের। তিনি ডাকলে কেউ আসবেন না, উপেক্ষা করবেন, এটা হয় না। এটা রাজ্যপালের ক্ষেত্রে হয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ধনখড় বিশ্ববিদ্য়ালয়ের উপাচার্যদের বৈঠক ডেকেছিলেন। একজন ছাড়া কেউ আসেননি।  রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে অবশ্য এই ঘটনা ঘটে না।  খাতায় কলমে তিনি দেশের প্রধান। ফলে তাকে অসম্মান করার কোনো প্রশ্নই নেই। 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য