1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ক্ষতিপূরণ : আদালতের আদেশ বনাম ক্ষমতাধরদের অপকৌশল

সমীর কুমার দে ঢাকা
৩ জুন ২০২২

প্রায়শই আদালত বিভিন্ন ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেন। টাকার অংকও নির্ধারণ করে দেন আদালত। কিন্তু সেই ক্ষতিপূরণের অর্থ কি সংশ্লিষ্টরা পাচ্ছেন?

https://p.dw.com/p/4CGSu
Dhaka Bangladesch 7 von 19
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। কেন পাচ্ছেন না? পাওয়ার পথই বা কী? আদালতের নির্দেশ না মানলে তো শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তাহলে যারা এই নির্দেশনা মানছেন না, তাদের কি কোনো  শাস্তি হচ্ছে?

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনের দুই ঘটনায় নিহত ১০৪ শিশুর প্রত্যেক পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এ অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে। বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশনা দেয়।

১৯৯১ সালে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাডফ্লেম ফার্মাসিউটিক্যালসের ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবন করে ৭৬ শিশু মারা যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এরপর ২০০৯ সালে রীড ফার্মার ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে আরো ২৮ জন শিশু মারা যাওয়ার অভিযোগে মামলা হয়। এ দুই ঘটনা নিয়ে ওই সময় প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন যুক্ত করে ঘটনার দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি এবং যথাযথ নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট আবেদন করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। এইচআরপিবির পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। 

এর আগেও তো অনেক মামলায় আদালত ক্ষতিপূরণের নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে অনেক নির্দেশনাই  বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না জানতে চাইলে মনজিল মোরশেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা আদালতে বলেছি- নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হলো বেঁচে থাকার অধিকার, কিন্তু ভেজাল ওষুধের কারণে অনেককে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। এ বিষয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ ধারায় ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকলেও তা প্রায়ই কার্যকর হয় না। আদালত আমাদের ব্যাখ্যা শুনে একটি সুন্দর রায় দিয়েছেন। আদালতের রায় কিভাবে বাস্তবায়ন হবে সেটা তো আমাদের সংবিধানেই আছে। এখন প্রশ্ন হলো, সবাই কি এটা মানছেন? আপনারাও বলেন, আমরাও দেখেছি আদালতের অনেক রায়ের বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আদালতকেও আমরা শক্ত কোনো অবস্থান নিতে দেখছি না। এটা যদি না হয় তাহলে তো মানুষকে ঘুরতেই হবে, এটা তো অবধারিত হতেই হবে। এর ফলে আইনের শাসনের দুর্বলতা স্পষ্ট হচ্ছে আস্তে আস্তে।”

৪০২ জনের পরিবারের ছয় বছরের অপেক্ষা

চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে ২০০৩ সালে এমভি নাসরিন-১ লঞ্চ ডুবে যায়। এতে প্রাণ হারান ৪০২ জন। ওই ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট হয়। পরে দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৬ সালে আদালত নিহতের স্বজনদের প্রতি পরিবারকে ১০ লাখ করে মোট ১৭ কোটি ১১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের রায় দেন। তবে আদালতের আদেশের পর ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

৪ কোটি ৬১ লাখ ৪৫২ টাকার এক টাকাও পায়নি তারেক মাসুদের পরিবার

 ২০১১ সালের ১৩ই আগস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানিকগঞ্জের ঘিওরে দুর্ঘটনায় মারা যান চলচিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ ৫ জন। এই ঘটনায় তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিলেও এখনো কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি তার পরিবার। অন্যদিকে মিশুক মুনীরের ক্ষতিপূরণের মামলায় শুনানিই শেষ হয়নি এখনো। মিশুক মুনীরের ছোট ভাই আসিফ মুনীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "২০১৭ সালে মিশুক মুনীরের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের মামলা শুরু হয়। এটা কত দিন চলবে এবং শেষ পর্যন্ত এই ক্ষতিপূরণ কতটুকু পাওয়া যাবে সেটা কিন্তু একেবারেই অনিশ্চিত। অনেকদিন পরপর একটা ডেট আসে, আবার নতুন করে ডেট পড়ে। এভাবেই চলছে। এটা কবে শেষ হবে আমরা আসলে জানি না।”

রওশন আক্তার

‘ক্ষমতাধরদের কাছে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে'

সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা দৈনিক সংবাদের সাবেক বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু ১৯৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর শান্তিনগরে আনন্দ ভবনের সামনে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পানীয়বোঝাই একটি মিনি ট্রাকের চাপায় আহত হন। ১৩ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। ঘটনার এক বছর পর ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর স্ত্রী রওশন আখতার বাদি হয়ে ৩ কোটি ৫২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করেন। ২০০৫ সালের ২০ মার্চ আদালত ৩ কোটি ৫২ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেয়া বেভারেজ কোম্পানিকে। পরে হাইকোর্ট ঘুরে নানা অজুহাতে সেই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। সেই টাকা আদায়ে আবার বিচারিক আদালতেও আবেদন করতে হয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক টাকাও পাননি তিনি।

রওশন আখতার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "১৬ বছর হয়ে গেছে সর্বোচ্চ আদালতের রায়। এই টাকা যখন পেলাম না, তখন নিম্ন আদালতে আবার রায় বাস্তবায়নের জন্য মামলা করতে হলো। বিবাদীর তেজগাঁওয়ের জমি ক্রোক করলো কোর্ট থেকে। ক্রোক করে নিলামের অর্ডর করলো, কিন্তু সেই নিলামে কেউ পার্টিসিপেট করে না। কারণ বিবাদির আইনজীবী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। বিবাদি তার নিকটআত্মীয়। নিলামে কিনলেও জমি বুঝে নিতে পারবেন না- এই কারণে কেউ নিলামে অংশ নেন না বা তারা নিতে দেয় না। এখন মামলাটি মে মাসে খারিজ করে দিতে চেয়েছিল আদালত। আমি অনেক কষ্ট করে ২১ জুলাই নতুন তারিখ নিয়েছি। শেষ পর্যন্ত কী হবে আমি জানি না। ক্ষমতাধরদের কাছে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।”

রাজধানীর পল্লবীর বেনারসির কারিগর মো. আরমানকে ভুল আসামি হিসেবে সাজা দেয়ায় তাকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। তবে দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও রায়ের বাস্তবায়ন হয়নি। এমন অনেক ঘটনায়ই আদালতের নির্দেশের পরও মেলেনি ক্ষতিপূরণ।

‘সর্বোচ্চ আদালতের রায় যদি মানুষ না মানে আমরা কোথায় যাবো?'

২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দুই বাসের চাপায় হাত হারান তিতুমির কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন। তিনিও ১৩ দিন পর হাসপাতালে মারা যান। এই ঘটনায় ২০১৮ সালের ৮ মে রাজীবের পরিবারকে ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক টাকাও পায়নি রাজীবের পরিবার। নিহত রাজীবের খালা জাহানারা পারভীন বলেন, "প্রথমে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের কথা বললেও পরে সেটা আদালত কমিয়ে সজল পরিবহণকে ২৫ লাখ আর বিআরটিসিকে ২৫ লাখ টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু কোনো ক্ষতিপূরণই আমরা পাই নাই। সর্বোচ্চ আদালতের রায় যদি মানুষ না মানে, আমরা যদি কোন বিচার না পাই, তবে কোথায় যাবো আমরা?''

মনজিল মোরশেদ

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আদালতের আদেশ না মানার কোনো সুযোগ নেই। আদালতের কোনো আদেশ যদি কেউ না মানেন তাহলে আদালত অবমাননার মামলা করা যায়। তখন আদালত এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেন। সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর বিষয়টি আলাদা। এটা নিম্ন আদালতের মামলা। ফলে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য তাদের নিম্ন আদালতেই আবার মামলা করতে হয়েছে। সেখানেই ওটার নিষ্পত্তি হবে।”

কিছু মানুষ কিছুটা ‘ভাগ্যবান'

২০১০ সালের ২৬ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বেলাল হোসেন তুরাগ বাসের ধাক্কায় নিহত হওয়ার ঘটনায় ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পায় বেলালের পরিবার। ১৯৯১ সালের ২৯ মার্চ রাজধানীর মৌচাক মার্কেটের সামনে মারা যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাফিয়া গাজী। ওই ঘটনার ২৬ বছর পর বিআরটিসি নাফিয়া গাজীর পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় নিহত হন দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া আক্তার মিম। পরে ওই দুই পরিবারকে উচ্চ আদালত পাঁচ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

দিয়া আক্তার মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আদালতের নির্দেশে জাবালে নূর কর্তৃপক্ষ আমাকে ৫ লাখ টাকা দিয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী তার নিজস্ব তহবিল থেকে আমাকে আরো ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন।”

এছাড়া রাজধানীর শাহজাহানপুরে পাইপে পড়ে নিহত শিশু জিহাদের পরিবারকে আদালতের আদেশ অনুসারে ২০ লাখ টাকার ‘চেক ও পে-অর্ডার' দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নিদুর্ঘটনায় মারা যাওয়া চার রোগীর পরিবারের মাঝে ক্ষতিপূরণের এক কোটি টাকা দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর পল্টন কালভার্ট রোডের ওয়াসার খোলা ম্যানহোলে পড়ে মারা যাওয়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শানু মিয়ার পরিবারকে ক্ষতিপূরণের ৫০ লাখ টাকা বুঝিয়ে দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া গ্রিন লাইন পরিবহনের বাসচাপায় পা হারানো প্রাইভেটকারচালক রাসেল ক্ষতিপূরণের ১০ লাখ টাকার চেক গেলো বছর বুঝে পেয়েছেন। আর ২০১৩ সালে রাজধানীর মিরপুরে নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশু গৃহকর্মী খাদিজাকে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় কয়েকদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।

ক্ষতিপূরণের আদেশ কেন বাস্তবায়ন হয় না- জানতে চাইলে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এর জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে। আদালতের আদেশ সবাই মানতে বাধ্য। কেউ না মানলে সেটা আদালতের নজরে আনতে হবে। হ্যাঁ, যারা দরিদ্র, তাদের পক্ষে আদালতে যাওয়া হয়ত কঠিন, কিন্তু দেশের সব জায়গায় এনজিও আছে। যারা গরিব মানুষকে ফ্রি আইনি সেবা দিয়ে থাকেন। প্রয়োজনে তারা এসব এনজিওর কাছেও যেতে পারেন।”

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য