1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কৌশলী মমতা, আত্মঘাতী' কংগ্রেস ও অধীরের ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব

গৌতম হোড়
গৌতম হোড়
২৩ মে ২০২৪

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে মল্লিকার্জুন খাড়গে ও অধীর চৌধুরী একে অপরের বিরুদ্ধে তীব্র ‘আক্রমণ' করেছেন।

https://p.dw.com/p/4gAiW

কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী। সম্প্রতি তৃণমূলকে নিয়ে এই সর্বভারতীয় ও প্রদেশ সভাপতির মধ্যে তীব্র মতবিরোধ সামনে এসেছে। কেউ কাউকে রেয়াত করেননি। দুজনেই একে অপরকে লক্ষ্য করে শানিত শব্দবান ছুড়েছেন। তারপর খাড়গে কিছুটা নরম হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বিরোধটা থেকেই গেছে এবং আগামীদিনে তা বড় আকার নিতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে।

ঘটনার সূত্রপাত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভায় বলা একটা কথা থেকে। তিনি বলেছিলেন, ''যদি ইন্ডিয়া জোট সরকার গঠন করতে পারে, তাহলে তৃণমূল তাকে বাইরে থেকে সমর্থন করবে।''

এরপরই অধীর জানান, ''মমতাকে বিশ্বাস করা যায় না। অতীতে তিনি বহুবার বিজেপি-র হাত ধরেছেন।  আবার কংগ্রেসের হাতও ধরেছেন।''

অধীরের এই কথার পরেই খাড়গে বলেন, ''অধীর সিদ্ধান্ত নেয়ার কেউ নন। আমরা হাইকমান্ড। আমরা যে সিদ্ধান্ত নেবো, সেটাই মানতে হবে। না মানলে দল থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।''

খাড়গে বলেন, ''মমতা ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে আছেন।  তিনি সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন।''

অধীর তার জবাবে বলেন, ''আমার বিরোধিতা নৈতিক বিরোধিতা। এর মধ্যে ব্যক্তিগত বিষয় নেই। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে খতম করবে, আমি খাতির করবো তা হতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে দলকে রক্ষা করার জন্য আমি লড়াই করছি।''

অধীর বলেছেন, ''আমিও হাইকমান্ড। আমিও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে আছি।''

তার মন্তব্যের প্রবল প্রতিক্রিয়া হওয়ার পর খাড়গে বলেন, ''অধীর দলের লড়াকু সৈনিক। তিনি পশ্চিমবঙ্গের নেতা। কংগ্রেস শক্তিশালী। আমরা একে অন্যকে বুঝি। হাইকমান্ডই সিদ্ধান্ত নেয় যে, পশ্চিমবঙ্গে বামেদের সঙ্গে জোট করে ভোটে লড়া হবে।''

আপাতত এইভাবেই বিতর্ক থামাবার ও অধীরকে শান্ত করার চেষ্টা করেছেন খাড়গে। তবে উল্লেখযোগ্য হলো, তিনি এবারও বলেছেন, অধীর হলেন পশ্চিমবঙ্গেরই নেতা।

পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে কঠিন লড়াইয়ে অধীর চৌধুরী

গত পাঁচবছর ধরে যিনি লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা ছিলেন, যাকে নিজেদের নীতির বাইরে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রদেশ সভাপতির দায়িত্বেও রেখে দিয়েছে হাইকমান্ড (কংগ্রেসের নীতি হলো, এক ব্যক্তি, এক পদ), যিনি দলের সব গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সদস্য, তিনি কি শুধু পশ্চিমবঙ্গের নেতা? যদি তাই হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে তার কথায় এতখানি বিচলিত, ক্রুদ্ধ কেন হলেন খাড়গে? ‘‘সিদ্ধান্ত না মানতে পারলে দল ছেড়ে দিতে হবে''র মতো হুমকি পর্যন্ত দিয়ে রাখলেন কেন? নিজের দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধে এই ধরনের কথা বলে কী বার্তা দিতে চাইলেন খাড়গে?

বার্তাটা খুব স্পষ্ট, সেটা হলো, জাতীয় কংগ্রেস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আছে। মমতা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, রাহুলের বিরুদ্ধে কম কথা বলেননি। সে সবই খাড়গেরা হজম করে নিয়েছেন। এবার মুখ্যমন্ত্রী যখন সাত তাড়াতাড়ি বাইরে থেকে ইন্ডিয়া জোটকে সমর্থন করার কথা বলেন, তখন তো সঙ্গত কারণে এই প্রশ্ন ওঠে যে, এখন এই কথা কেন বলতে গেলেন তিনি? তিনি ও ইন্ডিয়া জোটের নেতারা তো বারবার বলেছেন, সরকারের গঠন নিয়ে, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, এই সব প্রশ্ন নিয়ে ভোটের ফলাফল বেরোনোর পর পরিস্থিতি অনুকূল হলে আলোচনা  করা হবে। তাহলে এখন সাত তাড়াতাড়ি কেন মমতার এই অবস্থান বদল, তিনি কী বার্তা দিতে চাইছেন?

মমতা যদি বলেন, তিনি বাইরে থেকে ইন্ডিয়া জোটকে সমর্থন করবেন, সরকারে অংশ নেবেন না, তাহলে মানুষের মনে এই ধারণাই হওয়া স্বাভাবিক যে, তাহলে ইন্ডিয়া জোট শক্তিশালী হবে না। জিতলেও সরকারে ঝামেলা লেগে থাকবে। তাহলে তাদের ভোট দেয়ার দরকার কী? সেক্ষেত্রে তো আদতে বিজেপি-রই লাভ হবে।

খাড়গেরা পশ্চিমবঙ্গে এলেন না কেন?

পাঁচ পর্বের ভোট হয়ে গেছে। ষষ্ঠ পর্বের ভোট হবে ২৫ তারিখ। এখনো পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারে খাড়গে, রাহুল গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীরা একবারের জন্য পশ্চিমবঙ্গমুখি হলেন না কেন? অধীরের বহরমপুর, ইশা খান চৌধুরীর মালদহ দক্ষিণ-সহ যে সব জায়গায় কংগ্রেস ভালো লড়াই করছে বা জেতার আশা করছে, সেখানেও তাদের দেখা গেল না কেন?

সম্ভবত এর একটাই কারণ, পশ্চিমবঙ্গে এলে তৃণমূল নিয়ে, তাদের বিরুদ্ধে নেতাদের দুর্নীতি নিয়ে, সহিংসতা ও সন্ত্রাসের অভিযোগ নিয়ে মুখ খুলতে হতো। তাতে তৃণমূল নেত্রী বেজায় চটতেন। সেই ঝুঁকিটা নেননি খাড়গেরা। গতবার তারা এখান থেকে দুইটি আসনে জিতেছিলেন। এবার সংখ্যাটা যে খুব বেশি বাড়বে, এমন আশা তো অতিবড় কংগ্রেস সমর্থকও করছেন না। তার থেকে বরং মমতা পাশে থাকলে জোটের শক্তি বাড়বে।

কিছু আসনের জন্য

তৃণমূল গতবার জিতেছিল ২২টি আসন। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করছেন, গত পাঁচ পর্বে ইন্ডিয়া জোট ভালো লড়াই করেছে। এই অবস্থায় বিজেপি বা এনডিএ যদি ক্ষমতা না পায়, তাহলে তাদের সামনে সুয়োগ আসতে পারে। তাদের এই ধারণা অলীক, নাকি তার ভিত্তি আছে, তা ফলাফল বেরোনোর পর বোঝা যাবে। আপাতত সেই সম্ভাবনাটুকু নষ্ট করতে চাইছেন না তারা।

সেজন্যই পশ্চিমবঙ্গে এত কাণ্ড হচ্ছে, কিন্তু তারা মুখে কুলুপ দিয়ে বসে আছেন। নিয়োগ কেলেঙ্কারি নিয়ে, সন্দেশখালি নিয়ে, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মমতার ক্রমাগত আক্রমণ নিয়ে, সমানে মেরুকরণের চেষ্টা নিয়ে, তারা মুখ খোলেননি। তারা এমন কিছু বলেননি, যাতে মমতা চটে যান। কারণ, তৃণমূল মানে তাদের কাছে ২০-২২টি আসন। সেজন্যই নিজের দলের প্রদেশ সভাপতিকে এই ভাষায় তিরস্কার করতে খাড়গের বাধেনি।

যে বামপন্থিদের বিরুদ্ধে তারা কেরালায় সোচ্চার, তাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে জোট করেছেন, যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাজ্যে জোট করে লড়ছেন, তাদের সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়ার স্বপ্ন দেখছেন, যে নীতীশ কুমার বিজেপি-র সঙ্গে থাকলে ভিলেন, তিনিই  জোটে এলে অসাম্প্রদায়িক নেতা, এই সব স্ববিরোধী ও সুবিধাবাদী নীতি নিয়ে চলতে গেলে এটাই হবে। আর সেজন্যই দলের এই অবস্থা। এখন অনেক রাজ্যে কংগ্রেসকে দূরবীন দিয়ে খুঁজে পেতে হয়।

খাড়গেরা কবে বুঝবেন, রাজনীতি নিজের জোরে করতে হয়। অন্যের ভরসায় রাজনীতি করতে গেলে শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যেতে হয়।  আর  যে কংগ্রেস সমানে বিজেপি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারের অভিযোগ করে, তাদের সভাপতি কী করে বলতে পারেন, সিদ্ধান্ত না মানলে দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা খোলা আছে। এটা কি কোনো গণতান্ত্রিক দলের শীর্ষ নেতার মনোভাব হতে পারে?