1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কোভিড সংক্রমণ ও আমাদের অগ্যস্ত যাত্রার সুগম ব্যবস্থা!

শায়লা রুখসানা দিনা
১৬ জুলাই ২০২১

সেদিন ছিল প্রেসক্লাবে ডিউটি ৷ কড়া রোদে কাজ শেষে দুপুরের পর অফিসে ফিরে ঘামে ভেজা শরীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আরাম খুঁজে নেয় ঠিকই, কিন্তু বিকেলের দিক থেকেই গলা খুসখুস৷

https://p.dw.com/p/3wavE
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

বছরের এই সময়টায় প্রায় প্রতিবছরই গরম থেকে ঠাণ্ডা লাগে৷ ফলে বিষয়টি খুব বেশি মনোযোগ পায়নি শরীরবাহকের কাছে৷

তবে মার্চ মাসের শেষদিকটায় তখন দৈনিক পত্রিকাটির অনেক কর্মীই কোভিড সংক্রমণের শিকার৷ প্রতিদিনই কারও না কারও আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছিল৷ উদ্বিগ্ন সহকর্মীরা কেউ কেউ বললেন, "বাসায় চলে যান”৷ আমার মনোভাব "আচ্ছা হাতের কাজটা শেষ করে উঠি”৷ এভাবে মোটামুটি বিকেল গড়ালে অফিস থেকে বাসায় গিয়ে প্রথম চিন্তা টেস্ট কোথায় করবো? টেস্ট করতে অপেক্ষমান মানুষের দীর্ঘ সারি বুথ থেকে রাস্তায় গিয়ে ঠেকেছে সে দৃশ্য তো আমি নিজেই দেখেছি৷

বাসায় যেহেতু শিশু থেকে বয়স্ক সব শ্রেণীর সদস্যই রয়েছে সুতরাং তাদের নিয়ে লম্বা সময় লাইনে দাড়িয়ে থাকা একরকম অসম্ভব বলে মনে হলো৷ এমন সময় সহকর্মী সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম ফোন দিলেন শরীরের খবর নিতে৷ তিনিই জানালেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড নমুনা সংগ্রহ টিমের কথা৷ ওই টিমের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য চিকিৎসক সারওয়ার উদ্দিন মিলন জানান, চিকিৎসক, টেকনোলজিস্টদের সমন্বয়ে সরকারের কোভিড স্যাম্পল কালেকশন মনিটরিং টিম কাজ করছে ৷ তাদের একটি দল বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে থাকে৷ (নগদ অ্যাপের মাধ্যমে ৩০৩ টাকা পরিশোধ করার পর ট্রানজ্যাকশন আইডি, নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, ইমেইল আইডিসহ নির্দিষ্ট হেল্পলাইন নম্বরে পাঠালে বাড়িতে এসে নমুনা সংগ্রহ করে এবং পরে মোবাইলে বা ইমেইলে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ এবং পরে দেখলাম এমন একটি ব্যবস্থার কথা অনেকেরই অজানা৷ তাহলে কী এই বিষয়টিতে যথেষ্ট প্রচার চালানো হয়নি?

যাই হোক৷ কোভিড টেস্ট করার জন্য আমার, বরের, সাত বছরের পুত্র এবং শাশুড়ির নাম পাঠানো হলো বৃহস্পতিবার রাতে৷ পরদিন শুক্রবার সকালেই বাড়িতে চলে এলো নমুনা সংগ্রহকারী দুইজন কর্মী৷ এখানে গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে যে কিছুটা বাড়তি গুরুত্ব পাওয়া গেছে সেটাকে স্বীকার করতেই হবে৷ তো দৃশ্যমান কোনো উপসর্গ না থাকায় টেস্ট করার বিষয়ে বরের প্রবল অনীহা থাকলেও চার জনের টেস্ট করা হল এবং রাতেই ফলাফল চলে এলো মোবাইল ফোনে৷ প্রবল অনীহা জ্ঞাপনকারী ব্যক্তিটি এবং আমি- দুজনই করোনা পজিটিভ৷ 

দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম ছেলেকে তার মামার বাসায় পাঠিয়ে দেয়ার৷ আমরা দুজন চলে গেলাম আইসোলেশনে৷ কর্মস্থলের নিযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ, নিজের আত্মীয় বন্ধু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ পর্ব শুরু হলো আমার৷ সপ্তাহ না ঘুরতেই দেখা দিল নতুন নতুন উপসর্গ৷ নিশ্বাস নিতে কষ্ট এবং অক্সিজেন লেভেল ৯০ থেকে ৯৮তে ওঠানামা করতে থাকে৷ অক্সিজেনের খোঁজে সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে নিজেই ফোন দিতে শুরু করলাম৷ সারাক্ষণ শরীর এবং মাথায় তীব্র ব্যথা৷ গলা ব্যথা৷ স্বাদ ও গন্ধহীনতা৷ সাফোকেশন৷ চিকিৎসকের পরামর্শে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকি৷ মেডিটেশন করি৷ কখনো প্রার্থনা, কখনো সিনোমা বা কমেডি শো দেখি৷ কিন্তু কিছুতেই কোনো স্বস্তি মেলে না৷ সঙ্গে নিদ্রাহীনতা৷ কোভিড আক্রান্ত একজন পুরুষ সহকর্মী ফোনে খোঁজ নেয়ার সময় জানান, একা এক কক্ষে অসুস্থ শরীরে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙার পরে তার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম৷ তার কথা শুনে আমার স্বস্তি হয় এই ভেবে যে, আমাকে অন্তত একা থাকতে হচ্ছে না!

এরই মাঝে দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষে গিয়ে হঠাৎ আয়নায় তাকিয়ে আবিষ্কার করি চোখ দুটো সম্পূর্ণ রক্তলাল! ওইসময় অনেকের চোখ ওঠা লোগ হচ্ছে বলে জানান চিকিৎসক৷ আবার বাড়লো ওষুধের ডোজ এবং যোগ হলো চোখের ড্রপার৷ সেইসাথে উদ্বেগ আর আতঙ্কও!

নেগেটিভ-পজিটিভ-নেগেটিভ

সংক্রমণের আনুমানিক ১৬/১৭ তম দিনে আবার টেস্ট করা হলো৷ উপসর্গহীন ব্যক্তিটির এবার মুক্তি মিলল৷ একটু পরেই এলো আমার  রিপোর্ট৷ ইংরেজিতে ‘নেগেটিভ' লেখা মেসেজটি দেখার এক মিনিটের মাথায় আর্বাও মেসেজ...‘ পজিটিভ'! তাহলে? কোনটি সঠিক? এখন কী করণীয়?

 ফোন দিলাম স্যাম্পল কালেকশন টিমের ডাক্তার মিলনকে৷ তিনি সাথে সাথে ল্যাবে ফোন দিলেন৷ ল্যাব থেকে আমাকে ফোন দেয়া হলো৷ এবং জানানো হলো "আপনার কোভিড নেগেটিভ রিপোর্টটি ভুলক্রমে গিয়েছে৷ আপনি আসলে এখনো পজিটিভ”৷

এবার শুরু আমার নিঃসঙ্গ যাত্রা! ছেলেকে নিয়ে তার পিতাকে অন্য কক্ষে থাকতে বললাম ঠিকই, কিন্তু একা একা রাতের বেলা অক্সিজেন লেভেল কমে যখন ৯০তে গিয়ে নামত তখন জোরে জোরে নিঃশ্বাস টেনে নিতে নিতে নিজেই নিজেকে মনোবল যোগাই৷ এরইমাঝে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান একজন টেলিভিশন প্রযোজক৷ স্বাভাবিকভাবেই এই মর্মান্তিক ঘটনাটি মনের ওপর চাপ তৈরি করে৷

চিকিৎসক ফোনে জানান, অনেক সময় করোনার ডেড সেল থাকে তাই ২১ দিনের আগে এখন নেগেটিভ রিপোর্ট অনেকেরই আসছে না৷ ২২ দিন পরে আবার নমুনা দেয়ার পর জানা গেলো – তখনো আমাকে করোনা  ছাড়েনি৷

এবার ডাক্তার মিলন নিজেই বললেন আপনার নমুনা আবার নিয়ে আইইডিসিআরের ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো আমরাই৷ নমুনা দিলাম আবার৷ কিন্তু অন্য ল্যাবে কী ঘটে- তা দেখার জন্য এর মাঝে বেসরকারি একটি হাসপাতালেও টেস্ট করতে গেলাম৷ অবশেষে পুরো একটি মাস শেষে সরকারি ও বেসরকারিভাবে আমাকে কোভিড নেগেটিভ ঘোষণা করা হলো!!

গণমাধ্যমকর্মী না হয়ে সাধারণ যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রে হলে এই নেগেটিভ-পজিটিভের ভোগান্তি কেমন হতো তা সহজেই অনুমেয়৷ সংক্রমণের দুই মাস পরও এখনো নানারকম পোস্ট করোনা এফেক্ট রয়ে গেছে শরীরে৷

আবার করোনার ঊর্ধ্বগতি

এই লেখাটি যখন লিখছি তখন ঘনিষ্ঠ একজন আত্মীয় হাসপাতালের আইসিউতে, একই হাসপাতালে ভর্তি তার ছেলে৷ আরেক নিকটাত্মীয় শিশু সন্তানসহ আক্রান্ত৷

আরেক দম্পতি মাহশিদ খান ও সোহানা দম্পতি৷ গতবছর সেপ্টেম্বরে দুজনই আক্রান্ত হওয়ার পরে  একটি বছরও পেরোয়নি, জুন মাসে আবার করোনার হানা তাদের ঘরে৷  ৩০ বছরের যুবক শুভ প্রথমবার মোটামুটি উপসর্গহীন করোনার অভিজ্ঞতা থাকলেও, এবার তোর ফুসফুসে ১৫% সংক্রমণ ধরা পড়ে৷ তীব্র শ্বাসকষ্ট, বমি, গলা ব্যথা নিয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালে যাওয়ার পর সিট না থাকায় তাকে বাসায় আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়৷ পরবর্তীতে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে হয়৷ ফুসফুসের ইনফেকশনের কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে চিকিৎসক তাকে অনলাইনে পাঁচ মিনিটের সাক্ষাত দিয়েছেন, কিন্তু সেজন্য টানা পাঁচ ঘণ্টা হাসপাতালে গিয়ে বসে থাকতে হয়েছে!

অবস্থার এত অবনতি কেন?

এবারে করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউ শুরুর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যু ও শনাক্তের হারে রেকর্ড হচ্ছে৷ টেস্টের জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ লোক আসছে পাচ্ছেন তা সামাল দেয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে, বলছে নমুনা সংগ্রহকারী দল৷

শায়লা রুখসানা দিনা, সিনিয়র প্রডিউসার, নেক্সাস টেলিভিশন
শায়লা রুখসানা দিনা, সিনিয়র প্রডিউসার, নেক্সাস টেলিভিশনছবি: Privat

একদিকে লোকজনকে মাস্ক পরাতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করতে প্রশাসনের ব্যর্থতার কথা উঠে আসছে, অন্যদিকে রাস্তাঘাটে, জমায়েতে লোকজন করোনাকে পাত্তা না দিয়ে বাহাদুরি দেখানোর মনোভাবও লক্ষ্যণীয়৷ তার ওপর টিকা গ্রহণ করা নিয়ে অনেকের মধ্যেই ছিল সন্দেহ অবিশ্বাস!

সরকারি পদক্ষেপের মধ্যে রাজধানীতে বাস ভাড়া বাড়ানো হলেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি যাত্রী বা পরিবহন মালিক কোন তরফেই৷ তদারকিও ছিল না৷ 

গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে হেটে, ফেরিতে, পিক আপ বা মাইক্রোবাস ভাড়া করে মানুষ গ্রামে ছুটেছিল৷ সে অভিজ্ঞতা থেকে কি কোনরকম শিক্ষা নিয়েছি আমরা? 

কিছ‚দিন আগেও ঢাকার বাইরের লোকজনকে বলতে শোনা গেছে গ্রামে করোনা নেই৷ এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে৷ জেলায় জেলায় হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নেই৷ গ্রামাঞ্চলে পুলিশকে দাবড়ানি দিয়ে লোকজনকে মাস্ক পরাতে হচ্ছে৷

ভারতের ভয়াবহ মাত্রার সংক্রমণ দেখেও আমাদের প্রশাসন সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি৷ গ্রামে সংক্রমণ দেখা দিলে কীভাবে মোকাবেলা করা হবে সে নিয়ে কোনরকম পরিকল্পনা চোখে পড়েনি৷ যদিও জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকেরা মনে করেন গ্রামে করোনা মোকাবেলায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যেত আরেকটু সক্রিয় হলেই৷

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন মনে করেন, সামাজিক উদ্যোাগ না থাকলে পুলিশ বললে বা মসজিদে মসজিদে শুধু ইমাম বা মুয়াজ্জিন বললে লোকে শুনছে না৷ সামাজিক উদ্যোগ এবং  কঠোর নজরদারি দরকার ছিল৷ তার আশঙ্কা ঈদের পরে সংক্রমণ বেড়ে যাবে৷

হঠাৎ করে টিকা নেয়ার হিড়িক

ভারত থেকে ৭০ লাখ ডোজ টিকা আসার পর সরবরাহ বন্ধ হলে বাংলাদেশে টিকা দান কর্মসূচি স্থগিত করতে হয়৷ আর তখনই হঠাৎ তোড়জোড় শুরু হয়েছে টিকা নেয়ার৷ প্রভাব খাটিয়ে অনেক অল্পবয়সীরা টিকা নিচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে৷ ১২ই জুলাই থেকে আবার শুরু হয়েছে টিকা দান প্রক্রিয়া৷ কিন্তু ব্যবস্থাপনার নানা ত্রুটির খবরও শোনা যাচ্ছে৷

কতটা কঠোর, কতটা শিথিল

করোনার প্রকোপ উর্ধবমুখী হওয়ায় জুলাই মাসের প্রথম দিন থেকে কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল ৷ বৃহস্পতিবার ১৫ই জুলাই থেকে তা আবার শিথিল করা হয়েছে৷  এর সাথে সাথে একদল মানুষ পরিকল্পনা করতে শুরু করেছেন কিভাবে ঢাকার বাইরে যাবেন৷ অন্যদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর কাজ তার মন্ত্রণালয়ের নয়, তাদের কাজ চিকিৎসা দেয়া!

এমন প্রেক্ষাপটে মনে একটাই প্রশ্ন আসে-

কতটা শিথিল হলে কঠোর হবে এসে

কতটা প্রাণ গেলে মানবে তুমি শেষে?