1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কূটনীতিকদের মুখে কুলুপ আঁটতে চায় ঢাকা?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৭ জুলাই ২০২২

বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও রীতিনীতি মেনে চলার বিষয়টি চিঠি দিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর৷ চিঠিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কারণে বিষয়টি মনে করানোর দরকার পড়েছে৷

https://p.dw.com/p/4EjBM
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবিছবি: DW/H. Ur Rashid

গত ১৮ জুলাই চিঠিটি ঢাকার সব বিদেশি দূতাবাস, জাতিসংঘ কার্যালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে পাঠানো হয়৷ চিঠিতে ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং ১৯৬৩ সালের কনস্যুলার রিলেশন নীতি মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে৷

ভিয়েনা কনভেনশন কী বলছে

সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব. ) শহীদুল হক বলেন, ‘‘ভিয়েনা কনভেনশেন অনুযায়ী, রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকদের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়৷ তারা কী করতে পারবেন আর পারবেন না তা সেখানে বলা আছে৷''

কোনো দেশেরঅভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো, মতামত দেয়া কূটনীতিকদের কাজ নয় বলে জানান তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘এমনকি একটি দেশে বিদেশি কূটনীতিকরা কোথায় যাবেন, কার সাথে কথা বলবেন বা কাকে আমন্ত্রণ জানাবেন তা-ওওই দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানাতে হয়৷ কিন্তু আমাদের এখানে সেটা মানতে দেখছিনা৷''

তিনি মনে করেন, সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা নির্বাচন কমিশনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন, রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন,জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে হয়ত সরকার এটা চাচ্ছে না৷

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, সরকার হয়ত তার সক্ষমতা প্রকাশ করেছে এই চিঠির মাধ্যমে৷ বডি ল্যাঙ্গুয়েজে পরিবর্তন আনছে৷

গত ১৩ জুন মন্ত্রিপরিষদ নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এই চিঠি দিতে বলা হয়েছিল৷
চিঠিতে বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ‘‘সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় আমরা সকলকে সম্মানের সাথে বলতে চাই যে, কূটনীতিকরা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তাদের কূটনৈতিক কার্যকলাপ যথাযথ কূটনৈতিক প্রোটোকল মেনে পালন করবেন৷''

কিছু ঘটনা
গত ৪ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)-র সাথে দেখা করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বে ‘‘অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) ১৪টি দেশের কূটনীতিকরা৷ বৈঠকের পর প্রতিনিধি দলের পক্ষে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ড সাংবাদিকদের বলেন, তারা বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনি পরিবেশ দেখতে চান৷ এজন্য তারা নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত, দেশের গণতন্ত্র আরো কার্যকর ও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে যে কোনো প্রকার সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছেন৷ ওইসিডি সদস্য দেশগুলো বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে আরো শাণিত করার মধ্য দিয়ে নাগরিকদের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে সহায়তা করতে চায়৷

তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তখন জানান, ওটা ছিল সৌজন্য সাক্ষাৎ, নির্বাচন নিয়ে তারা কোনো পরামর্শ দেননি৷ তারা নির্বাচনের আইন-কানুন ও প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন৷

ঢাকায়নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এনি ভন লিউয়েন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চালর্স হোয়াইটলি গত ২৪ জুলাই সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাথে বৈঠক করেন৷ বৈঠক শেষে জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার এক টুইটে বলেন, স্বাগতিক দেশের রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখা কূটনীতিকদের প্রধান দায়িত্ব৷ নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এনি ভন লিউয়েন টুইটে বলেন, স্বাগতিক দেশের পরিস্থিতি বোঝার জন্য এবং উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে একজন কূটনীতিক সকল অংশীদারের সাথে যোগাযোগ রাখতে সব সময়ই চেষ্টা করেন৷

অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো কূটনীতিকদের কাজ নয়: শহীদুল হক

গত ২ জুন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার বাসভবনে নাগরিক সমাজের ৫ জন প্রতিনিধিকে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানান৷ ওই আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি (বেলা)-র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ব্রতীর শারমিন সোনিয়া মুর্শিদ৷ তবে সেখানে বাংলাদেশের কোনো বিষয় নিয়ে কথা হয়েছি কিনা তা জানা যায়নি৷

গত ১৭ মার্চ ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা৷ গুলশান বিএনপির চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও শামা ওবায়েদ৷ ওই বৈঠকের আলোচনার বিষয় নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের ব্রিফ করা হলেও তাদের বক্তব্য নিয়ে পরে জার্মান রাষ্ট্রদূত অসন্তোষ প্রকাশ করেন৷ তিনি বলেন, বৈঠকের বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী৷ তিনি জানান, নির্বাচন নিয়ে কোনো কথাই হয়নি৷ বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার বিষয়টিও তখন নাকচ করেছেন জার্মান রাষ্ট্রদূত৷ তিনি বলেন, ‘‘এটা যদি আমার কথা হয়ে থাকে, আমি নিজেই আমার কথা বলতে পারি৷''

বিশ্লেষকরা যা বলেন
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘‘বিদেশি কূটনীতিকরা সারাক্ষণই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলেন৷ বাংলাদেশের মানবাধিকার, নির্বাচন নিয়ে তারা কথা বলেন৷ কিন্তু তারা তাদের দেশের ব্যাপারে এটা করতে দেবেন না৷ তারা কি ভারতে এটা পারবে? আমরা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গান ফাইট বন্ধের কথা বলতে পারবো? তারা পরাশক্তি, তাই তাদের ব্যাপারে বলা যাবে না৷ কিন্তু আমরা দুর্বল, তাই তারা আমাদের ব্যাপারে বলবে৷''

‘‘আমরা কি যুক্তরাষ্ট্রের গান ফাইট বন্ধের কথা বলতে পারব’’

তার মতে, ‘‘এটা বাংলাদেশে যারা যখন বিরোধী দলে থাকে, তারাই তখন কূটনীতিকদের কাছে ধর্না দেয়৷ তারা চায় সরকারের ওপর এভাবে চাপ তৈরি করতে৷ আর বিদেশি কূটনীতিকরাও এর সুযোগ নেন৷ কিন্তু আমি মনে করি, তারা এটা বাংলাদেশের কল্যাণে নয়, নিজেদের স্বার্থে করেন৷''

এটা বন্ধ হওয়া উচিত বলেও মনে করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ৷

তার কথায়, ‘‘বাংলাদেশের অবস্থা আর আগের মতো নেই৷ তার উন্নয়ন সহযোগীও একক কোনো শক্তি নয়৷ তাই বাংলাদেশ চাইলে এখন বিদেশিদের নাক গলানো বন্ধ করতে পারে৷ হয়ত তারই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এই চিঠির মাধ্যমে৷''

শহীদুল হক বলেন, ‘‘এখানে তো বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ কূটনৈতিক মিশন বা কূটনীতিকদের দরজায় সকাল হলেই হাজির হন৷ যখন যারা ক্ষমতার বাইরে থাকেন, তারাই তাদের আনুকুল্য পাওয়ার চেষ্টা করেন৷ আবার একেক দেশের সঙ্গে আমাদের আচরণও ভিন্ন৷ এক দেশের কাছে আমরা দৌড়ে যাই, আরেক দেশের ব্যাপারে আমরা প্রতিক্রিয়া দেখাই৷ আমাদের আগে সম্যনীতি দেখাতে হবে৷''

তিনি মনে করেন, ‘‘ বিদেশি কূটনীতিকদের এই নাক গলানো বন্ধ করতে আমাদের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে৷'' তবে এই চিঠি তেমন কোনো পরিবেশ তৈরি করতে পারবে কিনা সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন৷

বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য জানার চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি৷