কারগিলে হারজিতের খতিয়ান
২৬ জুলাই ২০১৯ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের সীমান্ত থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহর কারগিল৷ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কারগিলের উচ্চতা প্রায় ষোলো হাজার ফুট৷ ১৯৯৯ সালের মে মাসে এই কারগিলেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সর্বশেষ যুদ্ধের শুরু৷
তিন মাস ধরে চলা এই যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে যখন লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি পেরিয়ে পাকিস্তানি সেনারা ঢুকে পড়ে ভারতীয় মাটিতে৷ দুই তরফে গোলাগুলি চলে৷ ভারতীয় সূত্রমতে, নিহত হন ৫২৭জন, পাক কর্তৃপক্ষের চোখে এই সংখ্যা হয়ে যায় চার হাজার৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রতিবেদনে জানায় যে কারগিল যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন ৭০০জন৷ ভারত ও পাকিস্তানের এই যুদ্ধে কতজন নিহত হয়েছেন, তা নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো সংখ্যাই পাওয়া যায় না৷
ঠিক যেমন জানা যায় না আসলেই কতটুকু জয়ী হয়েছে ভারত৷
২৬ জুলাই ১৯৯৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত এই যুদ্ধে তাদের জয় ঘোষনা করে৷ উল্টোদিকে, তৎকালীন পাকিস্তানী তথ্যমন্ত্রী মুশাহিদ হুসেন এই যুদ্ধে পাক সেনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বাস্তবতা মেনে নিলেও, জোর গলায় বলেছিলেন যে এই যুদ্ধের ফলস্বরূপ ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুর্বল দিকগুলি আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন তারা৷
আজও কারগিল যুদ্ধের পরিণাম ও বাস্তবিক চিত্র নিয়ে দুই দেশের সরকার ও নাগরিক মহলে রয়েছে যথেষ্ট ধোঁয়াশা৷
যুদ্ধে অতিষ্ঠ জনগণ, সেনায় মজে সিনেমা
ভারতেজুড়ে আজ টুইটারে শীর্ষে রয়েছে ‘#কারগিল' হ্যাশট্যাগ৷ শুধু ২০১৯ সালেই নয়, ১৯৯৯ সালের পর থেকেই ২৬ জুলাই ভারতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্মরণ করা হয় ‘বিজয় দিবস' হিসাবে৷ ফলে মানুষের মনে যুদ্ধ নিয়ে এক রকম উৎসবের আমেজ৷ কিন্তু পাকিস্তানের কাছে কী তাৎপর্য্য এই দিনটির?
ডয়চে ভেলে উর্দু বিভাগে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিক শাহজেব জিলানীকে প্রশ্ন করা হয় কীভাবে পাকিস্তানী সংবাদমাধ্যম দেখছে এই দিনটিকে৷ তিনি জানান, ‘‘যে যুদ্ধকে পাকিস্তানী জনতা ও রাষ্ট্র ভুলতে চায়, সেই যুদ্ধ কেন মনে রাখবে আজকের পাকিস্তান? বর্তমান পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম সেনার বাড়ন্ত ক্ষমতাকে ভয় পায় বলেই কারগিল যুদ্ধে সেনার ভূমিকার সমালোচনা করতেও ভয় পায়৷ ফলে, আমাদের জাতীয় স্মৃতি থেকে কারগিলকে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা চালানো হচ্ছে ক্রমাগত৷''
উল্লেখ্য, দুই দেশেই কারগিল যুদ্ধের পর থেকে ক্রমাগত বেড়েছে সামরিকখাতে খরচ৷ বিশেষ করে পাকিস্তানে কারগিল যুদ্ধের পর থেকেই সরকারি কর্মকাণ্ডে বেড়েছে সামরিক নিয়ন্ত্রণ৷
উল্টোদিকে, এই যুদ্ধে সেনাবাহিনীর সাফল্য ভারতীয় চলচ্চিত্র থেকে টেলিভিশন সিরিয়ালে বারবার পরিবেশিত হয়ে আসছে, যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থাপন সব সময়েই বীরত্ব ও সাফল্যের সাথে করা হয়৷
এমন কার্যকলাপ স্বল্প আকারে হলেও পাকিস্তানে ঘটছে, জানালেন জিলানি৷ তিনি বলেন, ‘‘কিছু বছর আগে থেকে পাকিস্তানি সেনা বিভিন্ন চলচ্চিত্র, টেলিভিশন সিরিজ, এমনকি দেশাত্মবোধক গান তৈরির পেছনে অর্থলগ্নি করা শুরু করেছে৷ এর থেকে পরিষ্কার, যে সাধারণ মানুষের কাছে সেনার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা বর্তমানে কতটা৷''
এই একই ধারা দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে চলা ভারতে, যেখানে ‘উরি', ‘গাজি অ্যাটাক' বা ‘রাজি'র মতো ছবি শুধু বিপুল ব্যবসা করছে না, পাশাপাশি, ভারতীয় সেনাকে সততা ও দেশপ্রেমের নিদর্শন হিসাবেও উপস্থাপন করা হচ্ছে৷
বড়পর্দায় জনগণ যুদ্ধ দেখতে পছন্দ করলেও যুদ্ধের খেসারত সবচেয়ে বেশি দিতে হয় সাধারণ মানুষেরই, মনে করেন জিলানি৷ তিনি বলেন, ‘‘দুই দেশের সরকারই কাশ্মীরের মানুষ নিয়ে ভাবিত নন৷ তারা শুধু কাশ্মীরের জমি ও সীমানা নিয়ে চিন্তিত৷ সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে সীমান্তে বসবাসকারী মানুষ, মরছেন সবচেয়ে বেশি৷ এভাবে, সেনার চাপে, কতদিন দমিয়ে রাখা যাবে নাগরিকের মৌলিক সমস্যা?''
রাষ্ট্রের দরবারে যখন উপেক্ষিত হচ্ছে মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় দাবি, তখনই সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব হয়ে ওঠে মানুষকে ভাবানো, জাগানো, মনে করেন তিনি৷
তাই, কারগিল যুদ্ধের বিশ বছর পর, এক রাষ্ট্রের অতি-আস্ফালন আর অন্যের চরম নীরবতা মনে করিয়ে দেয় বর্তমান উপমহাদেশে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার প্রাসঙ্গিকতা, যা আজকের ভারত ও পাকিস্তান, দুই দেশেই প্রবলভাবে প্রশ্নের মুখে৷