কামদুনি নিয়ে অনাস্থা
১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ভারতের দক্ষিণের রাজ্যে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর অভিযুক্তদের মৃত্যু হয়েছে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে। এ নিয়ে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। একপক্ষের মত, ধর্ষকদের বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই। তাদের এমন পরিণতিই হওয়া উচিত। আর একপক্ষের বক্তব্য, বিচারের আগে এই মৃত্যু কাম্য নয়। পুলিশের বিরুদ্ধে ভুয়ো সংঘর্ষের অভিযোগও তুলেছে তারা। এই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে উঠে আসছে পশ্চিমবঙ্গের কামদুনিতে ধর্ষণ ও হত্যার কথা।
এনকাউন্টারে চার অভিযুক্তের মৃত্যুর পর কামদুনির মানুষরা সন্তোষ প্রকাশ করেছে। এক কলেজ ছাত্রীকে উত্তর ২৪ পরগনার কামদুনিতে ২০১৩ সালের ৭ জুন বাড়ি ফেরার পথে গণধর্ষণ ও খুন করা হয়। গোটা রাজ্যে এ নিয়ে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। এই মামলার রায় পাওয়া যায় তিন বছর পর। ২০১৬ সালে কলকাতার নগর দায়রা আদালত ছয় জনকে দোষী সাব্যস্ত করে। তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড ও অন্য তিনজনকে আমৃত্যু কারাবাসের সাজা শোনানো হয়। দোষী সাব্যস্তরা হাইকোর্টে মামলা করে। তারপর তিন বছর কেটে গিয়েছে। কবে মামলার নিষ্পত্তি হবে, কবে দোষীরা শাস্তি পাবে, সেই অপেক্ষায় রয়েছে কামদুনি।
ধর্ষণে অভিযুক্তদের হায়দরাবাদ পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর পর বিচারের জন্য অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষায় থাকা কামদুনির নির্যাতিতার পরিবার সন্তুষ্ট হয়েছে। নিজের মেয়ের নৃশংস হত্যার সাক্ষী যাঁরা, তাঁরা মনে করছেন, বিচারের নামে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেওয়া হলে তাঁদের বুকের আগুন নিভবে কবে। নির্যাতিতার মায়ের বক্তব্য, "হায়দরাবাদের পুলিশ ঠিক কাজই করেছে। এখানেও তাই হওয়া উচিত। মেয়ের জন্য কষ্ট কতটা, সেটা আমরাই জানি।"
দিল্লিতে নির্ভয়া ধর্ষণে দোষী সাব্যস্তদের ফাঁসি এখনো কার্যকর হয়নি। সেই ফাঁসি কার্যকর হতে চলেছে, এই সংবাদে আরো অধীর কামদুনি। নির্যাতিতার পরিবারের পক্ষ থেকে তাই হাইকোর্টে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির আর্জি জানানো হয়েছে। ধর্ষিতা ও নিহত ছাত্রীর ভাইয়ের মন্তব্য, "সুবিচারের জন্য আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের? ছয় বছর কেটে গিয়েছে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে আমরা শান্তি পাচ্ছি না।"
হায়দরাবাদ পুলিশের এনকাউন্টারের পর নির্ভয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে একই ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ, বিচার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হওয়ার কারণে অন্যায়কে জিইয়ে রাখা হচ্ছে। কলকাতা হাইকোর্টের পরও দেশের শীর্ষ আদালতে বিচারের জন্য মামলা যেতে পারে। সেখানে মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারে দোষীরা। সেই আবেদনে রাষ্ট্রপতির মত পাওয়ারও কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই।
কামদুনি আন্দোলনের অন্যতম মুখ টুম্পা কয়াল। সেই আন্দোলনের ধারা বেয়ে এখনো কলকাতায় নারী নিরাপত্তার দাবিতে প্রতিবাদ, মানববন্ধন হয়। শহরের দেওয়াল রঙিন হয়ে উঠেছে নারী সুরক্ষার বার্তায়। এই রাজ্যে কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। কন্যা সন্তানকে গুরুত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে প্রচার চলছে। তাও পরিস্থিতিতে বদল হচ্ছে না। তাই টুম্পা মনে করেন, হায়দ্রাবাদ পুলিশ অন্যায় কিছু করেনি। তাঁর বক্তব্য, "বিচারে এত সময় লেগে যায় যে নির্যাতিতার পরিবার হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের মেয়ে আর ফিরবে না। কতদিন তারা বিচারের জন্য অপেক্ষা করবেন?" তবে টুম্পা স্বীকার করেন, বিচারের আগে এমন মৃত্যুতে নিরপরাধ ব্যক্তির জীবন খোয়ানোর আশঙ্কা থাকে।
যদিও আইন বিশেষজ্ঞ, ত্রিপুরার প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এই প্রতিক্রিয়াকে বিচার ব্যবস্থা নয়, তদন্তকারী সংস্থার প্রতি অনাস্থা বলে মনে করেন। তাঁর বক্তব্য, "যে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে তদন্তই আসল। যথাযথ তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে আদালতে হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। অভিযুক্তকেও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ দিতে হবে। পুলিশের গুলিতে মৃত্যু কাম্য নয়।" আদালতে মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ মেনে নেন তিনি। বিকাশরঞ্জনের বক্তব্য, "বিচারক সংখ্যা বাড়াতে হবে। নারী সংক্রান্ত অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত কোর্ট তৈরি করা দরকার। কোর্ট তৈরির সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করতে হবে।"