1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কাফেলা ও এর ‘পণ্যরা'

২৫ মার্চ ২০২০

‘তোমার বিনতের দেশ কোথায়?'- লেবাননে এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রশ্ন৷ আরবিতে ‘বিনতে' মানে মেয়ে৷ তবে এখানে ঘরের কাজের মেয়ের কথা বলা হচ্ছে, যারা কিনা ‘কাফেলা' পদ্ধতিতে লেবাননে আসেন৷

https://p.dw.com/p/3Zzs4
Äthiopische Hausangestellte im Libanon
ছবি: picture-alliance/AP Photo/G. Kassab

 এই পদ্ধতি বা পৃষ্ঠপোষকতার আওতায় প্রতি বছর হাজারো আফ্রিকা ও এশিয়ার নারী গৃহকর্মী লেবাননে যান৷ গ্রেস (ছদ্মনাম) তাদের একজন৷ পাঁচ বছর আগে উন্নত জীবনে আশায় লেবাননে আসেন তিনি৷ তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৮৷ নিজ দেশ টোগো অস্থিতিশীল থাকায় এবং নিয়োগকারীরা ভালো কাজের প্রতিশ্রুতি দেয়ায় তিনি গৃহস্থালী কর্মী হিসেবে বৈরুতে পাঠান৷ শুরুতে আশাবাদী ছিলেন গ্রেস৷ বেতন কম ছিল৷ তবে বাড়িতে যতটা টাকা পাঠাতে পারতেন তা নেহায়েত মন্দ ছিল না৷

কিন্তু শিগগিরই তার স্বপ্ন ধুসর পরিণত হতে থাকে৷ বাড়ির কর্তা তাকে মারধর করতে শুরু করেন৷ সেখানেও থেমে থাকেন না৷ গ্রেস দু:স্বপ্নের মত মনে করতে থাকেন, ‘‘আমাকে ধর্ষণ করতেন৷'' বলতে বলতে দূরে কোথাও তাকিয়ে থাকেন গ্রেস, চোয়াল শক্ত হয় তার৷

কর্তার নিষ্ঠুরতা আর অত্যাচারের মাত্রা যখন অনেক বেড়ে যায়, গ্রেস পালিয়ে যান৷ দুর্ভাগ্য তার পাসপোর্টটি রয়ে যায় সেই বাড়ির কর্তার কাছেই৷ সেই ব্যক্তি পাসপোর্ট পুলিশকে দিয়ে দিয়েছেন৷ সব দোষ গ্রেসের ওপর চাপিয়ে বলেছেন যে সে পালিয়ে গেছে৷ 

এখন আইনের চোখে গ্রেস একজন পলাতক৷ লেবাননে থাকার কোনো আইনি অধিকার নেই তার, আর সীমান্ত বন্ধ থাকায় বাইরেও বেরুতে পারছেন না৷ কর্তৃপক্ষের সহায়তা নিতে গেলে লেবাননের কোনো ভয়ঙ্কর জেলই হতে পারে তার পরিণতি, যেখানে গেলে হয়তো আর কখনো সূর্যের আলো দেখা হবে না৷

গ্রেসের মত এমন হাজারো অভিবাসী গৃহশ্রমিক লেবাননের কাফেলা স্পন্সরশিপ সিস্টেমের শিকার, যে সিস্টেমে শ্রমিকরা গৃহকর্তাদের কাছে জিম্মি৷ এমনকি গৃহকর্তার অনুমোদন ছাড়া তারা কাজ বদলাতে পারেন না কিংবা দেশ ছেড়ে যেতে পারেন না৷ 

লেবাননে বিপদে অভিবাসী শ্রমিকরা

সমস্যার গোড়া

কাফেলা সিস্টেমের আওতায় লেবাননে প্রায় আড়াই লাখ গৃহশ্রমিক কাজ করেন৷ বেশিরভাগ আসেন ইথিওপিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ফিলিপিন্স থেকে৷

উপসাগরীয় দেশগুলোতে এই পদ্ধতি শুরু হয় এবং লেবাননে চালু হয় গৃহযুদ্ধের পর৷ লেবাননে গৃহকর্মীর কাজ অনিয়ন্ত্রিত এবং শ্রম আইন দিয়ে এই শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত নয়৷ এ কারণে কর্তারা গৃহকর্মীদের সম্পত্তি মনে করেন৷ তাদের আইনগত ও অভিবাসন স্থিতি নিয়োগকর্তা বা স্পন্সরের হাতে জিম্মি হওয়ায় সুযোগ নেন এই কর্তারা৷

অত্যাচারের ঘটনা এতটাই হরহামেশা ঘটে যে, শেষ পর্যন্ত ইথিওপিয়া, নেপাল ও ফিলিপিন্স তাদের কর্মীদের আনুষ্ঠানিকভাবে লেবাননে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে৷ তবে লেবানিজ সরকার এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়নি৷ এমনকি লেবানিজ মিডিয়াও খুব বড় ঘটনা না ঘটে গেলে এ বিষয়ে মুখে কুলুপ দিয়ে বসে আছে৷

দক্ষিণ লেবাননে কাজ করেন সুদান থেকে আসা ফ্রান্সিস (ছদ্মনাম)৷ তিনি ঘানার এক গৃহকর্মীর সঙ্গে হয়ে যাওয়া ঘটনার বিবরণ দেন৷ বলেন যে, সেই গৃহকর্মীতে তিন বছর ধরে অত্যাচার করা হয় এবং কখনো পুরো বেতন দেয়া হত না৷ এ সময় স্থানীয় চার্চ থেকে একজন ব্যক্তি সেই গৃহকর্মীকে খাবার দিয়ে সহযোগিতা করতেন৷ তিনি ঐ কর্মীকে দেশে পাঠিয়ে দেবার ব্যাপারে বাড়ির কর্তাকে শেষ পর্যন্ত রাজি করাতে সক্ষম হন৷

ফ্রান্সিস কেনিয়ার আরেক গৃহকর্মীর ঘটনা বলেন৷ ঐ নারী ২০১৬ সালে লেবাননে আসেন এবং প্রতিনিয়ত গৃহকর্তার মারধরের শিকার হতে থাকেন৷ ঐ নারীকে এমনকি কোন শোবার জায়গা দেয়া হত না৷ রান্নাঘরে কোনমতে ঘুমাতেন৷ ‘‘কাফেলা সিস্টেম হল আধুনিক দাসপ্রথা,'' ফ্রান্সিস বলেন৷

এদিকে, গ্রেস ঘুরছেন ছায়া হয়ে৷ ‘‘আমি যদি পুলিশের সাথে কথা বলি, আমাকে গ্রেপ্তার করা হবে,'' বলেন তিনি৷ ‘‘আমার কোন ‘রেসিডেন্স পারমিট' নেই৷'' নেই কাজের অনুমতি৷ তাই বৈধভাবে কাজ করার আর কোন সুযোগ নেই৷ তিনি আপাতত চার পরিবারের ঘরদোর পরিষ্কার করেন এবং বৈরুতের বাইরে একটি অ্যাপার্টমেন্টে ভাগাভাগি করে থাকেন৷

লেবাননের নাগরিকত্ব আইনে অভিবাসীদের ছেলেমেয়েদের নাগরিকত্বের বিষয়টিও জটিল৷ কোন শিশু যদি লেবাননের মাটিতেও জন্মায়, সে তখনই নাগরিকত্ব পাবে যদি তার বাবা লেবাননের নাগরিক হন৷ তাই কোন অভিবাসী সন্তান জন্ম দিলে সবসময়ই এই ভয়ে থাকেন যে সন্তানটিকে সে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে৷

বিচারিক ব্যর্থতা

লেবাননে গৃহকর্মীদের ১০০টি ঘটনা বিশ্লেষণ করে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, লেবানিজ বিচারিক ব্যবস্থা এদের অধিকার সুরক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে৷ এমনকি সংস্থাগুলো নির্যাতনের অভিযোগগুলো ঠিকঠাক তদন্ত করছে না৷ 

নারী গৃহকর্মীদের অবস্থা সবচেয়ে গুরুতর৷ অনেককেই দিনের পর দিন গৃহকর্তার ঘরে অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে, প্রতিদিন ২০ ঘন্টা করে সপ্তাহে সাতদিনই কাজ করতে হচ্ছে৷ বেতন দেয়া হচ্ছে না৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব নারীদের ঘুমানোর জন্য আলাদা জায়গা নেই৷ তারা লিভিং রুম, রান্নাঘর বা বারান্দায় ঘুমান৷

লেবাননে গৃহকর্মীদের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মাত্রা বেশ ভয়াবহ৷ অনেক ক্ষেত্রে অত্যাচার এতটাই বেড়ে যায় যে তারা যে কোন উপায়ে সেই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন৷ কখনো কখনো বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়েন৷ ফলে আহত হন বা কোন কোন ক্ষেত্রে মারাও যান৷ এইচআরডাব্লিউর হিসেবে, লেবাননে সপ্তাহে একজন অভিবাসী গৃহকর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়৷ এসব মৃত্যুর প্রধান কারণ আত্মহত্যা বা পালিয়ে যাবার চেষ্টা৷ বাস্তবে এ সংখ্যা আরো বেশি বলে অনেকের ধারণা৷

‘‘লেবানিজ কর্তৃপক্ষ, কর্মীদের দূতাবাসগুলো, নিয়োগকারী এজেন্সি ও নিয়োগকর্তা সবাইকে নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে যে কেন এই নারীরা আত্মহত্যা করছেন বা উঁচু দালান থেকে পালাতে গিয়ে জীবন বিপন্ন করছেন,'' বলেন এইচআরডাব্লিউর গবেষক নাদিম হাউরি৷

সবচেয়ে করুণ পরিণতি হল, যেসব গৃহকর্মীরা পালাতে সক্ষম হন, তারা পুলিশের হাতে আটক হন এবং পুলিশ জোরপূর্বক আবার গৃহকর্তার কাছে দিয়ে যান৷ আবার শুরু হয় নির্যাতন৷ 

অভিবাসী কর্মীদের ক্ষুদ্র বিজয়

অভিবাসী গৃহশ্রমিকদের করুণ অবস্থা দেখে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে কতগুলো বেসরকারি সংস্থা৷ এতে কিছুটা কাজ হয়েছে৷ কয়েক বছর আগে তেমনই একটি বিরল ঘটনা ঘটেছে৷ এক গৃহকর্মী পাসপোর্ট আটকে রাখায় গৃহকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন৷ গৃহকর্তার যুক্তি ছিল, ঐ নারী তার কাজের মেয়াদ শেষ করেননি৷ তবে বিচারক শেষ পর্যন্ত ঐ নারীর পক্ষে রায় দেন এই যুক্তিতে যে, ঐ গৃহকর্তা গৃহকর্মীর চলাফেরার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছেন৷

লেবানন অবশেষে অভিবাসী গৃহকর্মী ও গৃহকর্তাদের মধ্যে একটি সাধারণ চুক্তির নিয়ম করেছে বলে জানালেন অ্যান্টি-রেসিজম মুভমেন্ট (এআরএম) নামের একটি এনজিওর কর্মকর্তা রামি শুকার৷ ‘‘কিন্তু খুব কম গৃহকর্তা ও অভিবাসী এই চুক্তি পড়ে দেখেন৷ এছাড়া এই চুক্তি অভিবাসীদের ভাষায় লেখা হয় না,'' জানান তিনি৷

এআরএম লেবাননজুড়ে বেশ ক'টি মাইগ্র্যান্ট কমিউনিটি সেন্টার তৈরি করেছে৷ সেখানে তারা অভিবাসীদের আইনি অধিকার ও নিরাপত্তা কর্মশালার পাশাপাশি কম্পিউটার শিক্ষা, আরবি, ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা দেন৷

‘‘আমরা মনে করি, অভিবাসীসহ সবার রাজনৈতিক অধিকার থাকা উচিত,'' শুকার বলেন৷ সাধারণ মানুষ এখন এই গৃহকর্মীদের দুর্দশার খবর আগের চেয়ে বেশি জানেন৷

এদিকে, গৃহকর্মীরাও আর আগের মত লেবানিজ সরকারের মুখাপেক্ষি হয়ে কিংবা কাফেলা সিস্টেম বন্ধ করা অথবা তাদের কাজকে শ্রম আইনের আনার জন্য অপেক্ষায় বসে নেই৷ তারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার৷ তারা নিজেদের জন্য নিজেরাই আওয়াজ তুলছেন এবং নিয়মিত সভা সমাবেশ করে অধিকারের দাবি তুলছেন৷

অঁতোয়ান আবু-দিওয়ান/জেডএ (গ্যোয়েটে ইন্সটিটিউট)

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য