কান উৎসবে কান পেতে শুনি যুদ্ধের প্রতিধ্বনি
কান চলচ্চিত্র উৎসবের জৌলুস লালগালিচা হলেও কেন্দ্রবিন্দুতে আছে নীল-হলুদ রঙ। দক্ষিণ ফ্রান্সে সাগরপাড়ের শহরে কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৫তম আসরের পুরোটা জুড়ে ইউক্রেন যুদ্ধের আবহ। ইউক্রেনীয়দের প্রতি সংহতি জানিয়েছে উৎসব কর্তৃপক্ষ।
ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ান
রাশিয়ার আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত ইউক্রেনের জনগণের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে কান উৎসবের আয়োজকরা এবার পুতিন সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফিল্ম প্রফেশনালদের নিষিদ্ধ করেছে। এছাড়া রাশিয়ার অনেক সাংবাদিককে এবার অ্যাক্রেডিটেশন দেওয়া হয়নি।
জেলেনস্কির ভাষণ
গত ১৭ মে রাতে কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৫তম আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কিয়েভ থেকে লাইভ ভিডিও কলে ভাষণ দেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সরব হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ভূমধ্যসাগরের তীরে পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান তাকে।
মেয়র কার্যালয়ের সামনে ইউক্রেনের পতাকা
কান টাউন হলের মূল ফটকের বিপরীত পাশে উড়ছে ইউক্রেনের নীল-হলুদ পতাকা। এখানেই কান শহরের মেয়র ডেভিড লিসনার্ডের কার্যালয়। ১৮৭৬ সালে স্থাপিত এই ভবন থেকে পৌরসভার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কানের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ইউক্রেনের পতাকা উত্তোলন করায় আলাদা তাৎপর্য বহন করছে।
‘স্টপ দ্য ওয়ার’
কান চলচ্চিত্র উৎসবের বাণিজ্যিক শাখা মার্শে দ্যু ফিল্ম ভবনের ইনফরমেশন ডেস্কে সেবা দিয়ে থাকেন আয়োজকদের কর্মীরা। তাদেরই একজন ইশ কুপার। উৎসব কর্তৃপক্ষের দেওয়া ব্যাজের সঙ্গে ‘স্টপ দ্য ওয়ার’ লেখা ব্যাজও পরেছেন এই বৃদ্ধা। তিনি ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘‘কান উৎসব শান্তির কথা বলে। আমার চাওয়া, ইউক্রেনের জনগণ আবারও নিজ দেশে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।’’
ইউক্রেন প্যাভিলিয়ন
কানসৈকতে মার্শে দ্যু ফিল্মের অংশ হিসেবে ১১১ নম্বরে রয়েছে ইউক্রেনের প্যাভিলিয়ন। এর মাধ্যমে ইউক্রেনিয়ান স্টেট ফিল্ম এজেন্সি যুদ্ধের বিরুদ্ধ সময়ে নিজ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে সহায়তা প্রদানে বিশেষ চ্যারিটি চালু করেছে। নতুন ছবি তৈরিতে নির্মাতাদের সহযোগিতা করা, অসম্পূর্ণ থাকা চলচ্চিত্রের কাজ শেষ করতে সহায়তা প্রদান এবং ইউক্রেনিয়ান চলচ্চিত্রের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চ্যারিটিতে প্রাপ্ত অনুদান ব্যয় করা হবে।
তহবিল সংগ্রহ
ইউক্রেন প্যাভিলিয়নে বিক্রি হচ্ছে নীল ও কালো রঙের টি-শার্ট। নীল রঙের টি-শার্টে লেখা ‘বি ব্রেভ’, কালো রঙের টি-শার্টে রয়েছে ‘স্ট্যান্ড উইথ ইউক্রেন’ বার্তা। এছাড়া যুদ্ধের এক মাসে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির দেওয়া বিভিন্ন বক্তৃতা ও ভাষণ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘ইউক্রেন অ্যাফ্লেম’ নামের একটি গ্রন্থ। এগুলো বিক্রির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা হচ্ছে।
‘আমাদের ধর্ষণ করা থামান’
ইউক্রেনে রুশ সেনাদের যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে লালগালিচায় অভিনব প্রতিবাদে তোলপাড় সৃষ্টি করেছেন এক নারী। নগ্ন শরীরে মেখেছিলেন ইউক্রেনের জাতীয় পতাকার নীল ও হলুদ রঙ। তাতে লেখা ছিল, ‘স্টপ রেপিং আস (আমাদের ধর্ষণ করা থামান)।’ ২০ মে সন্ধ্যায় এই ঘটনার সাক্ষী হলো কান। স্কাম নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত অজ্ঞাত ওই নারী চিৎকার করে আলোকচিত্রীদের সামনে পোজ দেন। পরে তাকে কাপড়ে ঢেকে বের করে দেয় নিরাপত্তারক্ষীরা।
স্বর্ণপামের দৌড়ে
অর্থ আত্মসাৎ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে রাশিয়ায় কয়েক বছর গৃহবন্দি ছিলেন পরিচালক কিরিল সেরেব্রেনিকভ। এখন জার্মানির বার্লিনে নির্বাসন বেছে নিয়েছেন। তার নতুন ছবি ‘‘চাইকস্কি’স ওয়াইফ’’ মূল প্রতিযোগিতা শাখায় স্বর্ণপামের দৌড়ে আছে। এর গল্প বিখ্যাত সুরস্রষ্টা চাইকস্কিকে কেন্দ্র করে৷ নিজের সমকামিতা লুকাতে এক তরুণীকে বিয়ে করেন তিনি। কিরিল ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের বিরোধিতা করলেও আয়োজকদের সমালোচনা করেছেন অনেকে।
রাশিয়াপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে বন্দি নারীসৈনিক
ইউক্রেনের এক নারীসৈনিককে নিয়ে তৈরি ‘বাটারফ্লাই ভিশন’ স্থান পেয়েছে আঁ সাঁর্তে রিগায়৷ পূর্ব ডনবাসে রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে বন্দি হন তিনি। ২৫ মে পালে ছবিটির প্রদর্শনী শুরুর কালো ব্যানারে প্রতিবাদে লেখা ছিল, ‘রুশরা ইউক্রেনীয়দের হত্যা করছে। আপনি কি এই গণহত্যা সম্পর্কে কথা বলা আপত্তিকর ও বিরক্তিকর বলে মনে করেন?’ ছবি সংশ্লিষ্ট বাকিরা নিজেদের মুখের সামনে ধরে রাখেন, ‘সেনসিটিভ কন্টেন্ট’ লেখা কাগজ।
ইউক্রেনীয় তরুণীর পুরস্কার জয়
শিক্ষার্থী নির্মাতাদের শাখা সিনেফঁদাসোতে পুরস্কার পেয়েছে ইউক্রেনের তরুণী মাশা নোভিকাভার ‘গ্লোরিয়াস রেভোল্যুশন’। ২০ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিটি পেয়েছে তৃতীয় পুরস্কার। ছবির গল্পে দেখা যায়, ২০১৪ সালে ইউক্রেন বিপ্লবের উত্তাল সময়ে একজন মা সন্তানকে হারান। ইন্ডিপেন্ডেন্স স্কয়ারে বিক্ষোভের সময় নিহত হয় ছেলেটি। সন্তানকে বীর হিসেবে সমাধি দিতে মায়ের প্রচেষ্টায় বাধা হয় দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
প্যারালাল শাখায় ইউক্রেন
কান উৎসবের প্যারালাল শাখা ডিরেক্টর’স ফোর্টনাইটে নির্বাচিত পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির তালিকায় রয়েছে ইউক্রেনের দিমিত্রা সুকালিতকি-সোবচুক পরিচালিত ‘পামফির’। এর গল্পে চলমান রুশ-ইউক্রেন সংঘাতের অনুরণন রয়েছে। কানসৈকত ঘেঁষে জেডব্লিউ ম্যারিয়ট হোটেলের থিয়েটার ক্রজেটে গত ২১ মে সকালে ছবিটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়।
ইউক্রেনীয় তরুণের স্বপ্ন
ইউক্রেনের তরুণ নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার রোমান সাদোভস্কি স্বপ্ন দেখেন ছবি বানাবেন। তাই কানের মার্শে দ্যু ফিল্মে এসেছেন তিনি। কানসৈকতে কারও সঙ্গে কথা হলেই ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছেন এই তরুণ। রাশিয়ার আক্রমণে তার পরিবার এখন ছন্নছাড়া। তিনি জানালেন, যুদ্ধের প্রতিকূলতার মধ্যেও ইউক্রেনে মুক্ত ছবির নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মাণ অব্যাহত রেখেছেন।
‘আমরা অবশ্যই জিতবো’
ইউক্রেনিয়ান ফিল্ম কমিশনের সদস্য হিসেবে প্রথমবার কান উৎসবে এসেছেন মারিয়ানা সরোচুক। তাকে এখন নিরাপদে স্পেনে রাখা হয়েছে। তবে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরত্বে লুস্ক নামক জায়গায় তার পরিবারের দিন কাটছে শঙ্কায়। রাশিয়া কি এই যুদ্ধ থামাবে? প্রশ্নটা করার পর মারিয়ানা ডয়েচে ভেলেকে গর্ব নিয়ে বলেছেন, ‘‘আমাদের আশা, আমরাই জিতবো। যুদ্ধের শেষটায় থাকবে আমাদের জয়।’’