কলকাতায় পোষা প্রাণীর জমজমাট হাট
নানা ধরনের প্রাণী পুষতে অনেকেই ভালোবাসেন৷ রঙিন মাছ, কুকুর, খরগোশ বা বিভিন্ন ধরনের পাখি নিয়ে অন্যরকম এক শখের জগত রয়েছে তাদের৷ উত্তর কলকাতার গ্যালিফ স্ট্রিটের হাট পোষ্যপ্রেমীদের কাছে স্বর্গ৷
শখের হাট
উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে বিটি রোডের দিকে কিছুটা গেলে বাঁদিকে সার্কুলার ক্যানালের ঠিক পাশের সরু রাস্তাটাই হলো গ্যালিফ স্ট্রিট৷ এখানে সাপ্তাহিক পশু-পাখির হাটে প্রতি রবিবারই অসংখ্য মানুষ গাছ, মাছ, পশু পাখির কিনতে হাজির হন৷ এটিই কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো ও বৃহৎ পোষ্য বাজার৷
রঙিন মাছের জলসা
ইদানীং রঙিন মাছ চাষ একটি লাভজনক ব্যবসা৷ অ্যাকুরিয়ামের রঙিন মাছের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে শৌখিন ক্রেতাদের৷গাপ্পি, অ্যাঞ্জেল, গোল্ড ফিশ, মলি, চিকলেট গ্রপ, ডিসকাস, প্যারোট, শার্কের মতো রঙিন মাছ সুলভে মেলে এই হাটে৷
দূরদূরান্ত থেকে আসেন ক্রেতারা
খড়দহ, ব্যান্ডেল, বারাসাত প্রভৃতি নানা স্থান থেকে মাছ ও পশু-পাখি ব্যবসায়ীরা আসেন এখানে৷ আগে কলকাতার হাতিবাগানে পাখির হাট বসত৷ ভিড় সামাল দিতে ১৯৯৬ সাল থেকে মেলা বসে বাগবাজারের গ্যালিফ স্ট্রিটে৷ তাই এর নাম বাগবাজারের শখের হাট৷
লকডাউনে ক্ষতি
লকডাউনে হাট বন্ধ থাকায় অনেকের রোজগারে টান পড়ে৷ সেই ধাক্কা সামলে ফের প্রতি রবিবার হাট বসছে৷ কোনো কোনো সপ্তাহে ৪০-৫০ হাজার মানুষেরও ভিড় হয়৷ মাছ, উদ্ভিদ, পশুপাখির পাশাপাশি মাছের অ্যাকুরিয়াম, পাখির খাঁচা বিক্রি করেও বেশ কয়েকজন বিক্রেতা গ্রাসাচ্ছাদন করেন৷ পাখি ও মাছের খাবারের সঙ্গে রয়েছে গাছের সারও৷
খরগোশ, ইঁদুর নাকি গিনিপিগ
লকডাউনের পর এই হাটে পাখি, কুকুর, খরগোশ, রঙিন মাছ বিক্রি শুরু হয়েছে৷ রঙিন খরগোশের জোড়ার দাম ২৫০ টাকা৷ সাদা খরগোশ জোড়ার দাম ২০০ টাকা৷ হ্যাম্পস্টার ইঁদুরের দাম ২০০ টাকা জোড়া৷ এদিকে জোড়া গিনিপিগের দাম মাত্র ১০০ টাকা৷
শখের কবুতর
কলকাতার বাবু সমাজের এককালে পায়রা পোষার শখ ছিল৷ তবে অনেক মধ্যবিত্ত এখনও পায়রা পোষেন৷ লক্কা পায়রার দাম জোড়া ১,২০০ টাকার কাছাকাছি৷ সিরাজ পায়রার দাম জোড়া ২,৫০০ টাকা৷ কেনার আগে পায়রার নখ থেকে পালক পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখে নেন ক্রেতারা৷
যারে উড়ে যারে পাখি
হাটে সব থেকে বেশি মানুষ আসেন পাখির খোঁজে৷ হরেক রকম পাখির ভিড় হাটে৷ বদরি পাখির দাম প্রায় ৩০০-৩৫০ টাকা জোড়া৷ জাভা স্প্যারো জোড়ার দাম মাত্র ১২০ টাকা৷ কাকাতুয়া বা টিয়াও রয়েছে হাতের নাগালেই৷ খাঁচায় পাখি ভরে ও তার খাবার কিনে তবে বাড়ি ফেরেন ক্রেতারা৷ হাটের হাঁকডাকের পাশাপাশি পাখির কিচিরমিচির, সবমিলে এ এক অন্য অভিজ্ঞতা৷
রয়েছে হাঁস-মুরগিও
হাঁস, মুরগির ছানাও এই বাজারে খুঁজলে পেয়ে যাবেন ক্রেতারা৷ মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, হাসনাবাদ থেকে কলকাতা শহরে বিক্রেতারা সে সব নিয়ে আসেন৷ ইদানীং টার্কির চল প্রচুর, তাই হাটে সেটিও আছে৷ টার্কি দেখতে অনেকটা মুরগির মতো, কিন্তু আকারে বড়৷ বড় বড় বনমোরগের পাশে দেখা মিলেছিল টার্কির৷ দাম প্রায় ৬০০ টাকা জোড়া৷
শখের বাগান
চোখজুড়ানো সবুজ বাগান চাইলে আসতেই হবে এই হাটে৷ ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, জবা, হরেক রকমের গোলাপ, শৌখিন বাঁশ, আম চারা, ক্যাকটাস, বনসাই— কী নেই এখানে৷ সবজির বীজ বা চারা চাই? শিম, বেগুন, ফুলকপি ফলাতে হলে এই হাটে আসতেই হবে৷
সমান তালে নারী
কুকুরের সঙ্গে মানুষের চিরকালীন বন্ধুত্ব৷ তাই তাদের যত্নআত্তিই আলাদা৷ ঘুরতে ঘুরতে নজরে পড়ে, নারী বিক্রেতারা চিরুনি দিয়ে কুকুরের লোম আঁচড়ে দিচ্ছেন খুব যত্ন নিয়ে৷ স্পিৎজের দাম পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা৷ ল্যাব্রাডরের দাম ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে৷ এ ছাড়াও হাটে রয়েছে অভিজাত ডোবারম্যান, ডালমেশিয়ান, লাসা, গোল্ডেন রিট্রিভার৷
প্রিয় পোষ্য..
কুকুরগুলির কোনো হাঁকডাক নেই৷ মালিকের কোলে উঠে কিংবা গুটিগুটি পায়ে রওনা দিচ্ছে নতুন ঠিকানার দিকে৷ এই পোষ্যের নতুন মালিক ইন্দ্রাণী বিশ্বাস বললেন, ‘‘পোষ্য কেনা শুধু দরদামের ব্যাপার নয়৷ সমঝদার হতে হবে, নইলে রয়েছে ঠকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷’’
কে এই গ্যালিফ?
গ্যালিফ নাম কোথা থেকে এলো? ইংরেজ আমলে কলকাতার কর সংগ্রহকারী ছিলেন এই গ্যালিফ সাহেব৷ তার নামেই এই রাস্তা৷ তবে এখন এই রাস্তার খ্যাতি এই হাটের সৌজন্যে৷ রোববার ভোর ছয়টা থেকে ক্রেতারা আসতে শুরু করেন এই হাটে৷ দশটার পর ভিড়ে পা ফেলার জায়গা থাকে না৷ বিকেল তিনটে পর্যন্ত এই হাটে বেচাকেনা চলে৷
রয়েছে কড়া আইন
ভারতের বন্যপ্রাণ আইন, ১৯৭২ অনুযায়ী, বেশ কিছু পাখি সংরক্ষণের আওতায় পড়ে৷ সেগুলি কেনাবেচা ভারতে আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ তাই এই হাটে পেঁচা, কোয়েল, বুলবুলির মতো পাখি বিক্রি একেবারে নিষিদ্ধ৷ বন দপ্তরের বোর্ডে সেই ঘোষণার কথাও জ্বলজ্বল করছে৷এমন কোনো বেআইনি বিক্রিবাটায় যুক্ত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাত বছরের জেল ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে৷