1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কলকাতার চোখে মারাদোনা অমর

গৌতম হোড়
২৭ নভেম্বর ২০২০

কলকাতায় মারাদোনা এসেছেন দুই বার৷ আর কলকাতাও হৃদয় দিয়েছে তাঁকে৷ আবেগে ও ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরেছে ফুটবলের ঈশ্বরকে৷

https://p.dw.com/p/3luYd
ডিয়েগো ম্যারাডোনা
২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বারাসত আদিত্য ফুটবল একাডেমিতে ডিয়েগো ম্যারাডোনাছবি: picture-alliance/ZUMA PRESS/S. Saha

ওই ছবিটাই তো বলে দিচ্ছে সব৷ সল্টলেক স্টেডিয়ামে লক্ষাধিক মানুষ আবেগে ভাসছেন, গর্জন করে স্বাগত জানাচ্ছেন তাঁকে৷ প্রত্যুত্তরে একটি গাড়ির উপর চড়ে একইরকম আবেগে উতরোল হয়ে মারাদোনা সমানে বুক বাজিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন, আমিই সেই৷ ফুটবলের ঈশ্বর৷ একশ কোটির দেশের প্রতিভূ হয়ে এক লাখ মানুষের পাগলপারা ভালোবাসা আমি নিলাম৷ হে কলকাতা, একটা কুর্নিশ রইল তোমার জন্য৷

তার এগারো বছর আগে খেলা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি৷ কলকাতায় তিনি পেলের মতো খেলতে আসেননি৷ জার্সি পরে মাঠে নামেননি৷ তাতে কী আসে যায়? পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির এক চলমান ইতিহাস, কিংবদন্তীর সঙ্গে তো কতদিন ধরেই একাত্ম কলকাতা৷ মারাদোনা তো কলকাতার কাছে শুধু এক ফুটবল ঈশ্বর নন, তার থেকেও অনেক বেশি কিছু৷ কলকাতার মাঠে মারাদোনা মানে লড়াই, মারাদোনা মানে বিপক্ষের আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে জেতা, মারাদোনা মানে এক দুর্জয় সাহস ও প্রতিভার নাম, যে প্রতি মুহূর্তে শেখায়, প্রতিভাবানদের অভিধানে অসম্ভব বলে কোনো শব্দ নেই৷ নিজের জগতে প্রতিটি মুহূর্তে সে নিজেকেই অতিক্রম করে যায়৷ মারাদোনা যেমন ফুটবল মাঠে প্রতিদিন নিজেকে অতিক্রম করে গিয়েছেন৷ তাই তো মাঝরাতে তিনি যখন প্রথমবার কলকাতায় পা রাখলেন, তখন তাঁকে স্বাগত জানাতে হাজির হয়েছিলেন হাজারো মানুষ৷ যা দেখে তাঁর মনে পড়ে গিয়েছিল ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর নাপোলির রাত৷

এই লড়াই তো কলকাতার মজ্জাগত! তিনশো বছরের কিছু বেশিদিনের ইতিহাসে এমন অনেক লড়াই লড়েছে কলকাতা এবং সিটি অফ জয়ের মানুষ৷ তাই তো মারাদোনাকে সে বুক পেতে নেয়৷ মারাদোনার জন্য সে প্রতিনিয়ত পাগলামি করে৷ ১৯৮২-র বিশ্বকাপ দেখে সেই যে মারাদোনার প্রেমে পড়ে যায় কলকাতা, তা আর কখনো ফিকে হয়নি৷ তারপর বিশ্বকাপ এলেই কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হয়েছে মারাদোনার ছবি সাজিয়ে তাতে ফুল-মালা দেওয়ার রেওয়াজ৷ রাস্তায় ঝুলিয়ে দেয়া অর্জেন্টিনার সাদা নীল পতাকা৷ তৈরি করা সাদা নীল গেট৷ দেওয়ালে মারাদোনার ছবি৷ প্রত্যেক ভক্তের পিঠে ১০৷ কালো হরফে 'মারাদোনা'৷ ব্রাজিলে ডুবে থাকা কলকাতাকে তো সাদা-নীল চেনালেন ওই ঈশ্বরই!

মারাদোনা যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন তাঁর জন্য বিশেষভাবে সাজানো হয়েছিল একটি বাস৷ গোটা বাসের গা জুড়ে তাঁর নাম সময়ের ছবি৷ ওই বাসে চড়েই হোটেল থেকে যুবভারতী গিয়েছিলেন তিনি৷ তিনি চলে যাওয়ার পর বাসটিকে রুটের আর পাঁচটি বাসের সঙ্গে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ দশ নম্বর জার্সি লকারে তুলে রাখা বহু ভক্ত অপেক্ষা করে থাকতেন কেবল ওই বাসটির জন্য৷ বাসের হ্যান্ডেল ছুঁয়েও শিহরিত হয়েছেন তাঁরা৷ যেন মারাদোনার স্পর্শ লেগে আছে তাতে৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

মারাদোনাও তো এমনই৷ উষ্ণ৷ লোককে বুকে টেনে নেন৷ লোক দেখানোর জন্য নয়৷ নিছক সৌজন্যর জন্য নাটক নয়৷ হৃদয়ের আবেগ থেকেই কাছে টেনে নিতেন মানুষকে৷ এক গরিব পরিবার থেকে উঠে আসা ফুটবল সম্রাট কখনো ভোলেননি তাঁর বেড়ে ওঠা, তাঁর ছেলেবেলার সঙ্গী বস্তির ছেলেগুলোকে৷ সফিস্টিকেশনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পেরেছেন তিনি৷ জড়িয়েছেন বিতর্কেও৷ 

কলকাতায় মারাদোনা এসেছিলেন দুই বার৷ ২০০৮ ও ২০১৭-তে৷ দুই বারই তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন ফুটবলার প্রসূন বন্দ্যোপধ্যায়৷ ভারতের সাবেক ফুটবল ক্যাপ্টেন৷ বর্তমানে তৃণমূলের সাংসদ৷ তিনি ভারতের ক্যাপ্টেন ছিলেন শুনে প্রসূনের দিকে বল ছুড়ে দেন মারাদোনা৷ প্রসূন তা বুক দিয়ে পায়ে নামিয়ে নাচাতে থাকেন৷ আর মারাদোনা গুণতে শুরু করেন, ওয়ান, টু... টেন... ফিফটি৷ একশো হওয়ার পর প্রসূন বল পাঠিয়ে দেন মারাদোনার দিকে৷ আর মোরাদোনা জড়িয়ে ধরেন তাঁকে৷ এতদিন পরে সেই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে শিহরিত হচ্ছিল প্রসূনের গলা৷ বলছিলেন, ''ফুটবলের মানচিত্রে আমরা কোথায় আর মারাদোনা কোথায়? অথচ, কী অনায়াসে তিনি জড়িয়ে ধরতে পারেন আমাদের৷ আমি পেলের সঙ্গে খেলেছি, আরো বড় ফুটবলারদের সঙ্গে দেখা হয়েছে বিদেশে৷ তাঁরা ফর্মাল৷ কিন্তু মারাদোনার মধ্যে কোনো ফর্মালিটি ছিল না৷ তিনি ছিলেন খুব সরল, দরদী এবং প্রাণখোলা মানুষ৷ একেবারে সাধারণ মানুষের মতো৷ ''

কলকাতায় মারাদোনার ছোট্ট দুটি পায়ের কাজ চোখের সামনে ভাসছে প্রসূনের৷ হোটেলে খাবার প্লেট হাতে খেতে খেতে পায়ে বল নাচিয়ে যাচ্ছেন অবলীলায়৷ বল একবারের জন্যও মাটি ছুঁতে পারছে না৷ দেখে মনে হয়েছিল, এ মারাদোনার পক্ষেই সম্ভব৷ বারাসতের কাছে একটি স্কুলে গিয়ে একটা ইনসুইং শট মেরেছিলেন৷ থ্রো লাইন ধরে বল ঘুরতে শুরু করেছিল৷ এখনো চোখ বন্ধ করলে সেই শট চোখে ভাসে প্রসূনের৷

এই মারাদোনাকে পুজো করে কলকাতা৷ যবে থেকে টিভি এসেছে, বিশ্বকাপ ফুটবল ঘরে ঢুকে পড়েছে, তবে থেকেই মারাদোনার অপেক্ষায় রাত জেগেছে কলকাতা৷ সেই ঈশ্বর কলকাতায় এসে মাদার টেরিজার আশ্রমে গেছেন৷ মোহনবাগান মাঠে গিয়ে পাঁচটা বল উড়িয়ে দিয়েছেন গ্যালারিতে৷ গেছেন স্কুলে, ফুটবল অ্যাকাডেমিতে৷  কলকাতায় ফিদেল কাস্ত্রোর বয়সী এক বাম নেতা আছেন জেনে দেখা করেছেন জ্যোতি বসুর সঙ্গে৷ ১০ মিনিটের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে এক ঘণ্টা ধরে কথা বলেছেন৷  শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির শহর ফুটবলের অন্যতম শিল্পীকে গ্রহণ করেছে, চেটেপুটে নিয়েছে সর্বস্ব দিয়ে৷

কলকাতার কাছে মারাদোনা নিজের লোক৷ লক্ষ মানুষের গর্জনের মধ্যে মুকুটহীন যে সম্রাট বুক বাজিয়ে বলেই চলেছেন, 'আমিই সেই৷ ফুটবলের ঈশ্বর'৷ মারাদোনাকে নিয়ে কলকাতার আবেগ কতটা তা বন্ধু দেবাশিসের একটf লাইন থেকেই পরিষ্কার-- মারাদোনা এতদিন বেঁচে ছিলেন প্রবলভাবে, এ বার অমরত্বের পর্ব শুরু হলো৷ কলকাতার কাছে তিনি অমর৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য