কলকাতা: বিপ্লবের আঁতুরঘর
কলকাতার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি৷ ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবের আঁতুড়ঘর ছিল বাংলা৷ এই শহরেই স্বাধীনতার মুহূর্তে অনশনে বসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী৷ ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সাত দশক পেরিয়ে নজর ইতিহাসের আলো-আঁধারিতে৷
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়
১৯০২ সালে ব্রিটিশ ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে অনুশীলন সমিতি৷ পি মিত্র, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, অরবিন্দ ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল সকলেই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ এখানে শরীরচর্চা, অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ হতো৷ প্রকাশিত হত সাপ্তাহিক ‘যুগান্তর’৷
৩২ নং মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়ি
সশস্ত্র বিপ্লবীদের এই মূল আখড়াতে পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে বোমা তৈরির মালমশলা উদ্ধার করে৷ গ্রেপ্তার করা হয় অরবিন্দ ও বারীন ঘোষ সহ একাধিক বিপ্লবীকে৷ শুরু হয় ঐতিহাসিক আলিপুর বোমার মামলা৷ আজ সেই বাগানবাড়ি নেই, তবে বোমার মাঠ টিকে আছে৷ প্রোমোটারের হাত থেকে এই মাঠ রক্ষায় চলছে আন্দোলন৷
আদালতে
আলিপুর বোমার মামলা ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়৷ এই মামলায় ৩৭ জনের বেশি সন্দেহভাজনের বিচার হয়েছিল আলিপুর জাজেস কোর্টে৷ মৃত্যুদণ্ড, দ্বীপান্তর এবং যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা দেওয়া হয় বিপ্লবীদের৷
বিচারকের এজলাসে
বিচারপতি চার্লস বিচক্রফ্টের এজলাসে ১২১, ১২২, ১২২-এ, ১২৩ ধারায় চলেছিল আলিপুর বোমার মামলা৷ এখানেই অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো প্রমুখের বিচার চলেছিল৷ সে সব স্মৃতি নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে গড়ে উঠেছে সংগ্রহশালা৷
কাঠগড়ায় যখন অরবিন্দ
এই কাঠগড়াতেই অপরাধীর ভূমিকায় ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ৷ এজলাসে সাক্ষীর কাঠগড়া, সেকেলে সিলিং ফ্যান, বিচারকের চেয়ার, টাইপরাইটার আজও রয়েছে৷ এই কক্ষেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ অরবিন্দের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন৷ বিচারে অরবিন্দ মুক্তি পান৷
আলিপুর জেলে ফাঁসির মঞ্চ
এই জেলে বন্দি রাখা হত বিপ্লবীদের৷ আলিপুর বোমা মামলায় বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে এখানেই হত্যা করেন কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন বসু৷ ১৯০৮ সালে এখানেই তাঁদের ফাঁসি হয়৷ এই জেলে অরবিন্দ ঘোষের ভাগবৎ দর্শন ঘটে৷ নেতাজি থেকে বিধানচন্দ্র রায় এই কারাগারে বন্দি ছিলেন৷
শক্তির আরাধনায় বিপ্লবীরা
শক্তিরূপে দেবীর আরাধনার মধ্যে দিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী যুবশক্তিকে সংগঠিত করার প্রয়াসে একসময় দুর্গাপুজোর সূত্রপাত হয়েছিল কলকাতায়৷ ১৯২৬ সালে বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসুর হাত ধরে শুরু হয় সিমলা ব্যায়াম সমিতির দুর্গোৎসব৷ এখানেও ছিল বিপ্লবীদের শরীরচর্চার আখড়া৷
প্রাণ হলো বলিদান...
১৯৩০ সালের রাইটার্স বিল্ডিং বা মহাকরণে বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্তের অভিযানে মারা পড়েন কুখ্যাত পুলিশকর্তা সিম্পসন৷ তারপর এই ভবনের অলিন্দেই ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে তাঁদের গুলির লড়াই হয়৷ তিন বিপ্লবীর স্মরণে এই এলাকার নাম বিবাদী বাগ৷
পুলিশের জাদুঘর
সুকিয়া স্ট্রিটের কাছে এই ভবন ছিল রাজা রামমোহন রায়ের৷ সেখানেই তৈরি হয়েছে কলকাতা পুলিশ মিউজিয়াম৷ কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য ব্যবহৃত বোমা, আলিপুর বোমা মামলার নথি থেকে বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাস বা দীনেশ মজুমদারের পিস্তল রয়েছে এই সংগ্রহশালায়৷
বেলেঘাটায় গান্ধী
কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা থামাতে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী৷ বেলেঘাটার হায়দারি মঞ্জিলে ছিলেন ১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর৷ এখানেই গড়ে উঠেছে গান্ধী ভবন৷
স্বাধীনতার মুহূর্তে
দাঙ্গা থামাতে হায়দারি মঞ্জিলে গান্ধীজি অনশন করেন৷ তাতে থেমেছিল রক্তপাত৷ ৪ সেপ্টেম্বর দাঙ্গাবাজেরা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয় বাপুর কাছে৷ দুই সম্প্রদায়ের তরফে দেওয়া হয়েছিল শান্তির লিখিত প্রতিশ্রুতিও৷
স্বাধীনতা এলো
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বদেশিয়ানার প্রতীক ছিল গান্ধীর চরকা৷ সাত দশক আগে বাপুর ব্যবহৃত চরকা গান্ধী ভবন সংগ্রহশালার আকর্ষণ৷
জীবন যখন বাণী
১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট এই ঘরে বাপু অনশনে বসেছিলেন৷ এখানেই করতেন প্রার্থনা৷ বিশিষ্ট এই ভবনে এসেছেন দিকপাল ব্যক্তিত্বরা৷ তবুও কলকাতার পর্যটন মানচিত্রে ব্রাত্য গান্ধী ভবন৷
হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস
উত্তর কলকাতার এই বাড়িটি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের৷ অথচ সংরক্ষণের অভাবে স্বাধীনতার এমন বহু স্মারক হারিয়ে যেতে বসেছে৷