কর্তব্য আর দায়িত্বের টানাপড়েন
৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯২০১৮ সালে ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের ছোট ছবিতে দেখা গেছে তাঁকে৷ কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক কনস্টেবল অরূপ মুখার্জি৷ পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় নিজের গ্রামে পুঞ্চা–তে শবর সম্প্রদায়ের ছেলে–মেয়েদের পড়াশোনা শেখানোর সংকল্প নিয়েছেন যিনি৷ পদবিতেই বোঝা যায়, অরূপ ব্রাহ্মণসন্তান৷ তথাকথিত ‘উঁচু জাত'৷ কিন্তু আদিবাসী অধ্যুষিত জেলা পুরুলিয়ার যে অঞ্চলে তাঁর বাস, সেটা শবরপ্রধান৷ যে শবর এবং লোধাদের অপরাধী সম্প্রদায় হিসেবে দেগে দিয়েছে সমাজ৷ এখনও অনেকের নিশ্চিত মনে আছে চুনী কোটালের কথা৷ লোধা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট মহিলা চুনী কোটাল এমএ পড়ার সময় আত্মঘাতী হয়েছিলেন৷ তাঁর জাত নিয়ে সহপাঠী, এমনকি অধ্যাপকদেরও লাগাতার খোঁচা সহ্য করতে না পেরে৷
বিচলিত হয়েছিলেন পুলিসকর্মী অরূপ৷ ডয়চে ভেলের তথ্যচিত্রে তাঁর আবেগতাড়িত মন্তব্য ছিল— শবরদের যাতে কেউ চোর বলতে না পারে, সেই জন্যই ওদের পড়াশোনা শেখানো৷ যেহেতু ওদের পয়সা নেই, তাই অবৈতনিক৷ অরূপ নিজের মাসমাইনের একটা বড় অংশ সেই বিনেপয়সার স্কুলের জন্যেই খরচ করেন৷ যখনই সময়–সুযোগ পান, চলে যান সেখানে৷ এই করে করে একটি অর্জিত ছুটিও আর বাকি নেই৷
এবার ডয়চে ভেলে–কে জানালেন অরূপ৷ সরকারি চাকরিতে এই অর্জিত ছুটি, অর্থাৎ আর্নড লিভ, বা ইএল জমিয়ে রাখা যায়৷ অবসরের সময় তার ৩০ শতাংশ এনক্যাশ করা যায়৷ অর্থাৎ ছুটির পরিবর্তে অতিরিক্ত টাকা৷ কিন্তু সে সাশ্রয় তো হয়ইনি, উল্টে এখন এমন অবস্থা, যে কাজে কামাই করলে বেতন কাটা যাবে৷
তার থেকেও খারাপ, পুলিশ সূত্রের খবর, কাজে সময় কম দিয়ে সমাজসেবায় মেতে থাকার জন্য অরূপকে সতর্ক করা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, হয় কাজে মন দাও, নয়ত বরখাস্ত হবে! অরূপ বলছেন, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্তারা তাঁর এই সামাজিক কাজকে সমর্থনই করেন৷
কিন্তু সমস্যা তৈরি করছেন কিছু অফিসার৷ যাঁরা চান না ভাল কিছু হোক৷ ‘ওদের কীসের গাত্রজ্বালা আমি জানি না৷' মন্তব্য করলেন অরূপ৷ এদিকে তিনি হতাশ যে, পুলিস বিভাগ তাঁর পাশে দাঁড়াচ্ছে না৷ আগে একবার অরূপের স্ত্রী পুলিসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে চিঠি লিখেছিলেন, যাতে শবর বাচ্চাদের ওই স্কুল চালাতে একটু সুবিধে হয়৷ তার পর অরূপকে বাড়ির ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে চাকরি করার যে বিশেষ সুযোগ, তা পাইয়ে দেওয়া হয়৷ কিন্তু এখন কলকাতায় পোস্টিং হওয়াতে আবার সমস্যা হচ্ছে৷
তা হলে কী করবেন?অরূপ মুখার্জি তোয়াক্কা করছেন না৷ যে শবর বাচ্চাদের শিক্ষিত করার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি, সেটাও তাঁর কাছে সমান গুরুত্বের৷ বললেন, ডিপার্টমেন্ট যা করার করুক৷ স্কুল আমি ছাড়তে পারব না৷ যা হবে, হবে!