করোনার সম্মুখ-যোদ্ধা আর নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদভাবনা
শুক্রবার ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। নিজেদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে যারা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের ঈদ ভাবনা কী? উৎসবটা কেমন কাটবে তাদের? চলুন জেনে আসি ছবিঘরে...
৫০-১০০ টাকা বখশিশই ঈদের আনন্দ
ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের সেকেন্ডারি ডাম্পিং স্টেশনের পরিচ্ছন্নকর্মী মোঃ নাঈম বলেন, “গতবছর যখন সবাই করোনার ভয়ে ঘরে বন্দি, তখনও আমাদের প্রতিদিন কাজ করতে হইসে। বাসাবাড়িতে গিয়া ময়লা নেই, কেউ কখনো জিজ্ঞাস করে না কেন এত ঝুঁকি নিয়া কাম করি। আর ঈদের আনন্দ বলতে সাবেরা যেই ৫০-১০০ টাকা বখশিশ দেয়, ঐটাই আমগো আনন্দ।
ঈদে ছুটি নেই, ছুটি নিলে বেতন কাটা যাবে
রাজধানীর মিরপুরের একটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মী মো. আবদুল মালেক বলেন, “ আমাদের কোনো ঈদের ছুটি নেই। যদি কেউ ছুটি নিতে চায়, তবে অনুপস্থিতির দিনগুলোতে বেতন কাটা যায়৷ তাই গত চার বছর ধরে কোনো ছুটি নেইনি। সামান্য বেতন পাই, স্বামী-স্ত্রীর সংসার কোনোরকমে চলে। বেতন কাটলে না খেয়ে থাকতে হবে।
উৎসব উদযাপনের সুযোগ নেই
রেস্তোরাঁর টাটকা খাবার বিলিকারী প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মী বলেন, “নিজের দৈনন্দিন খরচ চালাতে এখানে কাজ করি। যে-কোনো উৎসবে ছুটি চাইলে তো নেওয়াই যায়, কিন্তু সেক্ষেত্রে সেদিনের আয় বন্ধ থাকবে। ঢাকা শহরে যে খরচ, একদিনের আয় দিয়ে অন্যদিন চালানো খুব ই কঠিন।
সন্তানদের ঈদের পোশাক কিনে দিতে পারিনি
করোনার আগে ক্যাটারিং সার্ভিসে কাজ করে মোটামুটি আয় হতো জামাল হোসেনের। লকডাউনে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরি হারিয়ে তিনি রিক্সাভ্যানে করে মাস্ক, স্যানিটাইজার বিক্রি শুরু করেন। সংক্রমিত হওয়ার ভয় নিয়েই প্রতিদিন ঘর থেকে বের হন জানিয়ে বলেন, “গতবছর ঈদে আয় মোটামুটি হলেও এ বছর বিক্রি একেবারেই খারাপ।এই ঈদে সন্তানদের পোশাকও কিনে দিতে পারিনি৷’’
ছুটি সীমিত, ঈদে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ নেই
মেট্রোরেলের নির্মাণকর্মী মো. দুলাল হোসেন বলেন, “সরকার যে তিনদিন ছুটি ঘোষণা করসে, বাড়ি যাইতে আসতে লাগবে দুই দিন। তার উপর দূরপাল্লার গাড়ি সব বন্ধ। তাই গ্রামের বাড়িতে ঈদ করার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ নাই। যদি পরের ঈদে পরিস্থিতি ভালো হয়, তাহলে হয়তো বাড়ি যাওয়ার চিন্তা করা যাবে।”
জমানো টাকা সব শেষ, ঈদ করবো কী দিয়া?
মিরপুর-নিউমার্কেট রুটের মিরপুর লিংক বাসের সুপারভাইজার মো. আবদুল হক বলেন, “এই লকডাউনে বাস বন্ধ থাকায় মালিক আমাদের এক পয়সাও দেয় নাই। জমানো টাকা যা আছিল, তা দিয়া পরিবারসহ অনেক কষ্টে চলছি। এখন হাতে আর কোনো টাকা নাই যা দিয়ে ঈদ ভালোভাবে পালন করব।”
ভয় করলে পেট চলবে না
একটি তামাকজাত পণ্যের বিক্রয় প্রতিনিধি নূর মোহাম্মদ বলেন, “গতবছর করোনায় কোনো চাকরি ছিল না। এ বছর হন্যে হয়ে খোঁজার পর একটি চাকরি পেয়েছি। চাকরির এই বাজারে এখন করোনার ভয় পেলে পেট চলবে কিভাবে?”
রোগীদের সেবার স্বার্থে ভয়কে দূরে রাখতে হচ্ছে
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. কামরুজ্জামান বলেন, “গতবছর করোনায় যেভাবে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা গেছে, এ বছর সেটা করা যাচ্ছে না। আমরা দূরত্ব বজায় রাখলে রোগীরা মানসিক স্বস্তি পায় না, তাছাড়া এই আবহাওয়াতে আমাদের জন্য কাজ চালিয়ে যাওয়াও কষ্টকর। কিন্তু সংক্রমিত হওয়ার ভয় কাজ করলেও আসলে তা পাশ কাটিয়েই আমাদের সেবা চালিয়ে যেতে হচ্ছে।“
সহকর্মীদের স্বার্থে স্বেচ্ছায় ছুটি নেইনি
ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার সিগন্যালে কর্মরত ট্রাফিক সার্জেন্ট সুমন জানান, ঈদে ছুটি তিনদিন নেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও সহকর্মীদের স্বার্থেই তিনি দুইবছর যাবত ঈদের ছুটির আবেদনই করেননি। তিনি পরিবারসহ ঢাকায় থাকেন, তাই অন্য সহকর্মীরা যাতে ছুটিটা উপভোগ করতে পারে, সেজন্য তিনি ছুটি নেননি৷
মুসলিম সহকর্মীরা যাতে ঈদ উপভোগ করতে পারেন তাই আমরা কাজ করি
ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ফাল্গুনি রানী বলেন, “আমাদের অধিকাংশ স্টাফই মুসলিম হওয়ায় আমরা যারা অমুসলিম আছি, তারা ঈদগুলোতে দায়িত্ব পালন করি যেন মুসলিম সহকর্মীরা প্রিয়জনদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে। পরবর্তীতে আমাদের উৎসবেও তারা এই ত্যাগটা স্বীকার করেন। কর্মক্ষেত্রে এই সহমর্মিতার সম্পর্কটা থাকা অনেক জরুরি বলে মনে করি আমি।“
পরিবার নিয়ে আতঙ্কেই ঈদগুলো কাটাচ্ছি
ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রোকসানা মনোয়ারা বলেন, “গতবছর করোনার শুরুতে সবার মতো আমিও অনেক ভয় পেয়েছিলাম। আলাদা কোনো থাকার ব্যবস্থা না থাকায় হাসপাতালে করোনা রোগীদের সেবা করে বাসায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে একই ঘরে থাকতে হতো। টিকা নেওয়ার পর ভয় কিছুটা কমলেও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কারণে আগের ভয়টা এখন আবার কিছুটা চেপে বসেছে।”
গত ঈদের চেয়ে এবার বেচাবিক্রি কিছুটা ভালো
ঢাকার মিরপুরের একটি কাঁচাবাজারের মুদিদোকানি দেলোয়ার হোসেন বলেন, “গত ঈদে কঠোর লকডাউন থাকায় কেউ বাসা থেকে বের হয়নি, কেনাকাটাও করেনি। কিন্তু এ বছর ভয় অনেকটা কেটে গেছে বিধায় মানুষজন ঈদের কেনাকাটা করছে এবং আমাদের বেচাবিক্রিও তুলনামূলক ভালো।“