1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এখন আর গানে নেই প্রাণ

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১ মার্চ ২০১৮

তিনি ৯৭ ছুঁয়েছেন৷ সেই কবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, তিতাসের পাড় ছেড়ে এলেও তিনি আজও সেখানকার মেঠো সুর গুনগুনিয়ে ওঠেন৷ প্রবাদপ্রতিম শিল্পী অমর পালের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এলো পল্লীবাংলার অকৃত্রিম সুর থেকে আজকের সংগীতচর্চার নানা দিক৷

https://p.dw.com/p/2tV9g
Amar Paul Musiker
ছবি: DW/P. Samata

নিজের বাড়িতে সপ্তাহে দু'দিন শনি ও রবিবার তিনি এখনও সংগীতশিক্ষার আসর বসান৷ যেখানে আসর বসে, সেখানে সাজানো অনেক পুরস্কার, সম্মাননা৷ নিজের ছবির পাশে গুরু আয়াত আলি খানের ছবিও রয়েছে৷ টালিগঞ্জের কে এম নস্কর রোডের এই আসরেই পৌঁছে গিয়েছিল ডয়চে ভেলে৷ পাড়ায় ঢুকতে সকলেই বলে দিচ্ছিলেন, কোথায় এই যশস্বী শিল্পীর বাড়ি৷ পৌঁছে দেখি, হারমোনিয়াম বাজিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শেখাচ্ছেন তাঁর গাওয়া একটি গান — ‘স্বপ্নে দেখি মধুমালার মুখ'৷

হ্যাঁ, স্মৃতি সতত সুখের৷ কথার শুরু থেকে শেষে তারই রেশ৷ বাংলাদেশের লোকগীতির সুরেলা স্মৃতি হলে তো কথাই নেই৷ যেমন এই ‘স্বপ্নে দেখি মধুমালার মুখ' গানটি৷ প্রবীণ বলেন, এই গানটি গেয়েই তিনি কবি শৈলেন রায়, দেবকীকুমার বসুর মন জয় করেছিলেন৷ বারবার তাঁর কথায় ফিরে আসে বাউল, টুসু, মনসা থেকে ভাটিয়ালির কথা ও সুর৷ গান শেখানোর মধ্যেই দিলেন প্রশ্নের উত্তর৷

ডয়চে ভেলে: এখনকার লোকসংগীত শোনেন? আগের সঙ্গে তফাৎ কোথায়?

অমর পাল

অমর পাল: লোকসংগীত বলব কেন? আমাদের সময়ে আমরা — মানে শচীন দেববর্মণ, আবাসউদ্দীন আহমেদ, কেউ লোকসংগীত বলতাম না৷ বলতাম পল্লীগীতি৷ কারণ পল্লীগ্রামে এ গানের জন্ম৷ তখন ঘরে ঘরে বিশেষ করে ভগবানের নামকীর্তন হতো৷ আমার বড়মাই ঠাকুরের সামনে গান করতেন৷ আজকাল মানুষই তো ভগবান৷ এখন আর ভগবানের সামনে গান নেই৷ আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল পুকুর৷ পুকুরের পূর্ব পাড়ে আমাদের বাড়ি আর পশ্চিমপাড়ে রাধামাধবের আখড়া৷ ওখানে ছেলেমেয়েরা গান শিখতে শিখতে বড় হয়েছে৷ এই ছিল সেকালের পরিবেশ৷ এখন আর গান নেই৷ গানের সর্বনাশ হয়েছে৷ 

যন্ত্রানুষঙ্গে পল্লীগীতি কি বিকৃত হচ্ছে? এতে গানের বিশুদ্ধতা নষ্ট হচ্ছে কি?

একটা ঘটনার কথা বলি৷ কালিকাপ্রসাদের (প্রয়াত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য) কাকা অমিয় আমাকে শিলচর নিয়ে গিয়েছিল গান গাইতে৷ কালিকার ঠাকুরমা, মানে অমিয়র মা আমাকে ঘরের ভেতরে দেখা করতে বললেন৷ আমাকে দেখেই বৃদ্ধা হুঙ্কার দিয়ে বললেন, নির্মলেন্দু চৌধুরী ‘ও সোহাগ চাঁদ বদনী ধনি' গানটাকে বিকৃত করেছে৷ এমনই যত্ন নিয়ে গান শোনা হতো৷ এরকমই ছিলেন শ্রোতারা৷

এখন গান বিকৃত তো হচ্ছেই৷ গানের বিশুদ্ধতাও নষ্ট হচ্ছে৷ ফোকের একটা নির্দিষ্ট যন্ত্রতালিকা রয়েছে৷ একতারা, দোতারা, খোল, ঢোল এসবই ফোকের সত্যিকার যন্ত্র৷ এ সব ব্যবহার না হলে গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে৷ সত্যি বলতে কী, ভাইরে মানুষ নাইরে দেশে৷ এখন যা গান হয়, তা আর গান নয়৷ এখন বাউল গান গাইলে নাচতে হয়৷ আমি পূর্ণদাসের বাবা নবনীদাস বাউলকে দেখেছি৷ তাঁর চোখে হাসি, মুখে কান্না৷ তখন বাউল গান তাঁরাই গাইত, যাঁরা শততালি দেওয়া জামা পরত৷ বৈষ্ণবরা যেমন গরিব, গান গেয়ে ভিক্ষে করে৷ তেমনি বাউলরাও৷ একটা পোশাক ছিঁড়লে আরেকটা পরে৷ এখন আর সে সব নেই৷ এখন বাউল গান গাইলে নাচতে হয় কেন? নবনীদাসও খানিকটা হেলেদুলে গাইতেন৷ কিন্তু এমন ছিল না৷ আগে গানে ঈশ্বরকে ডাকা হতো৷ এখন তারা গান দিয়ে নিজেদের প্রচার আর বাণিজ্য আহ্বান করে, এটাই ফারাক৷

গান গেয়ে শোনালেন অমর পাল

এ প্রজন্মের সংগীতচর্চা নিয়ে কী বলবেন?

কিছুই বলব না৷ কারণ এই নিয়ে মন্তব্য করে কারও বিরাগভাজন হতে চাই না৷ তবে বলতে চাই, গান ঈশ্বরপ্রদত্ত৷ বৈষ্ণবরাও ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ' গান পেয়েছেন ঈশ্বরের থেকে৷ এখন ‘ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গের' সুর অন্যরকম করে অনেক মামলা ঠোকাঠুকি চলছে৷ আমি ছোট থেকে যে গান শুনেছি, তার এমন বিকৃতি মেনে নিতে পারিনি৷ আর এ সব নিয়ে বলে শত্রু বাড়াতেও চাই না৷ বারবার বলছি, যুগ পালটেছে৷ এ সব আলোচনা করতে পারব না৷

কেন এমনটা দেখা যাচ্ছে? 

এদের বেশিরভাগেরই মাটির সঙ্গে যোগাযোগ নেই৷ এরা মাটির সুর পাবে কোথা থেকে? অনুভব করবে কীভাবে? গ্রামে বড় হওয়ার স্বাদ কি এরা জানে? ছাত পেটানো, মাঝির গান, চাষীর গান, পথশ্রম ভুলতে কী গান হয়, এরা জানে কি? মানুষ তো প্রথম সুর পেয়েছে প্রকৃতির থেকে৷ এটা ভুললে চলবে কী করে?

বাংলা ব্যান্ড নিয়ে যদি কিছু বলেন...

এই যে কোনো কোনো বাংলা ব্যান্ড বহু রকমের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে ফোক গায়, এরা ফোকের আসল বাদ্য কী, সেটাই জানে না৷ আমাদের দেশীয় বাদ্যযন্ত্রকে অবহেলা করে বিদেশি যন্ত্রের অনুকরণে লোকসংগীতের জাত-কুল রক্ষা হয় না৷ মর্যাদাও থাকে না৷

এপার এবং ওপার বাংলার সুর নিয়ে কী বলবেন? ওপারে চর্চা কি বেশি?

বাংলাদেশের ফোকচর্চাটা বেশিই৷ প্রভাতি, ভাটিয়ালি, সারি, জারি, মুর্শিদি ভাওয়াইয়া, চটকা, টুসু, ভাদু ওই বাংলায় অনেকটাই বেশি পাওয়া যায়৷ কিন্তু এই বাংলায় লোকসংগীতের শিকড় পোঁতা৷ সেই সম্পদ গুণীরা গ্রহণ করেছেন৷ অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছেন৷

কলকাতা বেতারে প্রথমবার গান গাইবার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

১৯৫১ সালে কলকাতা বেতারে অডিশনে পাশ করার সুযোগ হয়েছিল৷ ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে৷ একটা আধুনিক আর দু'টো পল্লীগীতি৷ তখন সরাসরি সম্প্রচার হতো৷ ভুল হলে সেটাই মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে৷ রেকর্ডিং রুমে একটা লালবাতি থাকত৷ গান গাওয়ার মিনিট ১৫ আগে রিহার্সাল করতে হতো৷ তারপর লালবাতিটা জ্বললেই গান শুরু করতে হতো৷ সেই লালবাতিটা জ্বললেই বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করত৷ প্রথমদিন সেই ভয়টা দারুণ ছিল৷ পারিশ্রমিক পেয়েছিলাম গান পিছু কুড়ি টাকা৷

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কথা বলতে গিয়ে শচীন কর্তার কথা বলেছেন৷ কখনও কাজ করেছেন একসঙ্গে?

আমি শচীনদেব বর্মণের অলিখিত শিষ্য৷ তবে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি৷ একবার আমায় হিন্দুস্তান রেকর্ডের চারখানা গান রেকর্ড করিয়ে দেবেন বলেছিলেন৷ কিন্তু সে সুযোগ হয়নি৷ তাঁর আগেই চলে গেলেন৷

 

বাংলা গানের জগতে মাইলফলক ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়'৷ এর গোড়ার গল্পটা বলবেন?

হীরক রাজার দেশে৷ সে এক ঘটনা বটে৷ অনুপ ঘোষাল একদিন এসে বললেন, মানিক মামা আপনাকে দেখা করতে বলেছেন৷ গেলাম সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে৷ দু-চারটে কথার পর খালি গলায় একটা গান শোনাতে বললেন৷ আমি তখন ‘এ ভব সাগর কেমনে দিব পাড়ি রে' ভাটিয়ালিটা গাইলাম৷ শুনে বললেন, পরে খবর দেবেন৷ বেশ কয়েকদিন পর বলে পাঠালেন, গান তৈরি হয়ে গেছে৷

এইচএমভি-তে রেকর্ডিং হবে৷ রেকর্ডিংয়ের সময় একটা টেকেই গান ওকে হলো৷ আমি তো বেশ ঘাবড়ে আছি৷ বিজয়া রায় এসে বললেন, খুব ভালো হয়েছে৷ তাও সন্দেহ যেন গেল না৷ কতদিন রাত্রে ঘুমই আসত না৷ কী জানি, কী হয়েছে৷ ছবিতে থাকবে কিনা বা থাকলেও কেমন লাগবে! ছবির পর্দায় এই গানে লিপ দিয়েছিলেন অতীতের গায়ক-অভিনেতা রবীন মজুমদার৷ এও এক সৌভাগ্য! ছবি মুক্তি পাওয়ার পর পর্দায় আমার গানটা দেখে তবে রাতে ভালো ঘুমোতে পেরেছিলাম৷

কথার ফাঁকে গানের আসর গুটিয়ে আসে৷ তার মধ্যেই নবতিপর শিল্পী ক্ষীণ কণ্ঠে হলেও গড়গড় করে বলে দিতে পারেন তাঁর প্লেব্যাকের লম্বা তালিকা৷ সেখানে প্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষ থেকে তপন সিংহ, দেবকীকুমার বসু, সবাই রয়েছেন৷

আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগেও তিনি লোকসংগীত গেয়ে মধ্যগগনে থেকেছেন৷ শুধুমাত্র লোকগানকে ভালোবেসে সেই সময় আধুনিক গান করার সুযোগ তিনি হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন৷ আকাশবাণীর এক কর্তাব্যক্তি তাঁকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, আধুনিক গাইলে তাঁর বাড়ি-গাড়ি হয়ে যেত৷ কিন্তু অমর পাল উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘বাঁচব তো পল্লীগীতি গেয়ে বাঁচব, মরব তো পল্লীগীতি গেয়েই মরব৷'' তিনি থাকুন, শতায়ু পেরিয়ে যান, তাঁর মধ্যে দীর্ঘিজীবি হোক লোকগান — এই কামনা দুই বাংলার৷

বন্ধু, সাক্ষাৎকারটি কেমন লাগলো? জানান আপনার মতামত, নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান