1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর হতাশার এ কোন বাংলাদেশ!

১৯ জুন ২০২০

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে৷ বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও৷ কেবল করোনায় নয় অন্য রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু হচ্ছে অনেকের৷

https://p.dw.com/p/3e1Sa
Bangladesch | Coronavirus | Suhrawardy Medical College and Hospital  in Dhaka
ছবি: picture-alliance/abaca/S. Kanti Das

বাংলাদেশে প্রতিদিন করোনায় মৃতের সংখ্যার আপডেট দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর৷ এটা কেবল সংখ্যাই ছিলো, কিন্তু যখন কাছের মানুষের মৃত্যু হল তখন বুঝতে পারলাম এক একটা সংখ্যা কতটা ভারী৷ অচেনা থেকে চেনা গণ্ডির ভেতর ঢুকে পড়েছে করোনা৷ আর তার ফলে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভয়াবহ রূপটা আরো প্রকট হয়েছে৷ পরিচিতদের ঘটনাগুলো তুলে ধরার আগে আসুন কয়েকটা খবরের কথা বলি৷ কয়েকটি শিরোনাম দেখলেই বুঝবেন আমাদের স্বাস্থ্যখাতের কি অবস্থা!

  • রাজধানীর বাইরে করোনা রোগীর জন্য ডায়ালাইসিস সেবা নেই: প্রথম আলো
  • জ্বর-সর্দি নিয়ে ঘোরাঘুরির পর থানায় গিয়ে মিলল ডাক্তার: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • অর্ধেক শয্যা খালি, তবু রোগী ফেরাচ্ছে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলো: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • ভর্তি নেয়নি কোনো হাসপাতাল, গাড়িতেই আ.লীগ নেতার মৃত্যু: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
  • হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরে গাড়িতেই মৃত্যু: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

করোনা পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সেবার সংকটের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে যমুনা টেলিভিশনে আবদুল্লাহ তুহিনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে৷ দুই মাসের মুমূর্ষু সন্তানকে নিয়ে কীভাবে ভোগান্তি হয়েছে এক শিক্ষকের৷ ঝিনাইদহ থেকে ঢাকায় নিয়ে এসে চিকিৎসা না পেয়ে ঝিনাইদহে ফিরে গিয়ে মৃত্যু হয় শিশুটির৷

বাংলাদেশের প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ কবিরের মা মারা গেছেন করোনায়৷ তার একটি ফেসবুক পোস্টের অনেকটাই এখানে তুলে দিচ্ছি৷ কারণ এটা থেকে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থার একটা পরিষ্কার চিত্র পাবেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি এখনো মনে করি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আমার মাকে হয়তো হারাতে হতো না! পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, ভেন্টিলেটরসহ হাসপাতালের বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনাকাটা নিজেদের হাতে রাখতেই করোনার চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকজন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে৷ সরকারি ৪-৫টি হাসপাতালে আইসিইউর বেড সাকল্যে শ খানেক৷ কিন্তু রোগী কয়েক হাজার৷ যে হাসপাতালগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগেরই উন্নত চিকিৎসা দেয়ার সামর্থ্যই নেই৷ আপনারাই বলুন, স্বাভাবিক অবস্থা থাকলে আপনারা কেউ কুয়েত মৈত্রী বা মুগদার মতো হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যেতেন কিনা?

‘‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তারা যদি বলেন, তারা আসলে বুঝতেই পারেননি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এতোটা লেজেগোবরে হবে, তাহলে বুঝতে হবে, তারা সবাই বেকুব এবং এমন একটি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দায়িত্ব সামলানোর বোধ-বুদ্ধি ও যোগ্যতা তাদের নেই!

‘‘কাজেই, তাদের এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে যারা করোনায় কিংবা করোনার লক্ষণ নিয়ে বিনা চিকিৎসায় কিংবা যথাযথ চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন তাদের দায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে৷

‘‘এছাড়া, চিকিৎসকসমাজও স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই বেহাল দশার জন্য অনেকটাই দায়ী৷ এখন সমস্ত হাসপাতালের হাল ধরে আছেন প্রধানত জুনিয়র ও তরুণ ডাক্তাররাই৷ সিনিয়র বা অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসকদের প্রায় কেউই হাসপাতালে যাচ্ছেন না৷ এমন একটা ভয়ংকর যুদ্ধে তাদের অধিকাংশই ময়দানে নেই৷

‘‘আমার মা ২৪ ঘণ্টা বারডেম হাসপাতালে ছিলেন৷ করোনার লক্ষণ থাকায় ডিউটি ডাক্তার ও নার্সরাও তার যথাযথ দেখভাল করেননি! গ্রিনলাইফের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য৷ সিনিয়র চিকিৎসকরা চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে খুব একটা যুক্ত ছিলেন না৷

‘‘বাংলাদেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখন যাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তাদেরকে বহাল রেখে এবং দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এমন বেহাল অবস্থায় রেখে 'উন্নয়নের জোয়ার' কতোদিন বজায় থাকবে- সেটা নিয়ে অবশ্যই নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে৷

‘‘আম্মা মারা যাওয়ার পর হাসপাতালের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতরে জানানো হয়৷ করোনায় কোনো রোগী মারা গেলে তাদেরকে জানানোটাই নাকি এখনকার নিয়ম৷ এর পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব 'আল মারকাজুল ইসলাম'কে জানানো৷ তারা হাসপাতালে এসে লাশ দাফন-কাফনের উদ্যোগ নেবে৷

‘‘কিন্তু তারা কখন আসবে? বিষয়টি একেবারেই অনিশ্চিত৷ খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গেই বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানিয়ে দিয়েছে৷ এরপরে বাকি কাজটা মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীল৷ তারা কখন 'আল মারকাজুল ইসলাম'কে জানাবে, কখন ‘আল মারকাজুল’ আসবে সেটা কেউ জানেন না৷ যতোদূর শুনেছি, সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকনের লাশ নিতে ১৪ ঘন্টা সময় লেগেছিলো৷

‘‘করোনা যতোটা না অভিশাপ, তার চাইতে বেশি ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে রেখেছেন আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও এই মন্ত্রণালয়ের লোকজন৷’’

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর ১৫ জুনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে করোনা পরীক্ষার ফল পেতে দেরি হওয়ায় তেমন কোন লাভ হচ্ছে না৷ করোনা শনাক্ত হওয়ার আগেই রোগীর মৃত্যু হচ্ছে৷ রিপোর্টে কয়েকটি কেসের কথা বলা হয়েছে৷ এর মধ্যে একজন স্বাস্থ্য কর্মী মে মাসের ২৭ তারিখে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ১৯ দিন পর ফল পান সেএমএস এর মাধ্যমে, যেখানে লেখা ছিলো স্যাম্পল নেয়া হয়েছে ৬ জুন৷ প্রত্যেকেই জানিয়েছেন স্যাম্পল দেয়ার পর ফল পেতে দুই সপ্তাহের বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে৷

এবার আসি পরিচিতদের কথায়৷ আমার চিকিৎসক এক বান্ধবী দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন ১৪ জুন দিনাজপুরে৷ শারীরিক নানা জটিলতার কারণে ডাক্তার অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তা ঢাকায়৷ কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে দিনাজপুরেই এক ক্লিনিকে ওর অস্ত্রোপচার হয় নির্দিষ্ট সময়ের কয়েকদিন আগে৷ ওর স্বামীও ডাক্তার এবং তাকে হাসপাতালে নিয়মিত ডিউটি করতে হচ্ছে৷ বান্ধবী জানিয়েছিল হাসপাতালে পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই৷ তাই স্বামী সন্তান নিয়ে তার ভীষণ উদ্বেগ৷ এ কারণে বাবার বাসায় গিয়ে থাকছে সে৷ স্বামী হয়ত বাড়ির বাইরে থেকে চোখের দেখা দেখে চলে যায়, স্ত্রী-সন্তানকে আদরটুকু করতে পারে না৷ এই দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের কারণেই হয়ত সময়ের আগেই অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে তাকে৷ তবে সন্তান জন্ম দিয়ে সব শারীরিক কষ্ট সহ্য করে ক্লিনিকে না থেকে বাসায় চলে আসে সেদিনই৷ ওরা চিকিৎসক হওয়ায় অস্ত্রোপচারের সুযোগটা পেয়েছে অনেকে হয়ত তাও পাচ্ছে না৷ কেনো বলছি একথা পরের ঘটনাটা পড়লেই বুঝতে পারবেন৷

আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর স্ত্রী গর্ভবতী৷ প্রথম সন্তানের আশায় তাদের এখন কত না আনন্দে থাকার কথা, অথচ তাদের সময় কাটছে ভীষণ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে৷ সেপ্টেম্বরে সন্তান জন্মানোর কথা৷ ফলে এ সময়টায় ডাক্তারের নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা খুব জরুরি কিন্তু গত মাস থেকে তাদের ডাক্তার চেম্বারে বসছেন না৷ এমনকি চেম্বার থেকে বলা হয়েছিল ডাক্তার আপনাদের সঙ্গে ফোন করে কথা বলবেন৷ অথচ কোন ফোন আসেনি৷ একজন নারীর জীবনে এই সময়টা এমনিতেই কিছুটা উদ্বেগের, সেই সাথে যদি এমন মানসিক চাপ তৈরি হয় সে সুস্থ-স্বাভাবিক থাকবে কি করে? মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর যদি এ অবস্থা হয়, নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর কি অবস্থা তা কল্পনা করে নিতে কষ্ট হয় না৷

অমৃতা পারভেজ
অমৃতা পারভেজ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতের এমন অবস্থা যে কারো জ্বর হলে বা করোনা উপসর্গ দেখা দিলেও পরীক্ষা করাতে ভয় পায়৷ কারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চিকিৎসা হচ্ছে কিনা কারো জানা নেই৷ আর এ কারণে বাসায় থেকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে৷ আমার পরিচিত বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের এক ছোটভাই এর স্ত্রী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন গত সপ্তাহে৷ ওর বয়স ২৬/২৭৷ একটি ৭ বছরের ছেলে আর তিন বছরের ছোট মেয়ে আছে৷ স্বামী-স্ত্রী দু'জনেরই জ্বর ছিল আর অল্প শ্বাসকষ্ট৷ পরিচিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাসায় থেকে দুজনেই ওষুধ খাচ্ছিলো৷ ১০ দিন পর দুজনেই সুস্থ হয়ে ওঠে৷ যেদিন ওর স্ত্রী মারা যায়, সেদিন রাতে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়৷ জ্বর, শ্বাসকষ্ট থাকা সত্ত্বেও ওরা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করায়নি৷ কারণ ধারণা ছিলো পরীক্ষা করাতে গিয়ে না ভাইরাস সঙ্গে নিয়ে ফেরে৷

আমার মা'র প্রসঙ্গ টেনে লেখা শেষ করছি৷ গত দুই সপ্তাহ ধরে তার বুড়ো আঙ্গুলে প্রচণ্ড ব্যথা৷ ফুলে গেছে আঙ্গুল নড়াতে পারছেন না৷ রাজশাহীতে পরিচিত যে চিকিৎসকরা আছেন তারা কেউ চেম্বারে বসছেন না৷ ফোন করে একজনকে পাওয়া গেলেও বলেছেন এক্সরে করে জানান ভেঙ্গেছে কিনা তারপর ওষুধ দিবো৷ এখন এক্সরে করাতে গেলে সংক্রমণের ভয়৷ তাই প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে মা অপেক্ষা করছেন কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে৷ আর আমি এই প্রবাসে দুশ্চিন্তায় আছি তার এই কষ্ট যেনো কোন ভয়াবহ যন্ত্রণায় রূপ না নেয়৷

আমাদের স্বাস্থ্যখাতে বিপুল পরিবর্তন আসবে এই আশা করা অমূলক৷ তাই একটাই চাওয়া, এই ভয়াবহ করোনা কাল দ্রুত অতিবাহিত হোক৷ এই রূদ্ধশ্বাস মুহূর্তগুলোর অবসান হোক৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান