পণ্ডিত রবি শঙ্কর
১৮ ডিসেম্বর ২০১২বড় ভাই উদয় শঙ্করের সঙ্গে, তাঁর নাচের দলের হয়ে রবি শঙ্কর প্রথম জার্মানিতে এসেছিলেন ১৯৩২ সালে৷ কিশোর নৃত্যশিল্পী বড় হয়ে হয়েছেন সেতারের জাদুকর৷ এত আগের কথা মনে আছে? জবাবে রবি শঙ্কর বলেছিলেন, ‘‘আমার স্পষ্ট মনে আছে৷ তখন সত্যি বলতে কী ইউনাইটেড স্টেটসের পর জার্মানিই সবচেয়ে ফেভারিট জায়গা ছিল৷ ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর জ্ঞান এবং এর প্রতি ভালোবাসা জার্মানিতে ভীষণ ছিল তখন৷ আমার মনে আছে তখন, যুদ্ধের পর, ওদের অবস্থা খুব খারাপ ছিল৷ তখন সারা জার্মানিতে আমরা ট্যুর করতাম৷ এখন অবশ্য অনেক বদলে গেছে জার্মানি৷''
‘পথের পাঁচালি' ছবির সুবাদে সংগীত পরিচালক হিসেবেও অমর হয়ে থাকবেন রবি শঙ্কর৷ পাশ্চাত্য সংগীতেও বড় বড় কাজ আছে তাঁর৷ কিন্তু যে দেশ এত আগে থেকে আপন, সেই জার্মানিতে কেন সেরকম কিছু করলেন না? জবাবে আফসোসই শোনা গেল পণ্ডিতজির মুখে:
‘‘আমি কখনো কখনো ভাবি, আমার মনে ভীষণ কষ্ট হয়, কেননা, ৫৬ সালে, আমি খুব উৎসাহী হয়ে সবার আগে জার্মানিতেই প্রোগ্রাম শুরু করি৷ সে সময় সম্ভবত রাম মুখার্জি নামে একজন ছিলেন, উনি আমার সব প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করেন৷ পরে অন্যান্য সংস্থার ডাকেও এসেছি, অনেক প্রোগ্রাম করেছি৷ কয়েক বছর আমি আসি নামমাত্র পারিশ্রমিক নিয়ে৷ তখন এখানে আসার আগ্রহ অনেক বেশি ছিল, তাই প্রত্যেক বছর আসতাম৷ ইউরোপে আমার অনেক সুনামও হয়৷ তারপর কয়েক বছর বাদ যায়৷ এরপর আবার যখন জার্মানিতে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করি, তখন ভালো এজেন্ট পাইনি৷''
উচ্চাঙ্গ সংগীতের ভবিষ্যত কেমন? অনেক বছর ধরে নানা কারণেই প্রশ্নটি খুব প্রাসঙ্গিক৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে রবি শঙ্কর জানিয়েছিলেন এ নিয়ে তিনিও বেশ শঙ্কিত, বলেছিলেন, ‘‘খুব জোর গলায় বলতাম কোনো ভয় নেই, অন্য দেশের ক্লাসিক্যাল সংগীতের যা অবস্থা ভারতেও তাই৷ কিন্তু বছর কয়েক ধরে যা দেখছি তাতে আমার মনে কী রকম যেন সংশয় জাগছে৷ আমাদের দেশে এত বেশি টেলিভিশনের প্রভাব, তরুণদের মধ্যে এত বেশি রক-অ্যান্ড-রোল, পপ মিউজিক, ফিউশন আর ফিল্মি মিউজিকের প্রভাব যে এখন কিছুটা ভয় হয়৷''
প্রশ্ন উঠতেই পারে এতই যদি প্রতিকূলতা তাহলে নিজের মেয়ে অনুশকা শঙ্করকে কীভাবে এত সফল সেতার বাদক হিসেব গড়ে তুললেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বোঝা গেল পণ্ডিত রবি শঙ্কর সুরসাধক এবং বাবা হিসেবে কত আধুনিক৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘...আর কোনো দিকে মন না দিয়ে আমাদের পুরোনো পদ্ধতির যে সাধনা সেটা একেবারে সম্ভব নয় এখন৷ আর বিশেষ করে অনুশকার মতো বাচ্চা, যাদের জন্ম বাইরে হয়েছে, পড়াশোনা বাইরে করেছে, অল দ্য টাইম বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মিশছে, এই পরিস্থিতি থেকে ওই পুরোনো ধরনের সাধনা, আর কিছু করবো না, শুধু সেতার নিয়ে থাকবো ১২ ঘণ্টা-১৬ ঘণ্টা এটা একেবারে অসম্ভব৷ এটা বুঝেই আমি আর আমার স্ত্রী সুকন্যা ওকে মানুষ করেছি৷ আসলে ওর ওপর সুকন্যার দাবি অনেক বেশি৷....সুর আর লয়ের যে বোধ – এটা সুকন্যার কাছ থেকেই ও পেয়েছে৷ ওর যখন নয়-সাড়ে নয় বছর বয়স তখনই আমি ওর হাতে সেতার তুলে দেই৷ ....ও বেশিরভাগ সময় বাইরেই থেকেছে৷ সেভাবে মানিয়েই আমরা ওকে বড় করে তুলেছি৷ কাজেই যে মাপকাঠিতে আমাদের ভারতীয়রা ‘এক্সপেক্ট' করে, সাধক বা সাধিকার যেমন হওয়া উচিত সেরকম হতে পারেনা, এবং সেরকম ও হয়নি৷ কিন্তু আমি দেখলাম ও অসম্ভব ‘ট্যালেন্টেড'৷ নিজের মেয়ে বলে বলতে একটু সংকোচ হয়৷ কিন্তু আমি সত্যিই এরকম দেখিনি৷ ওর সব কিছুতেই ‘ইন্টারেস্ট' আছে৷ লিটারেচারে যেরকম, খেলাধুলায় সেরকম, ওয়েস্টার্ন মিউজিকে...পিয়ানো বাজায় সেরকম, মডেলিংও সেরকম করবে, অ্যাকটিংও সেরকম করবে৷ ওর বহুমুখী ‘ইন্টারেস্ট' ছিল বলে আমরা ওকে সেভাবেই স্বাধীনতা দিয়ে গড়ে তুলেছি৷''