1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঈদ উৎসবে বাজার অর্থনীতিতে জোয়ার

৬ মে ২০২২

দুই বছর পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ঈদুল ফিতর বেশ উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হলো৷

https://p.dw.com/p/4AuDj
ছবি: Rajib Paul/DW

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আরোপিত কঠোর বিধি-নিষেধের কারণে ২০২০ সালে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎস ঈদুল ফিতরের উদযাপন ছিল ঘরবন্দি, ঈদকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ছিল খুব সীমিত৷ ২০২১ সালে বিধি-নিষেধর বেড়াজাল খানিকটা শিথিল হওয়ায় পরিস্থিতি র কিছুটা উন্নতি ঘটলেও তা ২০১৯ সালের মতো হয়নি৷ তবে ২০২২ সালে এসে সবধরণের বিধিনিষেধ উঠে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ধারায় ঈদের অর্থনীতিতে আবার জোয়ার লক্ষ করা গেছে

কোনো বিস্তারিত গবেষণাভিত্তিক কাজ না হলেও এটা এখন সর্বজন স্বীকৃত যে ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও লেনদেন হয়ে থাকে তা সারা বছরের বিভিন্ন উৎসবভিত্তিক অর্থনীতির অন্তত অর্ধেক৷ ঈদুল আজহা, পহেলা বৈশাখসহ অন্যান্য ধর্মীয় ও জাতীয় দিবসভিত্তিক উৎসব বাকিটা সম্পন্ন করে বলে ধারণা করা যায়৷ রাস্তার ধারের ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে বিলাসবহুল বিপণী বিতানের কেনাবেচা কিংবা কাঁচাবাজার থেকে খাবার-দাবারের বিকিকিনি সবটাতেই ঈদকেন্দ্রিক লেনদেনেই সবচেয়ে বেশি হয়৷ এই ঈদকে ঘিরে দেশজুড়ে যাত্রী পরিবহনের যে ব্যবসাটা হয়, তার সারা বছরে এমনকি ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদের সময়ও হয় না৷ ঈদের ছুটিতে দেশীয় পর্যটন ব্যবসাও চাঙা হয়ে ওঠে যা একমাত্র বছর শেষের শীতের ছুটির সাথে ‍তুলনীয়৷

ঈদুল ফিতরের ব্যবসা-বাণিজ্যের শুরুটা হয় অবশ্য ঈদের আগে পবিত্র রমজান মাসকে ঘিরে৷ এই মাসের জন্য প্রধানত খাদ্যপণ্যের বাড়তি চাহিদা একদিকে যেমন কাঁচাবাজারের ও খাবারের দোকানের বিকিকিনি বাড়ায়, অন্যদিকে বাড়ায় মূল্যস্ফীতিও৷ আর এই মূল্যস্ফীতির চাপ ঈদের সময় অব্যাহত থাকে৷  মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য কষ্টকর হলেও এটা থেকে বোঝা যায় যে বাজারে টাকার সরবরাহ ও লেনদেন বেশ বেড়েছে৷ এ বছর ঈদের প্রাক্কালে মুদ্রাবাজারে টাকার সরবরাহ কি পরিমাণ ছিল, তা জানতে অবশ্য আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে৷ বাংলাদেশ ব্যাংক এ মাসের শেষের দিকে এপ্রিলের মুদ্রা সরবরাহের হিসেব প্রকাশ করবে৷ অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মাসের মাঝামাঝি এপ্রিলের মূল্যস্ফীতির তথ্য জানাবে৷ মার্চ মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ যা ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ অনুমান করা যায় যে এপ্রিলে তা আরেকটু বাড়বে এবং তা সাড়ে ছয় শতাংশ অতিক্রম করে যেতে পারে৷

ঈদের সময় মানুষের খরচ করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রতিফলিত হয় আরো দুটি সূচকে৷ একটি হলো ঈদের আগে দেশে আসা প্রবাসী আয়ের (রেমিট্যান্স) প্রবাহে, অন্যটি হলো ডিজিটাল ও অনলাইন ব্যাংকিং লেনদেনের পরিসংখ্যানে৷ মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস), ইন্টারনেট ব্যাংকিং, কার্ডভিত্তিক লেনদেন ইত্যাদির এপ্রিল মাসের হালনাগাদ পরিসংখ্যান পেতেও সময় লাগবে৷ ফলে আপাতত, কোনো রকম আনুষ্ঠানিক উপাত্ত ছাড়াই এটা বলতে হচ্ছে যে ঈদের অর্থনীতিতে বড় ধরণের লেনদেন হয়েছে যা অর্থনীতি চাঙা হওয়ার একটি প্রমাণ৷

এছাড়া রমজানন মাসে বাংলাদেশের সামর্থ্যবান মুসলমানেরা জাকাত আদায় করে থাকেন, প্রচুর দান-সাদকাহ করেন৷ এর ফলেও একদিকে বাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়ে, অন্যদিকে গরিব ও অভাবী মানুষের হাতেও কিছু টাকা আসে৷ আবার বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা এসব দানের অর্থে অভাবগ্রস্ত ও নিম্নআয়ের অনেক মানুষের জন্যে ঈদের আগে খাবার-সামগ্রী ও পোশাক কিনে বিতরণ করে৷ এভাবে বাজারে বিকিকিনি বেড়ে যায়৷

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি একটি অনুমিত হিসেব দিয়েছে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসার লেনদেনের বিষয়ে৷ তাতে বলা হয়েছে যে এবারের ঈদে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে আর তা ২০১৯ সালের তুলনায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি বলেও ধারণা করা হচ্ছে৷

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এবারের ঈদের কেনাকাটার সাথে পয়লা বৈশাখকেন্দ্রিক কেনাকাটা অনেকটাই মিশে গিয়েছে দুটি উৎসবদুই সপ্তাহের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে৷ গত দুই বছর যেখানে পয়লা বৈশাখের কেনাকাটা একেবারে স্তিমিত হয়ে পড়েছিল, সেখানে এবার তা অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তা-বিক্রেতারা৷ ফ্যাশন হাউজ রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাসের সাথে এ নিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা কাছাকাছি দুই উৎসবকে মাথায় রেখে এবার অনেকটা মিশ্র্র ধরণের পোশাক এনেছি৷ উদ্দেশ্য ছিল যারা ঈদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় নতুন কাপড় কেনেন, তারা যেন বৈশাখী পোশাককে তাদের পছন্দ হিসেবে বেছে নেন৷ আমাদের সে প্রয়াস অনেকটাই সফল হয়েছে৷’’

সার্বিক বিকিকিনির বিষয়ে সৌমিকের ভাষ্য হলো: ‘‘গত দুই বছর মানুষ খুব কমই ঘরের বাইরে গিয়ে কেনাকাটা করতে পেরেছে৷ একটা হাঁপ ধরা অবস্থা ছিল৷ এবার সে অবস্থা কেটে গেছে৷ মানুষ দোকানপাটে গিয়েছে, ঘুরেছে, পছন্দ করে কাপড় কিনেছে, প্রিয়জনদের উপহার দিয়েছে৷ অনলাইন কেনাকাটার ওপর নির্ভরতা অনেকটাই কমে গেছে৷ পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় আয়-উপার্জনও কম-বেশি বেড়েছে৷ সবমিলিয়ে বেচাকেনা মোটামুটি একটা ভাল জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে৷’’

পোশাকের মধ্যে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, লুঙ্গিসহ বাহারি জামা, জুতা থেকে শুরু করে প্রসাধন সামগ্রী বিক্রির ধূম লক্ষ্য করা গেছে৷ এই সময়ে গাড়ি ও মোটরসাইকেল বিক্রি বেড়েছে, বেড়েছে ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বিক্রি৷ ঈদের খাদ্যপণ্যের মধ্যে সেমাই ও  পোলাওর চালের বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ৷

এবারের ঈদের দীর্ঘছুটিতে সুন্দরবন ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলোয় বেড়াতে গেছেন প্রচুর মানুষ৷ এটি দেশীয় পরযটনখাতকে চাঙ্গা করায় বড় ভূমিকা রেখেছে৷ পরযটন ও বিমান চলাচল বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলমের পরযবেক্ষণ হলো, ঈদের ছুটিকে ঘিরে অভ্যন্তরীণ  পরযটন ব্যবসা যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তা প্রায় কোভিড-পূর্ব সময়ের মতো হয়েছে৷ এই লেখকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘‘দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার প্রবণতাও অনেক বেড়েছে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায়  বা শিথিল করায়৷ আবার সৌদি আরব রামাদান মাসে উমরাহ পুরোপুরি উম্মুক্ত করে দিয়েছে এবং সাওয়াল মাসের মাঝামাঝি পযরন্ত তা বহাল রেখেছে৷ ফলে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ সৌদি আরব গিয়েছেন এখনোও যাচ্ছেন৷ আবার কোভিডের কারণে গত দু'বছর দেশে আসতে পারেননি এমন বহু প্রবাসী-বাংলাদেশি এবার দেশে এসেছেন আপনজনদের সাথে ঈদ করেছে৷’’

আসজাদুল কিবরিয়া, দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার পরিকল্পনা সম্পাদক
আসজাদুল কিবরিয়া, দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার পরিকল্পনা সম্পাদকছবি: Privat

বস্তুত ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি বাংলাদেশে এতোটাই বৈচিত্র্যময় হয়েছে যে প্রায় সংশ্লিষ্ট সবখাতই এখানে কম-বেশি ব্যবসা করেছে৷ আর খুচরা ও পাইকারী ব্যবসা বাংলাদেশের মোট  দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫ শতাংশ জোগান দেয় যা টাকার অংকে গত অর্থবছর ছিল প্রায় চার লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা৷ যদি দোকান মালিক সমিতির প্রাক্কলন বিবেচনা নেয়া হয়, তাহলে ঈদের সময়ই এর ৪০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে৷ ফলে চলতি অর্থবছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়৷ বিবিএসের হিসেব অনুসারে গত ২০২০-২১ অর্থবছর যেখানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ, সেখানে সরকার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ৷ বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অবশ্য পূর্বাভাস দিয়েছে যে এবছরও প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের নিচে থাকবে৷ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্ব বাণিজ্যের গতি কমা এবং জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা স্পষ্ট৷ এমন অবস্থায় ঈদকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তেজীভাব ও দেশজ ভোগব্যয় বেড়ে যাওয়া বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গতিময়তা ধরে রাখায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে৷ কেননা,  বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বহুলাংশেই চালিত হয় ভোগব্যয় দ্বারা, যদিও আয়ের বৈষম্যের কারণে ভোগব্যয়েও যথেষ্ট বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়৷

ঈদের দিন ঢাকা শহরের চিত্র যেমন ছিল...

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য