1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইতিহাস গড়া মানবীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ!

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২৯ নভেম্বর ২০১৮

ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক নাবালককে বৃহন্নলাবৃত্তিতে নামানোর অভিযোগ উঠলো ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের ভাইস চেয়ারপার্সন, অধ্যক্ষ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে৷ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি৷ তবে বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়ছে না৷

https://p.dw.com/p/398SA
ভারতের ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ছবি: picture alliance/AP Photo

কয়েক মাস আগে কলেজের অধ্যাপক-শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তালা বন্ধ করে রাখার অভিযোগ উঠেছিল কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের অধ্যক্ষ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে৷ এবার তাঁর বিরুদ্ধে আরো চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠল৷ মুর্শিদাবাদের ১৭ বছরের এক কিশোর ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের চেয়ারপার্সনের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছে যে, তাকে জোরপূর্বক বৃহন্নলা বৃত্তিতে নামিয়েছেন মানবী৷ এ কাজে অঞ্জলি মণ্ডল নামে এক বৃহন্নলার সঙ্গে মানবীরও ভূমিকা রয়েছে বলে তার অভিযোগ৷

মুর্শিদাবাদ জেলার নওদা থানার বাসিন্দা দ্বাদশ শ্রেণীর ওই ছাত্র আদতে রূপান্তরকামী, অর্থাৎ ছেলে হিসেবে জন্ম নিলেও সে নিজেকে মেয়ে বলেই মনে করে৷ ফেসবুকের সূত্রে মানবীর সঙ্গে ওই কিশোরের আলাপ৷ ক্রমশ তাদের আলাপের পরিসর বাড়ে৷ কিশোরের অভিযোগ অনুযায়ী, গত ৫ সেপ্টেম্বর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ি থেকে৷ পরে প্রশাসনের মধ্যস্থতায় আবার বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়৷ উচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট চলার সময় গত ১৯ নভেম্বর ফের বাড়ি থেকে চলে যায় ওই কিশোর৷ ডয়চে ভেলেকে তার মা বলেন, ‘‘আমি অনুমান করি, মানবীই ছেলেকে কোথাও নিয়ে গিয়েছেন৷ ১৯ নভেম্বর রাতে নওদার পুলিশের সঙ্গে আমি কৃষ্ণনগর কলেজে মানবীর কোয়ার্টারে যাই৷ ছেলে কোথায় আছে, সে কথা উনি বলেননি৷ উল্টে আমাদের সঙ্গে অশ্লীল ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিয়েছেন৷ তারপর থেকে পাঁচদিন আমি শুধু কেঁদেছি৷ ছেলেকে ফিরে পেয়েছি ২৪ নভেম্বর রাতে৷’’

মানবী শুধু আমার ছেলেকে নয়, জোর করে অনেককে এই পেশায় এনেছে: অভিযোগকারীর মা

অভিযোগকারী কিশোরের মায়ের দাবি, ‘‘মানবী শুধু আমার ছেলেকে নয়, জোর করে অনেককে এই পেশায় এনেছে৷ মধু নামে একজন আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছে৷ তাকেও জোর করে বৃহন্নলা বৃত্তিতে নামিয়েছে৷ ছেলের উপর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার করা হয়েছে৷ ও মানবীকে ফোন করে বলেছিল, এ সব কাজ করতে চায় না, পড়াশোনা করতে চায়৷ কিন্তু ওকে জোর করে গ্রামে ঘোরানো হয়েছে বৃহন্নলাদের মতো৷ ও বাড়ি ফিরে এসে সেসব কথা আমাদের বলেছে৷’’

বৃহন্নলাদের কাছ থেকে পালিয়ে এসে ছেলেটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এসআরএস সলিউশনের কর্তা তিস্তা দাসের সঙ্গে প্রথমে যোগাযোগ করে৷ তিস্তা এ ব্যাপারে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ছেলেটি প্রথমে আমার কাছেই আসে৷ ছেলেটি বলে, আমি পালিয়ে এসেছি৷ ওর মতে, বাড়ির লোকের সঙ্গে সংঘাত বেঁধেছিল প্রথমে৷ ওকে জোর করে ছেলে করার চেষ্টা চলছিল ওর বাড়িতে৷সে জন্যই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল৷ এরপরে মানবীর কাছে ও গিয়েছিল বলে জানায়৷’’

রূপান্তরকামী এই নাবালক তিস্তার বাড়িতে উপস্থিত হয় হিজড়ার পোশাকেই৷ তিস্তা বলেন, ‘‘ছেলেটি বলে, আমি মানবী ম্যামের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলাম৷ বলেছি, পড়াশুনো চালিয়ে যেতে চাই৷ টেস্ট পরীক্ষা দিতে দিতে পালিয়ে এসেছি বলেছি৷ তখন মানবী নাকি ওকে কিছু হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে পাঠান৷ এখানেই হিজড়া সম্প্রদায়ের অঞ্জলি মণ্ডলের নাম বারবার উঠে এসেছে৷’’

ছেলেটি মানবীর কাছে আশ্রয় চেয়েছিল: তিস্তা দাস

এরপরই তিস্তার সহায়তায় ছেলেটির খবর পৌঁছে যায় ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের সদস্য তথা, ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সজেন্ডার অ্যান্ড হিজড়া ইন বেঙ্গল’- এর অধিকর্তা রঞ্জিতা সিনহার কাছে৷ তিনি বলেন, ‘‘নাবালক বলে ছেলেটির কথা শুনে ব্যাপারটা জানানো হয় শিশু অধিকার রক্ষা কমিটিতে৷ ছেলেটি অভিযোগ করেছে, মানবী ও অঞ্জলি নামে এক হিজড়ার বিরুদ্ধে৷ ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের এক মেম্বার এই অঞ্জলি৷’’   

এই অভিযোগ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ার জন্য মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করা হলেও কথা বলা যায়নি৷ তাঁর ফোন ধরে জনৈক ব্যক্তি বলেন, ‘‘অভিযোগ প্রমাণ হোক, তারপর যা হবে তা হবে৷ আপনাদের প্রতিক্রিয়া দেবার জন্য উনি বসে নেই৷ ওঁনাকে কাজ করে খেতে হয়৷ উনি এখন প্রিন্সিপালের চেয়ারে৷ আপনাদের ফোন ওঁনাকে বিরক্ত করে৷’’ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য অভিযোগ খারিজ করে দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন৷ এক দৈনিকের সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তিনি৷ সেখানে তিনি দাবি করেন, মিথ্যা খবর পরিবেশন করে তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছে৷ চিঠিতে তিনি  আরো লিখেছেন, ‘‘মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, আমার প্রাণপ্রিয় দিদির স্নেহ থেকে বঞ্চিত করার জন্যই এই ষড়যন্ত্র৷’’ তিনি দাবি করেন, তাঁকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়ার জন্যই এ মিথ্যা অভিযোগ  তোলা হয়েছে৷ ভারতের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার কলেজ অধ্যক্ষ অবশ্য চিঠি শেষ করেছেন আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণে৷ লিখেছেন, ‘‘আমায় খুন করতে পারবেন, আত্মহত্যা করাতে পারবেন না৷’’

ছেলেটি মানবী ও অঞ্জলি নামে এক হিজড়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে: রঞ্জিতা সিনহা

ফেসবুকে আরেক পোস্টে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘‘আমি খুব নিশ্চিত, মিথ্যা মামলা বা মিথ্যা হামলা যদি সুনিপুণ সাজিয়ে আমায় ফাঁসি দেওয়া হয়, আমি হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরে নেবো৷ আমার ভালো লাগছে শিক্ষিত ট্রান্সজেন্ডার ট্রান্সওম্যান থেকে অসহায় বৃহন্নলারা আমার ফেসবুকে আমার পাশে আছেন বলে জানিয়েছেন৷’’

তৃতীয় লিঙ্গের সমাজে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় পুরোধা ব্যক্তিত্ব৷ তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠায় অনেকেই হতবাক৷ সোশাল মিডিয়ায় শুরু হয়ে গেছে দলাদলি৷ পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের মন্তব্য শোনা যাচ্ছে৷

ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিনহা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ছেলেটার বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলি৷ মা-বাবা ধরেই নিয়েছিলেন যে, ছেলে পাচার হয়ে গিয়েছিল৷ আমরা চাই ছেলেটি যেন সুবিচার পায়৷ ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের ছাতাটা যেন ব্যবহার করা না হয়, অভিযোগের যথাযথ তদন্ত হয়৷ বিষয়টা সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেখা উচিত৷’’ রাজ্যের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী মেঘ সায়ন্তনী ঘোষ বললেন, ‘‘১৭ বছরের নাবালককে যদি জোর করে বৃহন্নলা বৃত্তিতে নামানো হয়ে থাকে, তবে তা অপরাধ৷ তবে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা উচিত৷ আমি মানবীর সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছি, তিনি কাউকে এমন প্রলোভন দেখিয়ে ব্যবহার করতে পারেন বলে মনে হয় না৷’’

এদিকে কিশোরের মা বলেন, ‘‘আমি অনেকদিনই ব্যাপারটা সন্দেহ করেছি৷ পড়াশোনা, চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ছেলেটিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে৷ কঠিন শাস্তি চাই মানবীর৷ আমি আমার ছেলের জন্য পাঁচদিন কেঁদেছি৷ যে পেশাতে ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেখান থেকে কেউ ফিরে আসতে পারে না৷’’

পশ্চিমবঙ্গে মানবী বন্দোযপাধ্যায় যথেষ্ট প্রভাবশালী৷অভিযোগ পাওয়ার পর রাজ্য শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের সদস্যরা মুর্শিদাবাদ গিয়ে কিশোরের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন৷ কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘যেরকম অন্য অভিযোগ দেখা হয়, সেভাবেই এই অভিযোগটিকে দেখা হচ্ছে৷ আমাদের কাছে কেউই তুচ্ছ নয় বা কেউই ভিআইপি নয়৷ কোনো প্রশাসনিক চাপ পাচ্ছি না৷ কাজ নিজের গতিতে এগোচ্ছে৷ কিশোরকে তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য