1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আর্সেনিকমুক্ত জলের খোঁজে পশ্চিমবঙ্গ

পায়েল সামন্ত কলকাতা
৩০ আগস্ট ২০১৮

আর্সেনিক কবলিত গ্রামগুলিতে মানুষের আয়ু কমে যাচ্ছে৷ বিকল্প নিরাপদ জলের উৎস না পাওয়ায় স্থানীয় মানুষ বিষজলই পান করতে বাধ্য হচ্ছেন৷ চিকিৎসকেরাও দিতে পারছেন না সুস্থতার আশ্বাস৷

https://p.dw.com/p/342Ml
ছবি: DW/P. Samanta

ডয়চে ভেলের কাছে এমনই অভিযোগ জানিয়েছেন নদিয়ার করিমপুরের বাসিন্দা শেখ আজাদ রহমান৷ তাঁর কথার সূত্র ধরেই ডয়চে ভেলে অনুসন্ধান করে দেখল, বিগত শতাব্দীর আটের দশ থেকে যে লাগাতার মৃত্যুমিছিল শুরু হয়েছিল, তার থেকে অব্যাহতি আজও মেলেনি কেন?

৩০ বছরেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে৷ হয়তো কেউ কথা রেখেছে বা কেউ কথা রাখেনি৷ উত্তর ২৪ পরগনার ব্লকগুলি ঘুরে আর্সেনিক রোগীদের দেখে বোঝা গিয়েছে, পরিস্থিতি পাল্টায়নি৷ তবে সেখানে এটাও চোখে পড়েছে, আর্সেনিক মোকাবিলার জন্য কম গভীরতার পুরনো নলকূপের বদলে গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে৷ বিভিন্ন ব্লকে আর্সেনিক এবং আয়রন রিম্যুভাল প্লান্ট রয়েছে৷

গাইঘাটার মধুসূদনকাটিতে পুকুরের জলকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে গ্রামবাসীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সাম্প্রতিক অতীতের রিপোর্ট অনুযায়ী, উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা ব্লকের জলে আর্সেনিকের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে৷

উত্তর ২৪ পরগনায় আর্সেনিক মোকাবিলায় যে প্ল্যান্টগুলি গড়ে তোলা হয়েছে, সেগুলির সংরক্ষণ ও নজরদারিতে ঘাটতির কথা স্বীকার করে নিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ এনভারনমেন্টাল স্টাডিজ-এর অধিকর্তা ডঃ তড়িৎ রায়চৌধুরী৷ এই আর্সেনিক ও আয়রন রিম্যুভাল প্লান্টগুলির বর্জ্য (স্লাজ) ফেলা হচ্ছে মাটিতে অথবা জলে৷ এর থেকে ফের ছড়িয়ে পড়ছে আর্সেনিক৷ এভাবে আর্সেনিক দূষণ না বাড়িয়ে সঠিক পদ্ধতি মেনে চলার কথা বলেন তিনি৷ মাটি বা জলে ফেলার পরিবর্তে স্লাজ যদি গোবরের ওপর ফেলা যায়, তবেই সেটা ঠিক কাজ হবে, বলে জানালেন ডঃ রায়চৌধুরী৷  

পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গা বিধৌত এলাকায়, বিশেষ করে উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ, মালদা, নদিয়ায় আর্সেনিক দূষণ একটা ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে৷ সেই নিরিখে আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশে এই আর্সেনিক রিম্যুভাল প্লান্ট কি ব্যয়সাপেক্ষ?

এ সব ক্ষেত্রে অর্থের থেকেও জনগণের সদিচ্ছার যে অভাব, সেটার কথাই বললেন কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বিজ্ঞানী ড. রীতা সাহা৷ তিনি বলেন, ‘‘আর্সেনিকমুক্ত জলের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফেও অনেক চেষ্টা করা হয়েছে৷ বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে দুই হাজারের বেশি উন্নত প্ল্যান্ট বসানো হয়েছিল, যাতে একসঙ্গে অন্তত তিনটি গ্রাম আর্সেনিকমুক্ত জল পেতে পারে৷ এজন্য ক্লাবগুলিতে অনেক টাকা এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়৷ কিন্তু, মানুষ সেটা চালাতে পারেনি৷''

তাঁর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, স্কুল, কলেজগুলিতে টিউবওয়েলের সঙ্গে আর্সেনিক ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টও বসানো হয়েছিল৷ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল৷ কিন্তু ধৈর্য, সংরক্ষণ ও নজরদারির অভাবে সেগুলিও নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ এখন তাই সরকারি তরফে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ভ্রাম্যমাণ যানের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে পানীয় জল বিতরণ করা হয়৷

রীতা সাহা বলেন, মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশই তাকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে৷ আর্সেনিক দূষণের নেপথ্যে রয়েছে লাগামছাড়া নগরায়ণ ও পরিকাঠামো নির্মাণ৷ কৃষিকাজের জন্য দেদার জল উত্তোলনকেও দায়ী করতে হবে৷ এজন্য সবার আগে মানুষকে সচেতন হতে হবে৷ সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে বলে জানান এই বিজ্ঞানী৷ রীতা সাহা প্রশ্ন তোলেন, ‘‘সরকার থেকে তো অনেক কাজই করা হচ্ছে৷ নিয়মিত কাজ করে চলেছে খড়গপুর আইআইটি, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ৷ কিন্তু তা বলে জনগণের দায়িত্ব থাকবে না?''

কিন্তু, এখন আর্সেনিকের সমস্যা এতটাই মারাত্মক হয়ে গিয়েছে যে, স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের উপর ভরসা রাখার পরিবর্তে ভূপৃষ্ঠের জল ব্যবহারকে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া উপায় নেই, বলে এমনটাই মনে করেন ড. তড়িৎ রায়চৌধুরী৷ তিনি এ ব্যাপারে বলেন, ‘‘গ্রাউন্ড ওয়াটার বা ভূগর্ভস্থ জল কোনোভাবেই আর্সেনিক থেকে মুক্তির পথ হতে পারে না৷ এজন্য দরকার ভূপৃষ্ঠের জল৷ অর্থাৎ নদী, নালা, খালবিলের জল৷ এই জল পরিশ্রুতকরণের মাধ্যমেই মিলবে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল৷''

ড. তড়িৎ রায়চৌধুরী

দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে আর্সেনিক নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন এই বিজ্ঞানী৷ উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা ব্লকের সুটিয়া বিষ্ণুপুর, তেঘরিয়া, ইছাপুর ১ ও ২, জলেশ্বর ১ এলাকায় গিয়ে তিনি সরেজমিনে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, এ অঞ্চলে গভীর নলকূপ খনন করে বা প্ল্যান্ট বসিয়েও বিশেষ লাভ নেই৷ তাঁর মতে, বরং নদীনালার পাশাপাশি বৃষ্টির জলকে কাজে লাগানো উচিত৷ এ রাজ্যে বার্ষিক ২ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়, সেটা নষ্ট হয়ে যায়৷ গভীর জলাশয় খনন করে বৃষ্টির জলকে ব্যবহার করাটাই ভালো উপায়৷ সেজন্যই রাজ্য সরকারের ‘জল ধরো জল ভরো' কর্মসূচি বা গঙ্গার জল পাইপে করে সরবরাহ করা বেশি নিরাপদ৷ সরকারি তরফে টাস্ক ফোর্স গঠন করে এ নিয়ে কাজও চলছে৷''

এ প্রসঙ্গে গাইঘাটা সমবায় কৃষি উন্নয়নের সম্পাদক দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘গঙ্গার জল পরিশুদ্ধ করে পাইপলাইনের মাধ্যমে সেই জল বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে৷ আশা করি, খুব তাড়াতাড়িই সেই কাজ শেষ হবে৷''

পশ্চিমবঙ্গ আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটির রাজ্য সম্পাদক অশোক দাস অবশ্য অভিযোগ করেন, ‘‘সরকার তো আর্সেনিক দূষণ ঠেকাতে টোটকা দাওয়াই দেয়৷ ভূপৃষ্ঠের জলের বদলে দুটো নলকূপ খনন করাটা মোটেই সমাধান হতে পারে না৷ উপরন্তু সেগুলি নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরীক্ষা করাও হচ্ছে না৷''

ড. তড়িৎ রায়চৌধুরীর কথা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহারের ফলে শুধু পানীয় জলে নয়, কৃষিজ ফসল, এমনকি ধানেও আর্সেনিক ছড়াচ্ছে৷ এর মানে, প্রতিনিয়ত আর্সেনিক বিষ গ্রহণ করে চলেছে সব মানুষই৷ অন্যদিকে কয়েক দশক ধরে যারা প্রতিদিন অল্প অল্প করে পানীয় জল ও খাদ্যে আর্সেনিক গ্রহণ করেছেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ কিডনি বা লিভারের জটিল অসুখ অথবা ক্যানসার৷

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এমনিতে আর্সেনিক আক্রান্তদের তেমন চিকিৎসা নেই৷ দেগঙ্গার গোষ্ঠ দাসের মতো রোগীদের জন্য পরিশুদ্ধ জল ও প্রোটিনযুক্ত ডায়েটই একমাত্র চিকিৎসা৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটির সূত্রে জানা গেছে, জেলার জেনারেল ফিজিশিয়ানরা আর্সেনিক রোগীদের শনাক্ত করতে পারেন না৷ এ প্রসঙ্গে অশোক দাস বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে জলে অল্প মাত্রায় আর্সেনিক গ্রহণের ফলে শরীরে যে রোগ সৃষ্টি হয়, তা অধিকাংশ ডাক্তারই নির্ণয় করতে পারেন না৷ এমবিবিএস পাঠক্রমে এর পঠনপাঠন থাকলে অবস্থার পরিবর্তন হতে পারত৷''

বিশিষ্ট চিকিৎসক ফুওয়াদ হালিম এ ব্যাপারে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কথাটা ঠিকই৷ তবে এমবিবিএস পাঠক্রমে এই বিষয়ে পড়ানো হয়৷ কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, বাস্তব জীবনে এর ব্যবহারিক প্রয়োগ তেমন না থাকায় চিকিৎসকেরা এই রোগ নির্ণয় করতে হোঁচট খান৷ তবে এটা শুধু আর্সেনিকের ক্ষেত্রে নয়, অন্য রোগের ক্ষেত্রেও ঘটে৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য