1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রোহিঙ্গারা যেমন আছেন

১৮ অক্টোবর ২০১৮

পালানোর আগে ফাতিমা একাধিকবার ধর্ষিত হয়েছিলেন৷ এখন তিনি বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকেন৷ অতীত জীবনে ফিরে যাবার বা নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই স্থির করার কোনো আশা তাঁর নেই৷

https://p.dw.com/p/36jtE
ফাতিমাছবি: DW/I. Pohl

প্লাস্টিকের সাদা চালের উপর বৃষ্টির শব্দের ছন্দ ছাড়া অন্য কিছুই শোনা যাচ্ছে না৷ নেই টেলিভিশন বা সংগীতের শব্দ, নেই শিশুদের কলকাকলি৷ বিশেষ করে কক্সবাজারের রাস্তায় যানজটের অভিজ্ঞতার পর সেই নীরবতা যেন আরো সরব হয়ে ওঠে৷ গাছে লাগানো রুপালি রংয়ের মাইক থেকে আযানের ডাক সেই নীরবতা ভেঙে দেয়৷

কুতুপালংয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরের উত্তর-পূর্বে ৭ নম্বর ক্যাম্প৷ প্রায় এক বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ৪০,০০০ মানুষ বসবাস করেন৷ এই সংখ্যা আনুমানিক৷ ঠিক কত সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমারের সীমান্তের কাছে এই এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন, কেউ তা নিশ্চিত করে বলতে পারেন না৷ বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ রয়েছেন৷ ১২ লক্ষ বা তার চেয়ে বেশি মানুষও থাকতে পারেন৷ একেক জন একেক রকম হিসেব দেন৷

৭ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেয়েছেন৷

মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়

গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন৷ তবে গত বছরের মতো একসঙ্গে এত মানুষের দেশত্যাগ আগে দেখা যায় নি৷ হিংসাত্মক তাণ্ডবের মুখে কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় ৭ লক্ষ নারীপুরুষ মিয়ানমার ত্যাগ করেছেন৷ কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তার কোনো হিসেব নেই৷ তবে উপমহাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এত বড় গণহত্যার দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই৷

Bangladesch Rohingya Flüchtlings Camp
৭ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেয়েছেনছবি: DW/I. Pohl

ফাতিমাও প্রাণে বেঁচে গেছেন৷ তিনি আঙুল দিয়ে দাঁত ঘষছেন৷ তামাক ও পান চিবানোর ফলে মাড়িতে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে৷ তবে এভাবে নেতিবাচক স্মৃতি কিছুটা হলেও ভুলে থাকা যায়৷ নখ চিবানোর ফলে কিছু আঙুলে মাংসও বেরিয়ে পড়েছে৷

দুটি ছোট সন্তান

ফাতিমার বয়স ২০৷ তাঁর দুই পুত্রসন্তান রয়েছে৷ মিয়ানমার থেকে পালানোর আগে তিনি ৩০ থেকে ৪০ বার ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন৷ একই রাতে সেই অত্যাচার চলেছিল৷ কতজন পুরুষ কতবার ধর্ষণ করেছিল, তা আর মনেও নেই৷ ক্ষীণ কণ্ঠে ও শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘নিজের শরীরটা সেখানেই রেখে এসেছি৷’’ চোখ মেলালেও তাঁর নাগাল পাওয়া যায় না৷ মনে হয়, যেন কালো চোখের মধ্যে কোনো জানালা বন্ধ হয়ে গেছে৷

কুটিরে ঢোকার মুখে কামরায় গালিচার উপর আমরা বসে আছি৷ ছোট একটি প্লাস্টিকের মোড়াও রয়েছে৷ তাঁর স্বামী আলির বয়স ২ বছর বেশি৷ মিলিশিয়া বাহিনী আগমনের পর প্রাণ বাঁচাতে অনেকের মতো তাঁকেও গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল৷ নিজের স্ত্রী, সদ্যজাত সন্তান ও ১৪ মাসের বড় ছেলেকে নিজের বাবা-মা'র কাছে রেখে যেতে হয়েছিল৷ সে প্রায় এক বছর আগের ঘটনা৷

অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী নারীর একই দশা হয়েছিল৷ কয়েক রাত পরে তাঁরা ফাতিমাকে জঙ্গলে নিয়ে তাঁর শরীর ছিঁড়ে খেয়েছিল৷ আরো নারী তাদের হাতে বন্দি ছিলেন৷ আশেপাশের গ্রাম থেকেও আরো নারী ধরে আনা হয়েছিল৷ দুষ্কৃতিরা বারবার তাঁদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল৷ কেউ তাঁদের কাতর কণ্ঠ বা আর্তনাদ শুনতে পায়নি৷ তাঁদের স্বামী বা ভাইরা, যাঁরা তাঁদের বাঁচাতে পারতেন, তাঁরা হয় নিহত অথবা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গিয়েছিলেন৷ আলিও তাঁদেরই একজন৷

Symbolbild Indien Bangladesh Grenze
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা অনেক নারীরই ফাতিমার মতো অভিজ্ঞতা হয়েছেছবি: picture-alliance/NurPhoto/ R. Asad

ফাতিমা কোনোক্রমে নিজের গ্রামে ফিরে আসতে পেরেছিলেন৷ পথে চিকিৎসার ফলে তাঁর ক্ষতগুলির কিছুটা নিরাময় হয়েছিল৷ তা না হলে রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হতো৷ সম্ভবত তিনি আর কোনোদিন মা হতে পারবেন না৷

শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে তিনি সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন৷ আন্তর্জাতিক সাহায্যকারী সংগঠনগুলি আলিকে খুঁজে পেতে সহায়তা করেছিল৷ আলি বলেন, স্ত্রীর কাছে থাকতে তাঁর কোনো সমস্যা নেই৷ কারণ, সে তো স্বেচ্ছায় সেটা করেনি৷

ধর্ষিতা স্ত্রীদের প্রায়ই ত্যাগ করা হয়

‘সেটা’ বলতে গণধর্ষণ বোঝানো হয়৷ সত্যি অনেক রোহিঙ্গা তাঁদের ধর্ষিতা স্ত্রীদের সন্তানসহ ত্যাগ করেছেন৷ মনে কষ্ট নিয়ে স্ত্রীদের সেই পরিস্থিতি মেনে নিতে হয়৷ অন্য পুরুষের হাতে এমন দশা ও মর্যাদাহানির কারণ দেখিয়ে স্বামীরা এমনটা করে থাকেন৷

পশ্চিমা সমাজে বড় হয়ে ওঠা কোনো নারীর পক্ষে অনেক কিছুই অসহ্য ও অচেনা মনে হয়৷ যেমন, নারীরা তাঁদের কুটির ছেড়ে প্রায় বেরই হন না৷ এমনকি বাংলার অসহনীয় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি পেরিয়ে গেলেও নয়৷ রেড ক্রসের কর্মীদের ভাষায় ‘‘কোনো আইন নয়, নিজস্ব ঐতিহ্যের কারণেই তাঁরা এমনটা করেন৷’’ রোহিঙ্গা সংস্কৃতিতে বাধ্য না হলে কোনো নারী বাসার বাইরে যান না৷

Bangladesch Rohingya Flüchtlings Camp
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরছবি: DW/I. Pohl

ক্যাম্পের মধ্যে নিরাপদ জায়গা

শুধু নারীদের জন্য নির্ধারিত জায়গাগুলিতে কিছু শান্তি পাওয়া যায়৷ গোটা ক্যাম্প জুড়ে ১৯টি এমন কুটির গড়ে তোলা হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলি সেখানে সক্রিয় রয়েছে৷ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকায় কিছু নারী এমন পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ জায়গায় কয়েক ঘণ্টা সময় কাটানোর সাহস দেখান৷ বিদ্যুৎ সংযোগ চালু থাকলে ফ্যানও চলে৷ সেখানে চালু টয়লেটও রয়েছে, রয়েছে শিশুদের স্নান করানোর ব্যবস্থা৷

টিলার উপর থেকে হৃদয়বিদারক এক দৃশ্য চোখে পড়ে৷ অসংখ্য কুটিরের সারি, বাঁশের খুঁটির উপর প্লাস্টিকের ত্রিপলের দেওয়াল, কখনো ত্রিপলের ছাদ৷ সামান্য কয়েকটি কুটিরে টিনের চাল রয়েছে৷

আপৎকালীন আশ্রয়

আচমকা ৭ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে যেসব ‘বেআইনি’ ক্যাম্প তৈরি করতে হয়েছিল, ফাতিমা ও আলি সেগুলির মধ্যে একটিতে থাকেন৷ প্রাথমিক আপৎকালীন আশ্রয়ের জন্য এমন জায়গা উপযুক্ত হতে পারে, দীর্ঘকালীন বাসস্থান হিসেবে নয়৷

কিন্তু ফাতিমা ও আলির মনে সেই প্রত্যাশাই কাজ করছে৷ মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় নথিপত্র দেবার বা দেশে ফেরানোর কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না৷ বৈধ নথিপত্র না থাকায় রোহিঙ্গাদের সরকারিভাবে রাষ্ট্রহীন হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে৷ বাংলাদেশের সরকারের বদান্যতার উপর তাঁদের নির্ভর করতে হচ্ছে৷

ক্যাম্পের মধ্যে তাঁরা আপাতত নিরাপদ রয়েছে৷ কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ফাতিমাকে অবশ্যই ভাবাচ্ছে৷

‘আমাকে ট্যাবলেট খেয়ে ধর্ষণ করেছে’

সহানুভূতি কমছে

নিপীড়ন কী, বাংলাদেশের মানুষ তা ভালোভাবেই জানেন৷ সে দেশের ইতিহাসে বার বার পলায়ন ও বিতাড়নের ঘটনা ঘটেছে৷ প্রথমদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সহানুভূতি দেখা গিয়েছিল৷ কিন্তু সেই মনোভাব ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে৷ অনেকের মনে হচ্ছে, বহিরাগতদের সহায়তা করতে বাংলাদেশ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পদক্ষেপ নিয়েছে৷ নিয়মিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় নিজেদের দেশের মধ্যে সহায়তা করার জন্য যথেষ্ট উদ্ধারকর্মী পাওয়া যায় না৷ বেড়ে চলা মাদক ও অন্যান্য পণ্যের চোরাচালান বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক পুলিশকর্মীও নেই৷

তরুণ মুসলিমদের ব়্যাডিকাল ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার ঘটনাও বাড়ছে৷ কারণ, নৈরাশ্যে ভরা ক্যাম্পের জীবনযাত্রার কারণে তাদের প্রভাবিত করা অত্যন্ত সহজ৷ সরকারিভাবে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ত্যাগ করার নিয়ম নেই৷ শিশুরা মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষা পায়৷

সবকিছু হারানোর অনন্ত কষ্ট

এভাবে কতদিন চলবে? ফাতিমার মনে শুধু একটাই ইচ্ছা৷ তিনি নিজের ভিটেমাটিতে ফিরে যেতে চান৷ সেই রাতে তিনি যা হারিয়েছিলেন, হয়তো তা ফিরে পাবার আশা তাঁর মনে কাজ করছে৷ অথবা বিদেশের মাটিতে নতুন করে জীবন শুরু করার শক্তি তাঁর হয়তো নেই৷

প্লাস্টিকের ত্রিপলের উপর বৃষ্টির শব্দ এখনো শোনা যাচ্ছে৷ সবকিছু হারানোর অনন্ত অনুভূতির মাঝে এ যেন অপেক্ষার ছন্দ৷

ইনেস পোল/এসবি

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য