1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আঙুলটা নিজের দিকেও তুলুন

গৌতম হোড়
২০ এপ্রিল ২০২০

লকডাউনের বাজারে দিল্লিতে সিল হয়ে যাওয়া এলাকার লোক সরকারের কাছে বিরিয়ানি, গরম সিঙাড়া, মিষ্টি দাবি করছেন।

https://p.dw.com/p/3bATe
ছবি: Reuters/P. Ravikumar

দাবিটা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন সরকারি কর্মীরা। লকডাউন চলছে। তার ওপর দিল্লির ৭৬টি এলাকা সিল করে দেওয়া হয়েছে। দাবিটা এসেছে সেই সিল করে দেওয়া এলাকার লোকেদের কাছ থেকে। সিল করে দেওয়া এলাকায় কেউ ঢুকতে পারছেন না। কেউ বাড়ি থেকে বেরতে পারছেন না। এলাকায় একাধিক ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বাকিদের করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। সেখানে সরকারি কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকের কাছ থেকে জেনে আসছেন, কী দরকার। সেইমতো জিনিস সরবরাহ করছেন তাঁরা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। যে সব এলাকায় সিলিং করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে লোকেদের করোনা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাতে কী হয়েছে, সরকারি কর্মীদের কাছে তাঁদের দাবি হলো, চিকেন বা মটন বিরিয়ানি দিতে হবে। দিতে হবে গরম গরম সিঙাড়া, এখানে যার নাম সামোসা। সেই সঙ্গে দিতে হবে মিষ্টি, বিশেষ করে বুন্দির লাড্ডু, বরফি বা জিলিপি। কোথাও বা লোকের দাবি, ছোলে-বাটুরে দিতে হবে। লকডাউন ও সিলিং এর মধ্যে থাকা লোকেদের এই দাবি শুনেই মাথায় হাত সরকারি কর্মীদের। লোকেদের তাঁরা সবিনয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, শুধু অত্যাবশ্যকীয় অতি প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া আর কোনও কিছু সরবরাহ করা সম্ভব নয়। জবাবে ওই লোকেরা যে খুব একটা খুশি হননি তা বলাই বাহুল্য।

তার মানে কি এই করোনার ভয়াবহতার কথা লোকের মাথায় ঢুকছে না? করোনার সঙ্গে লড়াই কী করে করা যায়, সেটাও তাঁরা বুঝতে পারছেন না? না কি, সব জেনেশুনেও তাঁরা ন্যূনতম দায়িত্ববোধের পরিচয়ও দিতে পারছেন না। মনে করছেন, এই লড়াইটা কেবল সরকার লড়বে, তাঁদের কিছু করার নেই। না হলে এমন চিন্তা কী করে আসে? কী করেই বা তাঁরা বিরিয়ানি, গরম সিঙাড়া, মিষ্টির দাবি করতে পারেন?

দিল্লির সিলিং এলাকার লোকেরা একা নন। কলকাতার এক ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের অভিজ্ঞতা হলো, করোনার ভয়ে কর্মীরা আসছেন না। তাঁকে ক্যাশ কাউন্টার সামলাতে হচ্ছে। একজন প্রবীণ বা সিনিয়ার সিটিজেন পাসবুক ও পাঁচশ টাকা নিয়ে এসে তাঁকে দেন। তিনি অ্যাকাউন্ট খুলে দেখেন সেখানে সাড়ে পাঁচ লাখেরও বেশি টাকা আছে। অবাক হয়ে ম্যানেজার প্রশ্ন করেন, অ্যাকাউন্টে তো প্রচুর টাকা রয়েছে। তা হলে এই করোনার বাজারে আসার দরকার কী? বয়ষ্ক মানুষটি জবাব দিয়েছেন, বাড়িতে বসে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। তাই তিনি বেরিয়ে পড়েছেন। পাসবুক হাতে নিয়ে এলে পুলিশ ধরবে না। তাই ব্যাঙ্কে এসে অকারণে টাকা জমা দিচ্ছেন।

অর্থাৎ, সেই একই কাহিনি। দায়িত্বহীন, কান্ডজ্ঞানশূন্য মানুষদের কথা। যাঁরা এতদিনেও বুঝতে পারলেন না করোনা কতটা ভয়ঙ্কর। কীভাবে তা ঝটিতে ছড়িয়ে পড়ে। পুরো দেশের অর্থনীতির কথা না ভেবে লকডাউন কি শুধু শুধু জারি করেছে সরকার? করোনা ঠেকাবার দায়িত্ব সরকারের যতটা, সাবধানে থাকার, করোনা না ছড়ানোর দায়িত্ব নাগরিকদের তার থেকে বেশি বই কম নয়।

কলকাতার একটি বাজারের ঘটনায় আসা যাক। বাজার কমিটি তা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন? একেক জন দুই-তিন ঘণ্টায় চার থেকে পাঁচবার বাজারে যাচ্ছেন জিনিস কিনতে। সেখানে সামাজিক দূরত্ব রাখা সম্ভব হচ্ছে না। রোববার কলকাতায় খাসির দোকানে মাংস কেনার লাইনের ছবি তো গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। রোববার বাঙালির পাতে মাংস থাকবে না, এই চিন্তাটা তো করোনার বাজারে কিছুদিনের জন্য ছাড়া যেতে পারে।

একটা অদ্ভুত মানসিকতায় আক্রান্ত লোকে। কোনও সন্দেহ নেই, লকডাউন একেবারে নতুন বিষয়। আগে সারা দেশ জুড়ে এত লম্বা সময় ধরে লকডাউন হয়নি। কিন্তু আমরা তো একটা অস্বাভাবিক সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। তার বাধ্যবাধকতা তো মানতে হবে। বাড়িতে থাকতে ভালো লাগছে না বলে বেড়িয়ে পরে নিজের ও অন্যদের বিপাকে ফেলার প্রবণতা কি কয়েক মাসের জন্য ছাড়া সম্ভব নয়?

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

বিভিন্ন রাজ্যে লোকের মধ্যে আশ্চর্য বেপরোয়া মনোভাব দেখা যাচ্ছে। বেঙ্গালুরুর একটি এলাকা করোনার জন্য সিল করে দেওয়া হয়েছে। তারপরেও সেখানে ১৫ জনের শরীরে করোনার লক্ষণ পাওয়া গিয়েছে। তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারি কর্মীরা গিয়েছিলেন। যাঁদের লক্ষণ দেখা দিয়েছে, তাঁরাও যেতে রাজি ছিলেন। কিন্তু স্থানীয় লোকেরা এসে পাথর ছুড়তে থাকেন। ব্যারিকেড ভেঙে দেন। সরকারি কর্মীদের মারতে যান। পুরো এলাকা রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। সোমবার সকালে সেখানে ৪৯ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এটা হচ্ছে করোনার সময় চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। সরকারি কর্মী, যাঁরা নিজের জীবন বাজি রেখে কাজ করছেন। করোনার লক্ষণ থাকা লোকেদের নিয়ে কোয়ারান্টিনে রাখার জন্য এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে এই রকম ব্যবহার করা হবে?

অন্তত একটা কথা মনে রাখা দরকার। এটা পিকনিকের সময় নয়। হিরোগিরির সময় নয়।  বিপদের সময়। এমন বিপদ বিশ্ব আগে কখনও দেখেনি। প্রতিটি দেশ এই বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজছে। সেই সময় শুধু পিকনিকের চিন্তায় মশগুল থাকলে তা হবে আগ্নেয়গিরর শিখরে পিকনিক। কখন যে তাঁরা হঠাৎ আগ্নেয় বিস্ফোরণে শেষ হয়ে যাবেন, বুঝতেই পারবেন না। তাই দিনভর সরকারের দোষ না খুঁজে, আয়নায় একবার নিজের চেহারাটাও দেখা উচিত। দেখা উচিত, নিজে কতটা দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন।