অ্যান্ডি স্পিরার ছবিতে রণাঙ্গনের মানুষের জীবন
ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, নাইজেরিয়া, বলতে গেলে সর্বত্র, সব ধরনের সংকট আর সংঘাতের মধ্যেই গেছেন অ্যান্ডি স্পিরা৷ ফিরে এসেছেন নাড়া দেওয়া, সাড়া তোলা সব ছবি নিয়ে৷
সংঘাতের শিল্পী অ্যান্ডি স্পিরা
অ্যান্ডি স্পিরা’র জন্ম ১৯৮৪ সালে, জার্মানির হাগেন শহরে৷ স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি দক্ষিণ অ্যামেরিকা আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফর করেন ও ফটোগ্রাফির নেশা আবিষ্কার করেন৷ বারংবার সংকটপীড়িত এলাকায় গেছেন৷ ছবি তোলেন শুধুমাত্র সাদা-কালো৷ দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে কাজ করতে পছন্দ করেন৷ বহু নাম-করা পত্রপত্রিকায় তাঁর ছবি বেরিয়েছে৷
দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প ‘কাশ্মীর’
কাশ্মীরে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তকে সামরিক বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে অস্ত্রবহুল এলাকা বলে বিবেচনা করা হয়৷ কাশ্মীর সংঘাতে ১৯৮৯ সাল থেকে প্রায় ৭০,০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷ তাঁর ‘কাশ্মীর’ নামধারী দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের জন্য ২০১০ সালের ‘লাইকা অস্কার বারনাক পুরস্কার’ পেয়েছেন স্পিরা৷ ‘‘ছবিতে যে দু’টি ছেলেকে দেখা যাচ্ছে, তারা সহিংসতা ছাড়া আর কিছু চেনে না,’’ বলেছেন স্পিরা৷
যুদ্ধ চলে, কিন্তু জীবন থেমে থাকে না
২০১৪ সালের মে মাসে আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফের সুবিখ্যাত নীল মসজিদে শুক্রবারের নামাজ পড়ার এই দৃশ্যটির ছবি তোলেন অ্যান্ডি স্পিরা৷ পঞ্চদশ শতাব্দির এই মসজিদটিকে আফগানিস্তানের পবিত্রতম মসজিদ বলে গণ্য করা হয়ে থাকে৷ স্পিরা সাদা-কালোয় ছবি তোলেন, কেননা এই পন্থায় নাকি অন্তর্নিহিত আবেগ-অনুভূতি আরো জোরালোভাবে প্রকাশ পায়৷
ফ্রন্টের কাছে মেয়েদের স্কুল
২০১৪ সালের জুন মাসে স্পিরা মাজার-ই-শরিফের এই স্কুলটির ছবি তোলেন৷ প্রথমেই চোখে পড়বে, ছবিটা ঠিকমতো ফোকাস করা নেই, সেই সঙ্গে রয়েছে বিক্ষিপ্ত আলো৷ ‘‘আলো-আঁধারির মাঝের এই অনির্দিষ্ট স্থানটিতেই আবেগ-অনুভূতি এসে বাসা বাঁধে,’’ বলেন স্পিরা৷
প্রাচ্যের বাজার
তালেবান আক্রমণের ভয় থাকা সত্ত্বেও আফগানরা বাজারে যান কেনাকাটা করতে৷ ২০১৫ সালের মে মাসে স্পিরা মাজার-ই-শরিফের বাজারে এই ছবিটি তোলেন৷ তিনি যুদ্ধের রোমহর্ষক ছবি না তুলে, রণাঙ্গণের আশেপাশে জীবন যেরকম, তা’ই দেখাতে চেয়েছেন৷
সিরিয়া-ইরাক সীমান্তে
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে পালাতে আকুল হাজার হাজার মানুষ৷ ইরাক আর সিরিয়ার সীমান্তে ফিশ খাবুর দিয়ে দু’লাখের বেশি মানুষ ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়েছেন৷ স্পিরার ছবিটি সেখানেই তোলা৷
উদ্বাস্তু শিবির
...সিরিয়া থেকে যারা বেরোতে পেরেছেন, তাদের লক্ষ্য হলো, সীমান্তের কাছাকাছি কোনো উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় পাওয়া৷ যুদ্ধের তীব্রতা অনুযায়ী প্রতিদিন একশ’ থেকে বেশ কয়েক হাজার উদ্বাস্তু এই বেসরকারি সীমান্ত পারাপার কেন্দ্র দিয়ে পার হন৷ তারপর জাতিসংঘের উদ্বাস্তু ত্রাণ সংস্থা ইউএনএইচসিআর তাদের বাসে করে বিভিন্ন শিবিরে পাঠায়৷ উদ্বাস্তুদের আগমনের দৃশ্যও ধরা রয়েছে স্পিরার ক্যামেরায়৷
রণাঙ্গণের ছবি বিশেষ তোলেন না
বস্তুত স্পিরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন৷ সংঘাতের অপর কোনো মুখচ্ছবি দেখানোই তাঁর উদ্দেশ্য৷ কিন্তু এই ছবিটি স্পিরা তুলেছেন উত্তর সিরিয়ার র’স আল-আইনের ফ্রন্টলাইনে৷ এখানে সবাই সবার বিরুদ্ধে লড়ছে, কুর্দিরা লড়ছে আরবদের বিরুদ্ধে, তুর্কিরা কুর্দিদের বিরুদ্ধে, ইসলামপন্থিরা খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে আর সবাই আসাদ প্রশাসনের বিরুদ্ধে৷ ‘‘বাইরে থেকে এ যুদ্ধের মাথামুণ্ডু বোঝা দায়,’’ বলেন স্পিরা৷
ইরাকের সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানরা
২০১১ সালের জুন মাসে অ্যান্ডি স্পিরা ইরাকের আল হামদানিয়ায় এক নিহত ব্যক্তিকে কবর দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন৷ শহরটির ৯৮ শতাংশ বাসিন্দা খ্রিষ্টান ও সিরীয়-ক্যাথলিক বা সনাতনপন্থি সিরীয় গির্জার সদস্য৷ ২০১৪ সালের আগস্ট থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত আল হামদানিয়া আইএস-এর হাতে ছিল, যখন বহু খ্রিষ্টান বাসিন্দাদের পালানো ছাড়া আর কোনো পথ থাকেনি৷
নাইজেরিয়ার বোকো হারাম
স্পিরা বহুবার নাইজেরিয়ায় গেছেন এবং বেকো হারাম যেসব মেয়েদের অপহরণ করেছিল, তাদের মধ্যে ৮০ জনের ছবি তুলেছেন৷ এই প্রথম তিনি পোজ দেওয়া ছবি তোলেন৷ তিনি মহিলাদের নিপীড়িত হিসেবে দেখাতে চাননি৷ ‘‘আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে আমি এখানে আমার নিজের সীমায় পৌঁছেছি,’’ বলেন স্পিরা৷ ‘‘কেননা এই মেয়েদের কাহিনী শুধুমাত্র একটি ছবিতে তুলে ধরা সম্ভব নয়৷’’
প্রতিবেদন: বেটিনা বাউমান/এসি
সম্পাদনা: আশীষ চক্রবর্ত্তী