অস্তিত্বের যুদ্ধে বনোবো
মানুষের সবচেয়ে নিকটাত্মীয় বনোবো৷ আবার সেই মানুষই তাদের প্রধানতম শত্রু৷ আর কয়েক হাজার বনোবো টিকে আছে কোনোরকমে৷ প্রতিনিয়ত লড়াই করছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে৷ তবে এই প্রজাতি রক্ষায় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে আফ্রিকার দেশ কঙ্গো৷
আমাদের স্বজন
গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে বিলুপ্তির পথে বনোবো৷ চার দশক আগেও এদের সংখ্যা ছিল লাখখানেক৷ আজকের দিনে এসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ হাজারে৷ তাদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে মানুষই সবচেয়ে বড় হুমকি৷ এই প্রজাতির শিম্পাঞ্জির বাচ্চাগুলো শিকার করে পোষা প্রাণী হিসেবে বিক্রি করা হয়৷ এছাড়াও প্রাণীটির মাংস চড়া দামে বিক্রি হয় বাজারে৷ আর প্রতিনিয়ত বনভূমি উজাড়ের কারণে বনোবো হারাচ্ছে তাদের বসত-ভিটা৷
সাঁতার কাটা তাদের কম্ম নয়
গোটা বিশ্বে এই প্রজাতির যত শিম্পাঞ্জি আছে সবার বসতি কঙ্গোতে৷ বিশেষ করে আফ্রিকার এই দেশটির অববাহিকা তাদের আপন আলয়৷ অববাহিকাটাও বিশাল৷ বলা হচ্ছে, এটি ফ্রান্সের চেয়ে তিনগুণ বড়৷ কঙ্গো নদীসহ পুরো অঞ্চলটি ঘিরে আছে আরো কয়েকটা নদ-নদী৷ এই অববাহিকা ছাড়া অন্য কোথাও যেতেও চায় না বনবোরা৷ মানুষের নিকটাত্মীয় হলেও সাঁতারটা আয়ত্ত্ব করতে পারেনি আজও৷
মিল-অমিলের হিসাব-নিকাশ
বনোবোর সঙ্গে মানুষের ডিএনএ-র মিল প্রায় ৯৮ ভাগ৷ গরিলা কিংবা অন্য প্রজাতির শিম্পাঞ্জির তুলনায় বনোবোর সঙ্গে মানুষের ডিএনএ গঠনের মিলটা সবচেয়ে বেশি৷ তাই স্বভাবেও অনেক মিল দেখা যায়৷ আবার লক্ষ্যণীয় কিছু অমিলও আছে৷ এমনকি এইচআইভি/এইডস রোগেও আক্রান্ত হতে পারে৷ তবে ম্যালেরিয়া থেকে সুরক্ষিত বনোবো৷
যুদ্ধ নয়, ভালোবাসা
মনের ভাব প্রকাশে ভাষা না থাকলেও, বনোবোর লক্ষ্য হলো, ‘ভালোবাসো, যুদ্ধ করো না৷’ যুদ্ধ-সংঘাত এড়িয়ে চলে এই প্রাণীটি৷ লড়াই-ঝগড়া ছাড়া যখন কোনো বিকল্প নেই, তখন আলিঙ্গন আর পারস্পরিক মধ্যস্থতাতে বিশ্বাস রাখে তারা৷ তাদের সমাজটি অবশ্য মানুষের মতো পুরুষশাসিত নয়৷ নারীরাই এখানে শক্তিশালী এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে নারী বনোবো সবসময় ভূমিকা রাখে৷
লোলা ইয়া বনোবো
অনাথ বনোবোর জন্য সংরক্ষিত অঞ্চলটিকে বলা হয় ‘লোলা ইয়া বনোবো’ বা ‘বনোবোর স্বর্গ৷’ কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসার কাছে আছে পেটিটেস চুটেস দে লা লুকায়া জলপ্রপাত৷ আর সেই প্রপাত থেকে দক্ষিণে গেলেই দেখা মিলে সংরক্ষিত অঞ্চলটির৷ ১৯৯৪ সালে এই সংরক্ষিত অঞ্চলটির যাত্রা শুরু হয়৷ পাচারের হাত থেকে অনাথ বনোবোদের রক্ষা করে তাদের জন্য বন্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে এই উদ্যোগটি গ্রহণ করেন বেলজিয়ান বন সংরক্ষক ক্লডিন আন্দ্রে৷
দুই জগতের এক পরিবার
মনস্তাত্ত্বিক যত্নআত্তিও শারীরিক চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ৷ অনেক সময় মা হারানোর বেদনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে নবজাতক বনোবো৷ এ ধাক্বা সইতে না পেরে কয়েকটি বনোবোর বাচ্চা মারাও গেছে৷ এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঠেকাতে নারীর কোলে তুলে দেয়া হয় শিশু বনোবোকে৷ ভালোবাসা আর যত্নআত্তি নিয়ে মানব কোলেই বড় হয় তারা৷ শক্তপোক্তভাবে গড়ে তুলতে, অন্তত চার বছর পর্যন্ত বনোবোর বাচ্চাকে আদর-ভালোবাসা দিতে হয়৷
বনোবোর বিচরণভূমি
ইক্যুয়েটর প্রদেশই হলো এ প্রাণীর প্রাকৃতিক নিবাস, যার আয়তন ম্যানহাটনের প্রায় দুই গুণ৷ সাধারণ বনাঞ্চলের পরিমাণ সেখানে ২০ হাজার হেক্টর৷ স্থানীয়ভাবে এটি ‘একোলো ইয়া বনোবো’ নামে পরিচিত, যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘বনোবোদের বিচরণ ভূমি৷’
আমাকে আমার মতো থাকতে দাও
লোলা ইয়া বনোবো ঘিরে আছে গ্রীষ্মমণ্ডলিয় বনভূমি৷ সেখানে ৭৫ হেক্টর বনভূমিতে বাস করছে ৬০টিরও বেশি বনোবো৷ এখানেই উদ্ধার পাওয়া বনোবোদের যত্ন-আত্তি আর চিকিৎসাটা করা হয়৷ অন্য বনোবোদের সঙ্গে থাকার উপযোগী হওয়া পর্যন্ত তাদের ঠিকানা হয় এই বনভূমিটি৷ ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এখানে বেড়ে ওঠা বনোবোদের দুটি দলে ছাড়া হয়েছে তাদের প্রকৃত ঠিকানায়৷
মানুষের হাতেই ভবিষ্যৎ
লোলা ইয়া বনোবো ঘুরে দেখতে বছরে অন্তত ত্রিশ হাজার প্রকৃতিপ্রেমী ভিড় করেন৷ তাঁদের বেশিরভাগই কঙ্গোর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী৷ বলা যায়, শুধু দেশটির ভবিষ্যতের কর্ণধারই নয়, বরং বনোবোর বিষয়েও সিদ্ধান্ত প্রণেতা তাঁরাই হবেন৷ এই প্রজাতি রক্ষায় কেউ যদি এগিয়ে আসে, এই শিক্ষার্থীদেরই আসতে হবে৷ আর এখন বনোবোদের স্থানীয় অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করছেন যাঁরা, তাদের বলা হয় লোংলা পো৷