1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অর্থনীতিতে মাইলফলক অর্জন, আছে বৈপরীত্যও

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৯ নভেম্বর ২০১৮

বর্তমান সরকারের আমলে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মাইলফলক অর্জন আছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা৷ তারা মনে করেন, মানুষের আয় বেড়েছে৷ তবে সেইসঙ্গে বেড়েছে আয়ের বৈষম্যও৷

https://p.dw.com/p/38R3a
Bangladesch Wahlen Sheikh Hasina BNP
ছবি: bdnews24

জিডিপির হিসেবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ৷ ক্রয় ক্ষমতার বিবেচনায় ৩৩তম৷ আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে৷ 

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে৷ মাথাপিছু আয় বাড়ছে৷ বাড়ছে গড় আয়ু৷ অর্থনীতির আকার বাড়ছে৷ বাড়ছে বাজেটের আকার৷ বাজেট বাস্তবায়নে পরনির্ভরতাও কমছে৷ অবকঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে৷ বড় আকারের প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সক্ষমতাও বাড়ছে৷ বাংলাদেশ আকাশে স্যাটেলাইট উড়িয়েছে৷ বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে৷ কৃষি উৎপাদন বেড়েছে৷ তথ্য প্রযুক্তি খাতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ৷

কিন্তু এর বিপরীতে দুর্নীতি কমেনি৷ ব্যাংকিং খাতে লুটপাট বেড়েছে৷ বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ৷ ধনী আর গরিবের বৈষম্য বেড়েছে৷ বেড়েছে সার্বিক অর্থনৈতিক বৈষম্য৷ দেশের মোট সম্পদের বড় অংশ কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জিভূত৷ আর ব্যবসার পরিবেশে আফগানিস্তানের চেয়েও এখন খারাপ পরিবেশ বাংলাদেশে৷

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের এর এই চিত্রকেই বলা হচ্ছে বৈপরিত্যের অর্থনীতি৷ এখানে প্রাচুর্য যেমন আছে, আছে হত দারিদ্র্য অবস্থা৷ তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লড়াইটা জারি আছে৷ আর পেছনে টানার নানা উপাদান সক্রিয় থাকলেও তা পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ৷ আর ধারণা করা হয়, ২০৩০ সালের ভারত ও চীনের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৬তম অর্থনীতির দেশ৷ আইএমএফ বলছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির গতিতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল৷ বিশ্বের ১১টি দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশের দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ৷

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন(এইচএসবিসি)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে৷ এর পরের পাঁচ বছর ২০২৩ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ হারে৷ আগামী এক যুগ বাংলাদেশে গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে৷ আর বাংলাদেশের এই প্রবৃদ্ধির হার বিশ্বের সব দেশের প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হবে৷

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর(বিবিএস) হিসেব অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা বা ২৭০ বিলিয়ন ডলার৷ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ হারে৷ চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে৷

‘ইমেজ বিল্ডিং হয়েছে, তবে গ্যাপ আছে অনেক’

‘২০৩০ সালের বিশ্ব: ৭৫টি দেশের জন্য এইচএসবিসির প্রক্ষেপণ' শীর্ষক প্রতিবেদনে দেশগুলোর জনশক্তির আকার, মানবসম্পদ উন্নন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, রাজনীতি, বাজার ও প্রযুক্তির ব্যবহারকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে৷ এরসঙ্গে দেশগুলোর মাথাপিছু জিডিপি, কর্মক্ষম জনশক্তি, মোবাইল ফোন ব্যবহার, স্কুলে অন্তর্ভূক্তি, মানব উন্নয়ন সূচক, রাজনৈতিক অধিকার ও বাণিজ্য উদারীকরণ পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয়েছে৷

বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৭৫১ ডলার৷ বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে শিল্প খাতে সবচেয়ে বেশি ১২ দশমিক ০৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে৷ কৃষি খাতে ৪ দশমিক ১৯ আর সেবা খাতে ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে৷

জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ এখন ৩১ দশমিক ২৩ শতাংশ৷ এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৩ দশমিক ২৬ শতাংশ৷ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ৩০ দশমিক ৫১ শতাংশ৷ এ ছাড়া গত অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে সরকারি বিনিয়োগ ৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এর অংশ ছিল ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ৷

বিবিএস-এর তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ২০০৯ সালে ৫ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করতেন৷ তাঁদের মধ্যে প্রায় তিন কোটি মানুষ ছিলেন চরম দরিদ্র অবস্থায়৷ এখন দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করেন পৌনে চার কোটি মানুষ৷ আর চরম দারিদ্র্যে আছেন দেড় কোটির কিছু বেশি মানুষ৷ এই সময়ে জন্মহার ছিল ১ দশমিক ১৬ শতাংশ৷

বৈপরিত্য

এর বিপরীতে রয়েছে ঘুস এবং দুর্নীতির চিত্র৷ টিআইবির এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের সেবা নিতে বছরে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা ঘুস দিতে হয় সাধারণ মানুষকে৷ ২০১৬ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বাংলাদেশের ১৬টি সেবাখাতে ঘুস নিয়ে একটি জরিপ প্রকাশ করে৷ আর ওই জরিপে দেখা যায়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট ও বিচারিকসহ ১৬টি খাতের সেবা পেতে বছরে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঘুস দিতে হয় সেবা প্রার্থীদের৷

জরিপে অংশ নেয়া নাগরিকদের ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ সেবা পেতে ঘুস দেয়ার কথা জানিয়েছেন৷ আর ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তাঁরা ঘুস দিতে বাধ্য হয়েছেন৷

জরিপে বলা হয়, জাতীয় প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ ও জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ৷ তুলানমূলক চিত্রে বলা হয়, ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ১ হাজার ৪৯৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা বেশি ঘুস দিতে হয়েছে সেবা খাতে৷ টিআইবি এরপর আর ঘুষের জরিপ করেনি৷ তবে টিআইবি জানায়, অবস্থার কোনো উন্নতি হয়েছে এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই৷

বাংলাদেশে লুটপাট ও দুর্নীতির জন্য আলোচিত হলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত৷ হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংক কেলেঙ্কারি বাংলাদেশে এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারি৷ বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে এখন পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণের পরিমান প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা৷ গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা৷ খেলাপি ঋণের ৩৪ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের৷ এ ছাড়া ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩১ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা৷ বিদেশি ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দুই হাজার ৩২১ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর পাঁচ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা৷

অবলোপন করা ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ যোগ করলে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা৷ ঋণ অবলোপন হলো পাঁচ বছরের পুরনো খেলাপি ঋণ, যা আদায় হচ্ছে না; তার বিপরীতে একটি মামলা ও শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রেখে মূল খাতা থেকে বাদ দেয়া৷

‘মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে আয় বৈষম্যও বেড়েছে’

গত ১৮ জানুয়ারি সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম জাতীয় সংসদে বলেন, ‘‘২০১৭ সালে ব্যাংক খাত নড়বড়ে অবস্থায় পড়েছে৷ ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ২০ টিতে আর্থিক অবস্থা ছিল দৃশ্যমানভাবে খারাপ৷ অন্য ব্যাংকগুলোতেও কম-বেশি সুশাসনের অভাব ছিল৷ খেলাপি ঋণ মারাত্মকভাবে বেড়েছে৷ নামে-বেনামে ইচ্ছামতো ঋণ নেওয়া হয়েছে৷ ব্যাংকের পরিচালক, নির্বাহী, বড় কর্মকর্তারা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷''

সমস্যা কোথায়?

তারপরও নতুন নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে৷ রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ায় নতুন ব্যাংকগুলোও সফল হচ্ছে না৷ বড় উদাহরণ ফার্মার্স ব্যাংক৷

বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত ৫ বছরে আমরা শিল্পখাতে ইতিবাচক অগ্রগতি দেখেছি৷ গ্রামীণ উন্নয়নে বহুমুখিতা এসেছে৷ রপ্তানি খাতের উন্নয়নকে আমরা ধরে রাখতে পেরেছি৷ বাংলাদেশ বেশ কিছু মেগা প্রকল্প এগিয়ে নিচ্ছে৷ এগুলো নিয়ে যতই বিতর্ক থাক আগামীর উন্নয়নে এগুলো জরুরি৷''

তিনি বলেন, ‘‘আমরা নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি৷ আমরা উন্নয়নশীল দেশ হতে চলেছি৷ আমাদের ইমেজ বিল্ডিং হয়েছে৷ তবে গ্যাপ আছে অনেক৷ আয়ের বৈষম্য প্রকট৷ ধনী আর দরিদ্রের আয়ের বৈষম্য কমানো যায়নি৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে বরং তা আরো বেড়েছে৷ আমাদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলে স্বাস্থ্যখাতে আমাদের উন্নয়ন হয়েছে৷ কিন্তু মাতৃমৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন তত ভালো নয়৷ শিক্ষায় এনরোলমেন্ট বেড়েছে, কিন্তু মানের দিক থেকে আমাদের এখনো অনেক দূর যেতে হবে৷''

আর সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত ৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মাইলফলক অর্জন আছে৷ আর সেইসব অর্জন ধরে রাখতে পারলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে৷ বাংলাদেশের মানুষের মাথা পিছু যে আয় বেড়েছে, তা আসছে শিল্প, কৃষি, সেবা এবং প্রবাসীদের আয় থেকে৷ শাক-সবজি এবং মাছে বাংলাদেশ বিশ্বের অগ্রগামী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম৷ গত ৫ বছরে তৈরি পোশাক শিল্পের কর্ম পরিবেশের যে উন্নয়ন হয়েছে, তাতে আগামীতে বাংলাদেশ বিশ্ব মানের বা মধ্যম মানের পন্য উৎপাদনে সক্ষম হবে৷এটা সম্ভব হচ্ছে ভালো পরিকল্পনা এবং অবকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগের কারণে৷''

তবে তিনি বলেন, ‘‘কিন্তু এই উন্নয়নে বৈপরিত্যও আছে৷ আমরা মাথাপিছু আয় বাড়ার সঙ্গে আয় বৈষম্যও বাড়তে দেখছি৷ এটা দুশ্চিন্তার৷ সরকার যে অংশগ্রহণমুলক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে চাচ্ছে, এই চিত্র তার বিপরীত৷ আর এর কারণ হলো, কিছু কর্পোরেট গ্রুপের কাছে ব্যবসা-বাণিজ্য কুক্ষিগত৷ দুর্নীত বাড়ছে৷ বিশেষ করে পুঁজি বাজার ও ব্যাংকিং খাতে এই দুর্নীতি প্রকট৷ সরকারি সেবা নেয়ার ক্ষেত্রেও দুর্নীতি বাড়ছে৷''

তিনি বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতির জন্য প্রয়োজন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া৷ আর তার টার্গেট হতে হবে আগামী প্রজন্ম৷'' ড. নাজনীন বলেন, ‘‘দরকার সুশাসন৷ আমরা এগিয়েছি৷ কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত নয়৷''

আপনি কি ড. নাজনীনের সঙ্গে একমত? জানান আমাদের, নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য