1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অন্ধকার গলি বেয়ে রুপোলি পর্দায় সফর

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১৫ জুলাই ২০২১

প্রথাগতভাবে শিক্ষক না হলেও তিনি এলাকার মাস্টারমশাই৷ তাই সঞ্জয় মণ্ডল গড়ে দিচ্ছেন বস্তির ভবিষ্যৎ৷ ট্যাংরার সঞ্জয় অন্ধকার বস্তি জীবনে সংগীতের সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে তুলছেন৷ সিনেমার পর্দায় উঠে এসেছে তাঁরই জীবনের গল্প৷

https://p.dw.com/p/3wXKp
ছবি: Payel Samanta

পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘ট্যাংরা ব্লুজ’ নামের বাংলা ছবিটি আসলে সঞ্জয়ের জীবনের গল্প৷ সিনেমা জুড়েই বস্তি জীবনের প্রতিকূলতার ছবি দেখানো হয়েছে৷ এক প্রতিকূল সমাজের ছবি৷ সুস্থ সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করে সঞ্জয় যে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেছেন চিরকাল৷

বাতিল সামগ্রীর বাদ্যযন্ত্র

বাবা-মায়েরা হয়ত কারো বাড়িতে কাজ করেন বা রিকশা চালান৷ তাদের সন্তানরা পড়াশুনো না করলেও কেউ খোঁজ নেয়ার নেই৷ এরকম একটা পরিবেশেই বড় হয়ে উঠেছেন সঞ্জয় মণ্ডল৷ দুর্নীতি, লুটপাট, সমাজবিরোধী কাজের মধ্যেই নবজাতকদের বাস৷ বছরের পর বছর এই একই ছবি৷ সঞ্জয় বলেন, ‘‘এই অঞ্চলে বহু মানুষ আছে যারা এইভাবেই বাঁচেন৷ হয় জেলের ভেতরে, নয়তো জেলের বাইরে আপস করে বাঁচেন৷ কেউ পথ দেখানোর মতো নেই৷ আমরা অর্থনৈতিকভাবে গরিব নই, সংস্কৃতির দিক থেকে গরিব৷’’

এই অঞ্চলে বহু মানুষ আছে যারা এইভাবেই বাঁচেন: সঞ্জয় মণ্ডল

ব্যক্তিজীবনে সঞ্জয় কীর্তনাঙ্গের গানের দলের সংস্পর্শে এসে বোঝেন, সুস্থ সংস্কৃতি বলতে কী বোঝায়৷ ট্যাংরার শিশুদের মধ্যে সেই সুস্থ পরিবেশের বীজ রোপণ করতেই তিনি থিয়েটার, গানের ব্যবস্থা করেন৷ কিন্তু শিশুদের বাদ্যযন্ত্র কিনে দেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য তখন কোথায়? সঞ্জয় ফেলে দেওয়া টিন, বালতি, গ্লাস বাজিয়ে শব্দ তৈরি করতে শুরু করেন৷ সে সকল শব্দ থেকে তৈরি হলো গান বাঁধার স্বপ্ন৷ সঞ্জয় তার সামান্য আয়ে শুরু করলেন প্রতিষ্ঠান ‘কলকাতা ক্রিয়েটিভ কালচার ওয়েস্ট আর্ট সেন্টার’৷ এসে জুটলো নানা পরিবেশে বেড়ে ওঠা ছেলেরা৷ এরা কেউ সাফাইকর্মী, কেউ কেয়ার টেকার বা কেটারার কর্মী৷ পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করার জন্য অনেকেই পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছেন৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়ের ছড়া দিয়ে র‍্যাপ গান বাঁধছে এরা৷

আসমানে প্রশিক্ষণ

প্রথম জীবনে অপমানিত সঞ্জয় জীবনে সম্মান চেয়েছিলেন৷ তার মতো আর পাঁচজন যেন সম্মানের সঙ্গে বাঁচে৷ বাতিল জিনিস দিয়ে বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে সংগীতচর্চা চালিয়ে গিয়েছেন, গিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে৷ ২০০৫ সালে জাতীয় বৃত্তি পান কীতর্নাঙ্গের এই শ্রীখোল বাজিয়ে৷ তথাপি তার সংগীতের সুর, তাল, লয় নিয়ে সম্যক ধারণা নেই৷ এই চিন্তা থেকেই তিনি তাঁর ‘কলকাতা ক্রিয়েটিভ কালচার ওয়েস্ট আর্ট সেন্টার’-এর ‘আসমান’ ক্লাসরুমে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন৷ সেখানে নিয়মিত বেহালা, বাঁশি, গিটারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷ ঝুপড়ির জল-কাদা মাড়িয়ে সেই ঘরে পৌঁছতে হলো৷ সেখানে বসে সঞ্জয় বলেন, ‘‘টিন বাজানো শেখানোর জন্য কে শিশুকে এখানে পাঠাবেন? তা ছাড়া ভবিষতের কথাও ভাবতে হবে৷ পরে যাতে সুস্থ জীবন ও জীবিকা অর্জন করা যায়, তার লক্ষ্যেই এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা৷’’ পিছিয়ে পড়া মানুষ যাতে এগিয়ে আসতে পারেন, তার জন্য সঞ্জয় নিরন্তর খেটে চলেছেন৷ আর্থিক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে৷

স্লামডগ মিলিয়নিয়ার

এ যেন স্লামডগ মিলিয়নিয়ারের গল্প৷ তবে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন নয়, লক্ষ্যপূরণের সাধনা৷ বিয়াল্লিশ বছরে পৌঁছে সঞ্জয় নিজের জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছেন৷ পড়াশুনো আবার শুরু করেছেন৷ স্নাতক পর্যায় শেষ করে আরো পড়বেন সংগীত নিয়ে৷ লক্ষ্য খুঁজে দিয়েছেন আরো ৩৫ জনকে৷ তারা এখন কেটারার কিংবা সাফাইকর্মীর কাজ করেও অভিনয় বা বাংলা ব্যান্ডে গান করতে চান৷ সঞ্জয়ের ছাত্র সুমিত, রাহুল, ছোটু, দুষ্টু, তন্ময়রা বাড়ির ছোট্ট চার দেওয়ালে বসে মস্ত বড় স্বপ্ন দেখেন৷

হলিউড যোগও রয়েছে সঞ্জয়ের দলবলের৷ সুজয়, সুরজিৎ, রাজুরা অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ওটিটি ছবি ‘এক্সট্র্যাকশন’-এ৷ সহ অভিনেতা হিসেবে ছিলেন খ্যাতনামা ক্রিস হেমসওয়ার্থ৷ বছর কুড়ির সুরজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ট্যাংরায় দারিদ্রসীমার নীচে আমরা সবাই থাকি৷ তাই সবাইকেই কাজ করতে হয়৷ খুব জোর হলে মাধ্যমিক পাশটুকু করা যায়৷ আর এগোনো যায় না৷’’ এদের মুখ ‘ট্যাংরা ব্লুজ’ ছবিতে দেখার পর এলাকার অভিভাবকরা সচেতন হয়েছেন৷ বুঝে গিয়েছেন বাঁচার জন্য শিক্ষা বা সুস্থ সংস্কৃতি দরকার৷ ইতিমধ্যে সুরজিৎ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘দশ বছর ধরে নিয়মিত সঞ্জয়দার কাছে তালিম নিচ্ছি৷ এখন মিউজিক নিয়ে পড়তে চাই৷ সঙ্গে আমাদের দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবো৷’’