1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অনিশ্চিত পরিস্থিতি-উদ্বেগে, গুজব ছোটে দ্রুতবেগে

১৪ আগস্ট ২০২০

গুজব নিয়ে কথা বলতে গেলে আগে আমাদের জানতে হবে গুজবটা আসলে কী?

https://p.dw.com/p/3gwvp
Angst vor Äußerung politischer Meinung im Internet Indien
ছবি: DW/P. Samanta

পরিস্থিতি যদি হয় অনিশ্চিত, মনের মধ্যে উদ্বেগ কাজ করে, সঠিক সত্য পাওয়া থেকে মানুষ বঞ্চিত থাকে তখনই গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে৷ এমনটাই মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা৷ তবে গুজবে কান দেয়ার ক্ষেত্রে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার ভূমিকা রয়েছে৷

গুজব নিয়ে কথা বলতে গেলে আগে আমাদের জানতে হবে গুজবটা আসলে কী?

১৯৯১ সালে আফ্রো-অ্যামেরিকান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে৷ ট্রপিক্যাল ফ্যান্টাসি সোডা পপ নামে বাজারে একটা কোমল পানীয় বের হয়৷ এটি বাজারে আসার সাথে সাথে গুজব রটে যায় যে এই পানীয় খেলে কৃষ্ণাঙ্গরা বন্ধ্যা হয়ে যাবে৷ এই গুজবের কারণে ওই পানীয়র বিক্রি কমে যায় ৭০ ভাগ৷ এমনকি মানুষ ওই পানীয় সরবরাহকারীর ট্রাকের উপর হামলাও করেছিলো বেশ কয়েকবার৷

সমাজ মনোবিজ্ঞানী নিকোলাস ডিফনজো এবং প্রশান্ত বর্দিয়া গুজবের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে গুজবের চারটি বৈশিষ্ট্য থাকবে৷

এক. এটা মানুষের কোন মতামত নয়, বরং কোন তথ্য সংক্রান্ত বিবৃতি হতে পারে৷ উপরের ঘটনায় দেখুন কৃষ্ণাঙ্গরা বন্ধ্যা হবে-এটা এক ধরনের বিবৃতি৷

দুই. প্রচারযোগ্য হতে হবে৷ অর্থাৎ কেউ যদি প্রচার না করত ওই পানীয় খেলে বন্ধ্যাত্ব হয়, তাহলে সেটা গুজব হত না৷

তিন. অনিশ্চিত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য, অর্থাৎ যা যাচাই-বাছাই করা সম্ভব নয়৷ যেমন: উপরের ঘটনাটি মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে৷ কে প্রথম কাকে বলেছে কেউ জানে না৷

চার. গুজব এমন হবে, যেখানে মানুষ যা জানতে চাইছে তার উত্তর আছে৷ অর্থাৎ ইংরেজিতে যেটাকে বলে ‘ইনস্ট্রুমেন্টালি রেলেভেন্ট'৷ এসব তথ্যকে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভাববে৷ কেননা এসব তথ্য তার জীবনের সাথে জড়িত, অর্থাৎ এর প্রাসঙ্গিকতা আছে৷ যেমন: অনেক খাবার খেলে পুরুষের যৌন ক্ষমতা কমে যায় বলে অনেকের বিশ্বাস৷

গুজবের প্রাথমিক কাজ হল এমন একটা বিষয় যে নিয়ে মানুষের পরিষ্কার ধারণা নেই কিন্তু আগ্রহ আছে৷ গুজবে এ ধরনের তথ্যই বেছে নেয়া হয়, যেখানে মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ রয়েছে৷  যেমন ধরুন: আমি যখন স্কুলে পড়ি, তখন গুজব রটেছিলো  ‘গণেশ' দুধ খাচ্ছে অর্থাৎ গণেশের মূর্তি৷ এই গুজবে কান দিয়ে বেশিরভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী তাদের মাটির গণেশে দুধ ঢাললেন এবং দেখলেন দুধ তার দেহে মিশে যাচ্ছে৷ অনেক গণমাধ্যমে কেবল এটাই প্রকাশ হলো যে গণেশ দুধ খাচ্ছে এবং বিভিন্ন মন্দিরে মানুষের ঢল নেমেছে গণেশকে দুধ খাওয়াতে৷ পরে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদক জানালেন তখন প্রচণ্ড গরমের কারণে মাটি আসলে দুধ শুষে নিচ্ছিল৷ বিভ্রান্তি বা দ্বিধান্বিত মন আসলে গুজব প্রবেশের উর্বর জায়গা৷

১৯৪৭ সালে ‘দ্য সাইকোলজি অফ রিউমার' বইয়ে গর্ডন অলপোর্ট এবং লিও পোস্টম্যান গুজব ছড়ানোর মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো বর্ণনা করেছেন৷ তাঁরা যেসব বিষয়ের উল্লেখ করেছেন:

এক. অনিশ্চিত পরিস্থিতি: পরিস্থিতি যখন অনিশ্চিত তখন মানুষ গুজব ছড়ায় বা গুজব ছড়ানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়৷৷ যেমন ধরুন: প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কথা৷ তিনি যখন শেষ দিনগুলোতে অ্যামেরিকায় ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন, তখন প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেপোস্ট দেখা যেতো তিনি আর নেই, অথবা অবস্থা খারাপ, এই রাত নাও কাটতে পারে৷ তখন পরিবারের পক্ষ থেকে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে আপডেট দেয়া শুরু করলো গণমাধ্যম৷ সেখানেও সমস্যা৷ পরিবারের এক একজন এক একরকম মন্তব্য করায় জনগণ আরও বিভ্রান্ত৷ ফলে এই পরিস্থিতিতে মানুষ গুজবকেই আকড়ে ধরে৷ কারণ ভাবে হয়ত মানুষটি চলে গেছে কিন্তু পরিবার জানাতে দিচ্ছে না৷

দুই. উদ্বেগ: মানুষ যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকে, তখনও গুজব ছড়ায় বা গুজবকে গ্রহণ করে৷ উদ্বেগের সাথে অনিশ্চয়তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে৷ বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যেসব মানুষের মধ্যে বেশি উদ্বেগ কাজ করে তারাই বেশি গুজব ছড়ায়৷ গবেষণায় এটাও দেখা গেছে যে খারাপ কোন ঘটনার গুজব ভালো কোন ঘটনার গুজবের চেয়ে দ্রুত ছড়ায়৷

তিন. তথ্যের গুরুত্ব: গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, অর্থাৎ রটনাকারী যখন জানে যে এই বিষয়ে তথ্যগুলো মানুষ জানতে চায় অর্থাৎ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তখনই তা ছড়ায়৷ আর যারা গুজব ছড়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা সেটা বিশ্বাস করে বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা৷

চার. অস্পষ্টতা: কোন বিষয় বা তথ্য সম্পর্কে মানুষের স্পষ্ট ধারণা না থাকলে মানুষ গুজবে কান দেয়৷

পাঁচ. নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা: মানুষ তাদের ভাবমূর্তির সাথে যায় এমন তথ্যে বিশ্বাস করে এবং সেই গুজবকে সত্য বলে ধরে নেয়৷ যেমন ধরুন একজন ধার্মিক মুসলমান ফেসবুকে শেয়ার করলেন গরুর মাংসে আল্লাহু আকবর লেখা আছে আরবিতে৷ ৫/৬ বছর আগে ফেসবুকে এটা ঘুরে ঘুরে অনেকেই শেয়ার করেছেন৷ কারণ তাদের ধার্মিক মনোভাব বোঝাতে এই গুজবটি সাহায্য করছে৷

ছয়. ভালো লাগা: অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ নিজেদের ব্যাপারে ভালো অনুভব করতে চায় এবং সেই জায়গা থেকে গুজব রটায়৷ আমার এক বন্ধুর কথা বলি৷ যে অন্যদের কাছে গুরুত্ব পাওয়ার জন্য বন্ধুদের কাছে রটিয়েছিল যে তার ক্যান্সার হয়েছে৷ সবাই খুব দুঃখ পেয়ে সব সময় ওর খোঁজ খবর নেয়া শুরু করলো৷ হঠাৎ একদিন ওর ভাইয়ের সাথে কথায় কথায় জানা গেলো ওর অন্য শারীরিক সমস্যার কারণে কিছুদিন হাসপাতালে ছিলো এবং সে পুরোপুরি সুস্থ৷ তার কখনোই ক্যান্সার হয়নি৷

সাত. প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে: গবেষকেরা বলছেন অন্যকে নীচু করতেও গুজব রটানো হয়, বিশেষ করে তা যদি হয় কোন গোষ্ঠী, দল বা ব্যক্তির প্রতিপক্ষ৷ আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যা অনেক সময় লক্ষ্য করা যায়৷ এগুলোকে বলে ‘ওয়েজ রিউমারস'৷ অর্থাৎ বিরোধী পক্ষের সাথে নিজেদের পার্থক্য বোঝাতে যেসব গুজব রটানো হয়৷

আট. দৃঢ় সামাজিক অবস্থান: সামাজিক অবস্থানকে শক্ত করতেও অনেকে গুজবের আশ্রয় নেয় বলে জানিয়েছেন গবেষকরা৷ এর মাধ্যমে গুজব রটনাকারীরা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে চান৷

তবে এক একটা গুজব সমাজের এক এক শ্রেণির মানুষ এক একভাবে গ্রহণ করে৷ অর্থাৎ মানসিকতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা৷ কোন মানুষ গুজব ছড়াচ্ছে তার ব্যক্তিত্ব, সামাজিক অবস্থানের উপর বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে৷

HA Asien | Amrita Parvez
অমৃতা পারভেজ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

গবেষণার ফলাফল বলছে, কিছু কিছু গুজব নির্দিষ্ট কিছু দলের মানুষের মাধ্যমে দ্রুত ছড়ায় কারণ তারা হয়ত কোন একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল, ধর্ম, মতামতের উপর বিশ্বাস করে এবং ওই সংক্রান্ত যেকোন গুজবকে বিশ্বাস করে৷ মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি নির্দিষ্ট গুজব তখনই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যখন মানুষের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তা মিলে যায়৷ এ কারণে একই গুজব গ্রামাঞ্চলে যতটা দ্রুত ছড়াবে শহরে হয়ত ততটা ছড়াবে না৷

লেখা শেষ করবো ‘গোয়েবেলসীয় মিথ্যা' দিয়ে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি সরকারের তথ্যমন্ত্রী ছিলেন ইয়োসেপ/জোসেফ গোয়েবেলস৷ তার গুজব রটানোর ক্ষমতার কারণে ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছেন ৷

তার বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘একই মিথ্যা বার বার বললে তা সত্যে রূপান্তরিত হয়৷'' আর ইহুদিদের বিরুদ্ধে এমন সব মিথ্যা তিনি সুন্দরভাবে প্রচারে সমর্থ হয়েছিলেন৷ দীর্ঘ ছয় বছর ধরে তার মিথ্যা শুনে নাৎসি বিরোধীরাও ইহুদিবিরোধী হয়ে উঠেছিল৷ কারণ গোয়েবেলস যেসব তথ্য ছড়িয়েছিলেন তা শুনতে শুনতে নিরপেক্ষ জার্মানরাও এটা ধরে নিয়েছিল যে দেশপ্রেমিক ও রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ হতে হলে ইহুদিবিরোধী হতে হবে৷ গোয়েবেলসের গুজব নিয়ে প্রখ্যাত কবি শঙ্খঘোষের কয়েকটি লাইন:

যা ঘটে তা ঘটেই কি? কীভাবে তো বোঝাবো নিজেকে?

আমরা যা দেখি শুনি কিছুমাত্র মানে নেই তার৷

যতক্ষণ তুমি এসে ভাষায় না রূপ দাও তাকে

ইতিউতি তারা সব জড়পিণ্ড হয়ে পড়ে থাকে৷

.....

বিরকারহীন আমি সহজেই মেনে নিই সব

ঘটে যা তা সত্য নয়, সেই সত্য যা রচিবে তুমি৷''