হিরোশিমায় তখন সকাল আটটা বেজে ১৫ মিনিট। মার্কিন বিমান বি ২৯ থেকে নেমে এল 'লিটল বয়', বিশ্বের প্রথম পরমাণু বোমা। যার তাণ্ডবে সঙ্গে সঙ্গে মারা যান ৮০ হাজার মানুষ। পরে মারা যান আরও ৬০ হাজার। পরমাণু বোমার প্রতিক্রিয়ায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়েছেন সধারণ মানুষ। সেই অমানবিক ঘটনার ৭৫ বছর পূর্তিতে হিরোশিমায় সমবেত হয়েছিলেন কিছু বেঁচে যাওয়া মানুষ, মৃতদের পরিবারের লোক, কিছু বিদেশি প্রতিনিধি, শহরের বর্তমান লোক ও কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা। করোনার কারণে এ বার অনেক কম লোক সমবেত হয়েছিলেন। তাঁরা শান্তির গান গাইলেন, প্রার্থনা করলেন এবং শান্তির কথা বললেন। তাঁদের একটাই আবেদন, সম্পূর্ণ পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ করা হোক। সব দেশ যেন তাঁদের পরমাণু অস্ত্র ধ্বংস করে ফেলে।
তবে হিরোশিমা শান্তি স্মারক বা পিস মেমোরিয়ালে স্থানীয় সময় ৮টা ১৫ মিনিটে গান, কথা সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। নীরব থেকে স্মরণ করা হয় তাঁদের, যাঁরা ৭৫ বছর আগে মারা গেছিলেন পরমাণু বোমার বিস্ফোরণে।
-
বিভীষিকাময় আণবিক বোমা হামলার স্মরণে
প্রথম বোমা নিক্ষেপ
১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট৷ ঘড়িতে বাজছে ঠিক সকাল সোয়া আটটা৷ জাপানের হিরোশিমা নগরিতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান ‘এনোলা গে’ থেকে ছোড়া হয় প্রথম আণবিক বোমা ‘লিটল বয়’৷ মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যায় গোটা নগরীর বাড়ি ঘর, দালান কোঠা৷ আণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তায় সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান সেখানকার ২০ ভাগ মানুষ৷ বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে লক্ষাধিক৷
-
বিভীষিকাময় আণবিক বোমা হামলার স্মরণে
দ্য এনোলা গে
আদতে হিরোশিমায় বোমা হামলার পরিকল্পনা ছিল ঐ বছরের ১লা আগস্ট৷ কিন্তু টাইফুনের কারণে তা বাতিল করা হয়৷ পাঁচদিন পর ‘এনোলা গে’ ১৩ জন ক্রু নিয়ে হামলার জন্য রওনা হয়৷
-
বিভীষিকাময় আণবিক বোমা হামলার স্মরণে
দ্বিতীয় বোমা হামলা
হিরোশিমায় হামলার তিনদিন পর, অর্থাৎ ৯ই আগস্ট, অ্যামেরিকা দ্বিতীয় আণবিক বোমাটি ফেলে নাগাসাকি শহরে৷ আসলে তাদের লক্ষ্য ছিল কিয়োটো৷ কিন্তু এতে মার্কিন প্রতিরক্ষাবাহিনী সায় না দেয়ায় নাগাসাকিকে বেছে নেয়া হয়৷ এই বোমাটির নাম ছিল ‘ফ্যাট ম্যান’৷ এতে বিস্ফোরক ছিল ২২ হাজার টন টিএনটি৷ বোমা হামলার চার মাসে সেখানে প্রাণ হরান ৭০ হাজার মানুষ৷
-
বিভীষিকাময় আণবিক বোমা হামলার স্মরণে
কৌশলগত হামলা
১৯৪৫ সালে নাগাসাকিতে ছিল মিৎসুবিশি কোম্পানির ইস্পাত ও অস্ত্র কারখানা৷ সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবারে হামলা চালানোর টর্পেডোও তৈরি হতো৷ নাগাসাকিতে তখন মাত্র অল্প কয়েকজন সেনা ছিল৷
-
বিভীষিকাময় আণবিক বোমা হামলার স্মরণে
হামলা শিকার
বোমা হামলার সময়ই কেবল নয়, তেজস্ক্রিয়তায়ও কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ তেজস্ক্রিয়তা, পোড়া ও ক্ষতের কারণে ১৯৪৫ সালের শেষে কেবল হিরোশিমাতেই নিহত হয়েছেন ৬০ হাজার মানুষ৷ পাঁচ বছর পরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৩০ হাজারে৷
-
বিভীষিকাময় আণবিক বোমা হামলার স্মরণে
যুদ্ধাপরাধ?
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামলার পর জাপানিরা আতঙ্কে ছিলেন যে, রাজধানী টোকিওতে হয়ত তৃতীয় হামলা চালাবে যুক্তরাষ্ট্র৷ তাই আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ঐ হামলা দুটির নির্দেশ দেন৷ তাঁর মনে হয়েছিল এতে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে৷ ইতিহাসবিদরা অবশ্য এ ঘটনাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন৷
-
বিভীষিকাময় আণবিক বোমা হামলার স্মরণে
পুনর্গঠন
হিরোশিমা নগরীর ‘সিটি সেন্টার’ বোমা হামলায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছিল, যা আবার নতুন করে গড়া হয়৷ কেবল ‘ওটা’ নদীর ধারে দ্বীপটিতে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি৷ সেখানে রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ: শান্তি জাদুঘর, শিশুদের শান্তি স্মারক স্তম্ভ, শিল্প ও বাণিজ্য ভবনের ধ্বংসস্তূপ আর শিখা অর্নিবাণ, যেটা জ্বলবে বিশ্বের সব আণবিক বোমা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত৷
-
বিভীষিকাময় আণবিক বোমা হামলার স্মরণে
স্মরণের সংস্কৃতি
১৯৫৫ সালে নাগাসাকিতে অ্যাটোমিক বোমার জাদুঘর এবং একটি ‘পিস পার্ক’ বা শান্তি উদ্যান নির্মাণ করা হয়৷ সেখানে গিয়ে অনেকেই বোমা হামলায় নিহতদের স্মরণ করেন৷ এটা জাপানিদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ পারমাণবিক যুদ্ধের নারকীয়তার বৈশ্বিক প্রতীকে পরিণত হয়েছে হিরোশিমা ও নাগাসাকি৷
-
বিভীষিকাময় আণবিক বোমা হামলার স্মরণে
এক মুহূর্তের নীরবতা
প্রতি বছর হিরোশিমায় এ দিনটি উপলক্ষ্যে অনেক বড় পরিসরে স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়৷ বোমাটি যখন নিক্ষেপ করা হয়েছিল, ঠিক সেই মুহূর্তটিতে ঘটনায় বেঁচে যাওয়া মানুষ, নিহতদের স্বজন, সাধারণ নাগরিক, রাজনীতিবিদ – সবাই এক মিনিটের নীরবতা পালন করেন৷ অনেকেই পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের জন্য অঙ্গীকার করেন এদিন৷
-
বিভীষিকাময় আণবিক বোমা হামলার স্মরণে
জীবিত শেষ সদস্য নিহত
যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনীর যে দলটি ঐ ‘অ্যাটম বোমা’ নিক্ষেপ করেছিল সেই দলের জীবিত শেষ সদস্য থিওডোর ভ্যানকির্ক ২০১৪ সালের ৩০শে জুলাই মারা যান৷ জর্জিয়া রাজ্যে অবসরপ্রাপ্তদের একটি আবাসে ৯৩ বছর বয়সে মারা যান তিনি৷ ‘ডাচ’ নামে পরিচিত কির্ক বোমা নিক্ষেপকারী বিমান এনোলা গে-র নেভিগেটর ছিলেন৷ সে সময় তাঁর বয়স ছিল ২৪ বছর৷
লেখক: রেচেল বেগ/এপিবি
শুধু হিরোশিমা নয়, শান্তি ও পরমাণু অস্ত্র ধ্বংসের দাবি উঠল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং জাতি সংঘের তরফ থেকেও। জার্মানির বিদেশমন্ত্রী হাইকো মাস বলেছেন, ''প্রথমে হিরোশিমা ও তার কয়েক দিন পর নাগাসাকিতে কী হয়েছিল, তা যেন বিশ্বের মানুষ কোনোদিন না ভোলে। তাই পরমাণু অস্ত্র ধ্বংস ও সম্পূর্ণ পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের দিকে হাঁটতে হবে বিশ্বকে।'' ভিডিওবার্তায় জাতি সংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুটেরেস বলেছেন, ''যাঁরা সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁদের গল্প, কষ্ট ও সহনশীলতা যেন পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্বর জন্য আমাদের একজোট করে।'' আর হিরোশিমার মেয়রের প্রার্থনা, ''ওই যন্ত্রণার অতীত যেন আর ফিরে না আসে।''
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমণু বোমা ফেলার পরেও আজ পর্যন্ত অ্যামেরিকা ক্ষমা চায়নি। তারা বরাবর বলে এসেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দ্রুত শেষ করার ওই একটাই পথ ছিল। প্রচলিত অস্ত্র ব্যবহার করতে থাকলে লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হতো।
হিরোশিমার তিনদিন পর পরমাণু বোমা ফেলা হয় নাগাসাকিতে। ১৯৪৫ সালে সেই বোমার প্রভাবে নাগাসাকিতে মারা গেছিলেন ৭৪ হাজার মানুষ। তার কয়েকদিন পর ১৫ অগাস্ট, ১৯৪৫ সালে জাপান আত্মসমর্পণ করে।
হিরোশিমার মেয়র কাজুমি মাতসুই বলেছেন, ''জাপান সরকারকে অনুরোধ করছি, তারা যেন পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধ করা সংক্রান্ত চুক্তিতে সই করে ও তা অনুমোদন করে। জাপানই একমাত্র দেশ, যারা পরমাণু বোমার শিকার। তাই বিশ্বের লোককে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের ভয়াবহতার কথা বোঝানোর একটা দায় আছে।'' জার্মানি সহ বিশ্বের বহু দেশই ২০১৭-র এই চুক্তিতে সই করেছে। কিন্তু জাপান করেনি।
জাপানে এখনো ৫০ হাজার মার্কিন সেনা আছে। অ্যামেরিকার পরমাণু-ছাতার তলায় জাপান আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানকে সেনাবাহিনী রাখতে দেওয়া হয়নি। ফলে প্রতিবেশী পরমাণু অস্ত্রধর চীনের থেকে বাঁচার জন্যও জাপান পুরোপুরি অ্যামেরিকার উপর নির্ভরশীল।
জিএইচ/এসজি(এএফপি, এপি, রয়টার্স, কেএনএ)