1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সড়কে নৈরাজ্যের দায় কার?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২০ মার্চ ২০২৩

বাংলাদেশে সড়কে নৈরাজ্যের পিছনে প্রধানত পরিবহন মালিকরা দায়ী হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফিটনেসহীন যানবাহন তারাই সড়কে নামান। অদক্ষ চালক তারাই পছন্দ করে কম মজুরি দিতে। কিন্তু তাদের দায় নিতে হয় না।

https://p.dw.com/p/4OweD
ফাইল ফটো
ফাইল ফটোছবি: LUTFOR RAHAMAN/bdnews24.com

মাদারীপুরের কুতুবপুরে পদ্মাসেতুর এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে থেকে ছিটকেপড়া ইমাদ পরিবহণের বাসটির দুর্ঘটনার তিনটি কারণ এপর্যন্ত জানা গেছে। চালক চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে তিনি ক্লান্ত ছিলেন, গাড়িটি চলছিলো অস্বাভাবিক গতিতে। ওই সড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার হলেও বাসটি চালানো হচ্ছিল ১২০ কিলোমিটার গতিতে। বাসটির ফিটনেস এবং রুট পারমিট কোনেটিই ছিল না। তবে চালকের লাইসেন্স ঠিক আছে কী না তা এখনো নিশ্চিত নয়।
আর এই বাসটিই গত বছরের ১৭ নভেম্বরে গোপালগঞ্জে দুর্ঘটনায় পড়েছিলো। তখন মারা যান তিনজন। গত ১৮ জানুয়ারি বাসটির ফিটনেস ও রুট পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।
এক বাসেই সব নৈরাজ্য:
ইমাদ পরিবহনের এই বাসটির দুর্ঘটনা থেকেই সড়ক পরিবহণের নৈরাজ্য স্পষ্ট। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বাসচালকদের কর্মঘন্টা বেধে দেয়ার নির্দেশ দিলেও তা মানা হচ্ছে না। ফিটনেস এবং রুট পারমিট নেই এমন যানবাহন সড়কে চলছে দেদারসে। আর মহাসড়কে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না। এখান থেকে আরেকটি নৈরাজ্য স্পষ্ট হয়। চালকসহ পরিবহণ শ্রমিকদের অধিকাংশেরই মাসিক বেতন নেই। তারা ট্রিপ ভিত্তিক মজুরি পান। ফলে তারা বিশ্রাম না দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাস চালান। অতিরিক্ত ট্রিপ দেয়ার চেষ্টা করেন। সড়কে এই দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত এই কারণগুলাই দায়ী। আর একটি বাসেই প্রায় সবগুলো কারণই খুঁজে পাওয়া গেল। প্রাণ গেল ২০ জনের।
কোনো আইনই মানা হচ্ছে না:
বাংলাদেশ পরিবহণ শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, "বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই চালকদের দায়ী করা হয়। কিন্তু এর পেছনে কী কারণ আছে তা দেখা হয় না। চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের জন্য মজুরি বোর্ড করা হয়েছে। তাদের নিয়োগপত্র দেয়ার আইন আছে। কিন্তু সেগুলো মানা হয় না। চালকদের কোনো নিয়োগপত্র নেই, নির্ধারিত বেতন নেই। তাদের ট্রিপ ভিত্তিক মজুরি দেয়া হয়। তাই তারা বিশ্রাম না নিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা গাড়ি চালাতে বাধ্য হন। বেশি ট্রিপ পাওয়ার আশায় নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি গাতিতে গাড়ি চালান। এমনও হয় আট ঘণ্টার একটি ট্রিপ দিয়ে এক ঘণ্টা বা তার কম সময় বিশ্রাম নিয়ে তারা আরেকটি ট্রিপ শুরু করতে বাধ্য হন।”
তার কথা," একজন চালকের ২৪ ঘন্টায়  এক নাগাড়ে পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানোর আইন আছে। দূর পাল্লার একটি ব বাসে তাই দুইজন ড্রাইভার রাখার নিয়ম। কিন্তু কোনো বাসেই দুইজন ড্রাইভার নাই।”
"পরিবহণ মালিকেরা পুলিশ ও বিআরটিএর সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এই নৈরাজ্যকর অবস্থা বহাল রেখেছে। কিছু পরিবহন কোম্পানি আছে তারা কেন্দ্রীয়ভাবে সব কিছু ম্যানেজ করে। তাদের গাড়ির ফিটনেস, রুট পারমিট আছে কীনা তা কখনোই দেখা হয় না।”
কার দায় কত?
বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন,"সাধারণভাবে চালকদের সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রধানভাবে দায়ী করা হলেও আমরা গবেষণায় দেখেছি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালকদের দায় চার নম্বরে। এক নম্বরে অব্যবস্থাপনা তারপরে আছে গাড়ির ফিটনেস। তার পরে সড়ক ব্যবস্থা। ঢাকা শহরে ৮০ ভাগ বাস-মিনিবাসের কোনো ফিটনেস নাই। আর দূর পাল্লার বড় বড় কয়েকটি পরিবহন কোম্পানি ছাড়া অন্যদের গাড়ির কোনো ফিটনেস ও রুট পারমিট নাই।”
তিনি বলেন,"আসলে এইসবের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান করা হলেও এগুলো চলে সমঝোতার ভিত্তিতে। মালিকপক্ষ এতই শক্তিশালী যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া যায় না।”
শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) ২০১৭ সালের এক গবেষণা বলছে, পরিবহন খাতের ৮৬ শতাংশ শ্রমিক দৈনিক ১৩ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। এই খাতের ৯০ শতাংশ শ্রমিকের সাপ্তাহিক ছুটি নেই।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, বাংলাদেশে বাস-মিনিবাস রয়েছে ৮০ হাজার। সব ধরনের যন্ত্রিক যানবাহন মিলিয়ে এর সংখ্যা ৫৭ লাখ। সিটি সার্ভিসের বাস-মিনিবাসের ৬০ ভাগেরই কোনো ফিটনেস নাই। আর দূর পাল্লার বাসের ৩০ ভাগের ফিটনেস নাই। বাংলাদেশে বাস মিনিবাসের বৈধ লাইসেন্সধারী ড্রাইভার আছে ৪০ হাজার। তাই বাস মিনিবাসে ভুয়া বা লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারদের দৌরাত্ম।”
তার কথা,"এখানে মালিক পক্ষের দায় আছে। দায় আছে বিআরটিএর। তবে সমস্যা হলো পুরো গণপরিবহল খাতের শতকরা এক ভাগেরও কম সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তাই বেসরকারি মালিকেরা এই খাত নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মর্জির ওপর নির্ভর করে এই খাত।”
বিআরটিএ, পুলিশ দেখে না কেন?
তবে বাংলদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্ল্যাহ দাবি করেন, "আমরা মালিক সমিতি সব সময়ই রুট পারমিট ও ফিটনেসহীন গাড়ির বিপক্ষে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশকে বলে আসছি। তারা ব্যবস্থা নেয় না কেন? আমরা কীভাবে জানব কোনো গাড়ির ফিটনেস আছে বা কোন গাড়ির নেই? কোন গাড়ির রুট পারমিট আছে কোন গাড়ির নেই? ইমাদ পরিবহনের দুর্ঘটনায় পতিত গাড়িটি আগেও দুর্ঘটনায় পড়েছে। ওই গাড়ি সড়কে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ছিলো। তাহলে সেটা সড়কে নামলো কীভাবে?”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, "বাংলাদেশে বাস-মিনিবাসহ সবধরনের যান্ত্রিক যানবাহন আছে ৬০ লাখের বেশি। চালক আছে ৪০ লাখ। ড্রাইভারই তো নেই। দক্ষ-অদক্ষ তো পরের কথা। আর ড্রাইভারেরাই মাসিক বেতন ও নিয়োগ পত্র নিতে চায়না। তারা চার দিন কাজ করে তিন দিন বাড়ি চলে যায়। অনেকের তো ঠিকানাই ঠিক নাই। কাকে নিয়োগপত্র দেব। শ্রমিক সমিতির তো ৪০টির মত পরিবহণ কোম্পানি আছে। তারা নিয়োগ পত্র দেয় না কেন?”
"আসলে আমাদের দক্ষ ড্রাইভার তৈরি করার জন্য বড় উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট দরকার। ড্রাইভারের ঘাটতি পূরণের জন্য আরো অনেক ড্রাইভার তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে,” বলেন এই পরিবহণ মালিক নেতা।
এইসব বিষয়ে কথা বলার জন্য বিআরটিএ'র চেয়ারম্যানকে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশে প্রতি বছরই সড়ক দুঘর্টনা ও মৃত্যু বাড়ছে। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে গত এক বছরে বাংলাদেশের ১৮ ধাপ অবনতি হয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, গত বছর সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহত হয়েছেন সাত হাজার সাতশ ১৩ জন৷

‘সড়ক দুর্ঘটনার পেছনের কারণ আছে দেখা হয় না’