সেনার ‘বিশেষ ক্ষমতা’ : আতশ কাঁচে জননিরাপত্তা, মানবাধিকার
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪সেনাবাহিনীর এই ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বুধবার থেকে কার্যকর হয়েছে৷ সারাদেশে দুই মাসের জন্য সেনাবাহিনীর কমিশন প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়ার কারণ ব্যখ্যা করেছেন জনপ্রশাসন সচিব মো. মেখলেস উর রহমান৷ বুধবার মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘‘মানুষ যাতে আরো জনবান্ধব পরিবেশে চলাচল করতে পারে ও নিরাপদ বোধ করে, সেই জন্য সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে৷’’
তার কথা, ‘‘গত ৫ আগস্টের পর থেকে সব পর্যায়ের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে কাজ করছে৷ সব বাহিনী একইসঙ্গে একই ছাতার নিচে কাজ করছে, এই মেসেজটার জন্যই এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে৷’’
মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশ এবং প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা আছে, এক্ষেত্রে কোনো দ্ব্ন্দ্ব তৈরি করবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এটা কোনো ক্যাডারের ক্ষমতা না, এটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা৷ কোনো দ্বন্দ্ব হবে না৷ এক রাষ্ট্র এক জনগণ এক সরকার৷ জনস্বার্থে আপনি কাজ করেন, আমি কাজ করি৷ এটা ভালো ফল দেবে৷’’
কী ক্ষমতা দেয়া হয়েছে
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ফৌজদারি দন্ডবিধি ১৮৯৮০-এর ৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ৯৫(২), ১০০, ১০৫, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ এবং ১৪২ ধারা অনুযায়ী সংগঠিত অপরাধের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন৷ আর এটা সারাদেশের জন্য প্রযোজ্য৷
আইনের এসব ধারা অনুযায়ী, একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যা যা করতে পারেন-
ধারা ৬৪: ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার বা গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়া এবং হেফাজতে রাখার ক্ষমতা৷
ধারা ৬৫: প্রেপ্তার করার ক্ষমতা বা তার উপস্থিতিতে গ্রেপ্তারের নির্দেশনা, যার জন্য তিনি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন৷
ধারা ৮৩ ও ৮৪: ওয়ারেন্ট অনুমোদন করার ক্ষমতা বা ওয়ারেন্টের অধীনে গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অপসারণের আদেশ দেয়ার ক্ষমতা৷
ধারা ৯৫(২): নথিপত্র ইত্যাদির জন্য ডাক ও টেলিগ্রাফ কর্তৃপক্ষের দ্বারা অনুসন্ধান এবং আটক করার ক্ষমতা৷
ধারা ১০০: ভুলভাবে বন্দি ব্যক্তিদের হাজির করার জন্য অনুসন্ধান-ওয়ারেন্ট জারি করার ক্ষমতা৷
ধারা ১০৫: সরাসরি তল্লাশি করার ক্ষমতা৷ তার (ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি) উপস্থিতিতে যে কোনো স্থানে অনুসন্ধানের জন্য তিনি সার্চ ওয়ারেন্ট জারি করতে পারেন৷
ধারা ১০৭: শান্তি বজায় রাখার জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা৷
ধারা ১০৯: ভবঘুরে ও সন্দেহভাজন ব্যক্তির ভালো আচরণের জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা৷
ধারা ১১০: ভালো আচরণের জন্য নিরাপত্তা প্রয়োজনীয় ক্ষমতা৷
ধারা ১২৬: জামিনের নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা৷
ধারা ১২৭: বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার আদেশদানের ক্ষমতা৷
ধারা ১২৮: বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য বেসামরিক শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা৷
ধারা ১৩০: বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা৷
ধারা ১৩৩: স্থানীয় উপদ্রবে ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবস্থা হিসেবে আদেশ জারি করার ক্ষমতা৷
ধারা ১৪২: জনসাধারণের উপদ্রবের ক্ষেত্রে অবিলম্বে ব্যবস্থা হিসেবে আদেশ জারি করার ক্ষমতা৷
এসব ক্ষমতা ছাড়াও যে কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর অধীনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার জন্য সরকার এবং সেইসঙ্গে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা সংশ্লিষ্ট এখতিয়ারের মধ্যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে৷
এই আইনের অধীনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার উপস্থিতিতে সংঘটিত অপরাধ বা ঘটনাস্থলে তার বা তার সামনে উন্মোচিত হওয়া অপরাধগুলো বিবেচনায় নিতে পারেন৷ অভিযুক্তের স্বীকারোক্তির পর ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী অপরাধীকে সাজা দিতে পারেন, তবে কারাদণ্ডের ক্ষেত্রে দুই বছরের বেশি নয়৷
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘‘এটা তো স্পষ্ট যে, দেশের পুলিশ বাহিনীর এখন যা অবস্থা, তা দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না৷ সেনবাহিনী মাঠে আছে৷ তাদের আরো কার্যকর করতে এই ম্যাজিষ্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া হয়েছে৷ এটা আইন এবং সংবিধানসম্মত৷’’
‘‘তবে প্রশ্ন হলো, তাদের জবাবদিহিতা কোন কর্তৃপক্ষের কাছে থাকবে৷ সাধারণ মানুষের কোনো অভিযোগ থাকলে তারা তো আর সেনা প্রধানের কাছে গিয়ে অভিযোগ করবেন না৷ আর তারা তো সিভিল কাজ করবেন৷ কিন্তু প্রজ্ঞাপনে তারা কোথায় জবাবদিহি করবেন, তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি৷ আর এটা মানবাধিকার রক্ষার জন্য জরুরি৷ আর তারা তো গ্রেপ্তার করবেন, ওয়ারেন্ট ইস্যু করবেন৷ তাহলে তারা আসামিদের কোথায় রাখবেন তা-ও বলা হয়নি৷ সাধারণভাবে মামলা তো থানায় হবে৷ সেই বিষয়গুলোও স্পষ্ট করা প্রয়োজন,‘‘ বলেন তিনি৷
তার মতে, ‘‘নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা আছে৷ তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারেন৷ জরিমানা ও দণ্ড দিতে পারেন৷ কিন্তু এক্ষেত্রে তারা তা করবেন বলে মনে হয় না৷ আর একই ব্যক্তির হাতে গ্রেপ্তার ও বিচারের ক্ষমতা থাকা ঠিক না৷’’
বাংলাদেশে ৫ আগস্ট থেকেই সেনাবাহিনী মাঠে আছে৷ তারা এইড টু সিভিল পাওয়ার হিসেবে জেলা প্রশাসনের অধীনে কাজ করছেন৷ এখন তারা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযানেও অংশ নিচ্ছেন৷ কিন্তু ম্যাজিষ্ট্রেসি পাওয়ার পাওয়ায় তারা স্বাধীনভাবে কাজ করবেন৷
এইক্ষেত্রে সেনাবাহিনী ও পুলিশের কাজের সমন্বয়ের বিষয়টিও স্পষ্ট নয়৷
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘‘যিনি গ্রেপ্তার ও তদন্ত করবেন, তিনি বিচারিক কাজ করবেন না৷ কিন্তু এই ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যরকম হয়েছে৷ এখানে পুলিশ ও ম্যাজিষ্ট্রেসি পাওয়ার এক করে তাদের দেয়া হয়েছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের শুধু মেট্রোপলিটন এলাকায় ম্যাজিষ্ট্রেসি পাওয়ার আছে৷ এর বাইরে নেই৷ তবে এখন নানা ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে৷ আনরেস্ট তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে৷ শিল্প এলাকায়ও অস্থিরতা দেখ দিচ্ছে৷ সেই বিবেচনায় সেনাবাহিনীকে ম্যাজিষ্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয়৷’’
মানবাধিকার
যৌথ অভিযানে সেনা ও পুলিশ হেফাজতে এ পর্যন্ত তিন জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান৷ তাদের মধ্যে গাইবান্ধায় ১১ সেপ্টেম্বর যৌথ বাহিনীর হাতে আটক পাঁচজনের মধ্যে দুইজন মারা যান৷ তারা হলেন শফিকুল ইসলাম ও সোহরাব হোসেন৷ তারা আওয়ামী লীগের কর্মী বলে জানা গেছে৷ আর ময়মনসিংহে যৌথ অভিযানে আটকের পর মঙ্গলবার মারা গেছেন যুবদল নেতা সাইদুল ইসলাম৷
নূর খান বলেন,‘‘আমরা কোনোভাবেই বিগত সরকারের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম- এসব দেখতে চাই না৷’’
তার কথা, ‘‘সেনাবাহিনীতে ম্যাজিষ্ট্রেসি পাওয়ার দেয়ার মানে হলো সিভিল প্রশাসন আসলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে সক্ষম না৷ এটা এক ধরনের নৈতিক পরাজয়৷ কিন্তু তারপরও তো পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে৷ পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে আগে ব্যবহার করা হয়েছে৷ তাদের মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে৷ আবার থানায় হামলা হয়েছে৷ অস্ত্র লুট হয়েছে৷ পুলিশ তো আর ভালো অবস্থায় নেই৷’’
আর নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর(অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘‘এই ধরনের কাজে সেনা সদস্যদের নিয়োগের আগে পর্যাপ্ত ব্রিফিং করতে হয়৷ আর্মিতে জাজ, অ্যাডভোকেট জেনারেল আছেন, তাদের উচিত হবে সেনা সদস্যদের প্রোপারলি ব্রিফ করা, যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা না ঘটে৷’’