আমাদের একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন, উনার নাম এ কে আব্দুল মোমেন। মঙ্গলবার তিনি আমাদের জানিয়েছেন, র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অনাবাসী ভারতীয়রাও (নন রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান-এনআরআই) মার্কিন সরকারকে এ বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছে।
দুই দিন আগে গত রোববার ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা ছাড়া র্যাবের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই।
আমাদের কয়েকটি প্রশ্ন আছে? মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভারতের সহযোগিতা চাওয়ার পাটাতন বা পটভূমি কী? সহযোগিতা কি চিঠি দিয়ে চাওয়া হয়েছে না মুখে মুখে? কে করলেন এই আবেদন আপনি না আপনার প্রধানমন্ত্রী নাকি নিচের কেউ? সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ মানে কি ভারতের সাহায্য চাওয়া? গোপনে সাহায্য চেয়ে তা আবার প্রকাশ কেন করলেন, ভারত কি আবেদন পাত্তা দিচ্ছে না? র্যাব কর্মকর্তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য এত সিরিয়াস কেন সরকার?
-
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
দুই দশক
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিন হাজার ৩৬৪ জন৷ বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল ২০০৫-০৬ সালে৷ ২০০৫ সালে ৩৭৭ জন এবং ২০০৬ সালে ৩৬২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ তবে আরেক মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে দুই দশকে এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা চার হাজারের বেশি৷
-
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
আওয়ামী লীগের ইশতেহার
সেসময় ক্রসফায়ার নামে পরিচিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগের৷ ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়৷ সুশাসন প্রতিষ্ঠার অনুচ্ছেদে ৫.২ নং অঙ্গীকারে বলা হয়েছিল, ‘‘বিচারবিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে৷ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে৷’’
-
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
কথা রাখেনি সরকার
ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখেনি আওয়ামী লীগ সরকার৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছরে ২০০ জনের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে মারা গেছেন আড়াই হাজারের বেশি মানুষ৷ (২০১৮ সালের ডিসেম্বরের ছবি)
-
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
নির্বাচন ও ক্রসফায়ার
আসক এর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশ নির্বাচনী বছর ও তার আগের বছরে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ নির্বাচনের আগের বছর ২০১৩ সালে প্রতিমাসে গড়ে ২৭ জন বা মোট ৩২৯ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে৷ ২০১৮ সালের ৪৬৬ টি ঘটনা ঘটে যা আগের বছরের চেয়ে তিনগুণ বেশি৷ ২০১৯ সালে এমন ঘটনা ঘটেছে ৩৮৮ টি৷
-
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
২০২১ সাল নিম্নমুখী
আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২২২টি৷ সেখানে গত বছর এমন ঘটনা ঘটেছে মোট ৮০টি৷ এর মধ্যে ৩০টির সঙ্গে জড়িত র্যাব, ২৪টিতে পুলিশ, দুইটিতে র্যাব ও পুলিশ এবং ১৭টি ঘটনায় বিজিবির নাম এসেছে৷ ৪৮টি ক্ষেত্রেই গেপ্তারের আগে ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছে৷
-
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
নানা নাম
তবে এগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে স্বীকার করে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ কখনও ক্রসফায়ার, কখনও বন্দুকযুদ্ধ কখনওবা এনকাউন্টার হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে বিবৃতি দেয়া হয় বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে৷ সম্প্রতি র্যাব দাবি করেছে তাদের সদস্যদের সঙ্গে ‘ধস্তাধস্তিতে’ গাজীপুরে এক ব্যক্তি মৃত্যু হয়েছে৷
-
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
একরামুল হত্যা
২০১৮ সালে ২৬ শে মে র্যাবের ‘মাদক বিরোধী অভিযানে’ কথিত 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন কক্সবাজারের কাউন্সিলর একরামুল হক৷ কিন্তু স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে নিহত হওয়ার আগ মুহূর্তের মোবাইলের কথোপকথন ফাঁস হওয়ার পর র্যাবের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে৷ এই ঘটনায় একরামুলের পরিবার মামলা করতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে৷
-
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
মেজর সিনহা হত্যা
বাংলাদেশে বিচার বহিভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা৷ ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি৷ টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ নয় পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন৷ ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে আরো শতাধিক এমন হত্যার অভিযোগও রয়েছে৷
-
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ এই নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগের পাঁচদিনে ‘ক্রসফয়ারে’ পাঁচজন নিহত হয়েছেন৷ কিন্তু এরপর আর এমন ঘটনা ঘটেনি৷
-
তথ্য, পরিসংখ্যানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
সরকারের বক্তব্য
তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে কিছু হয় না বলে বারবারই দাবি করে আসা হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে৷ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরও সরকার এই কথা জোর দিয়ে বলে আসছে৷ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি৷ এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে কোনো প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়ে এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে৷’’
মোমেন কি নিজেকে শুনতে পান? তিনি বলেছেন, অ্যামেরিকাতে নন রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ানের সংখ্যা ৪৫ লাখ। তারা বেশ প্রভাবশালী। তারাও এটি (নিষেধাজ্ঞা) প্রত্যাহারের জন্য মার্কিন সরকারকে অনুরোধ করছেন।মানে কী? ৪৫ লাখ অনাবাসী ইন্ডিয়ান বাইডেন সরকারকে বলেছেন, র্যাব থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিন? মোমেনের ভাষায়, এটা সম্ভব হয়েছে প্রতিবেশী ভারত বন্ধুরাষ্ট্র বলে! সিরিয়াসলি! সিরিয়াসলি মিস্টার ফরেন মিনিস্টার!
পিটার হাসের এ বক্তব্যের প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা জবাবদিহির কথা বলেছেন। আমাদের তো অভ্যন্তরীণ জবাবদিহির ব্যবস্থা আছে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। শিয়াল ও কুমির ছানার গল্পটি নারায়ণগঞ্জের ফাঁসির ঘটনা দিয়ে রিপ্লেস করা এখন সময়ের দাবি।
খালেদ মুহিউদ্দীন, প্রধান, ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগ
মোমেন আমাদের আরও জানিয়েছেন, অন্যায়ের জন্য কয়েকশ র্যাব কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। কী অন্যায়ের জন্য? কে বিচার করল? কত খুন কত গুমের জন্য কারা কী শাস্তি পেল?
সেদিন তার দপ্তরে মোমেন-মাননীয় মন্ত্রী আমাদের আরও বলেন, আমাদের উল্টো দল যারা, শুধু মৃত্যুর খবর তাদের কাছে পৌঁছায়, কোন প্রেক্ষিতে হয়েছে, সেটা আর তারা বলেন না। কোন প্রেক্ষিতে মৃত্যু হয়েছে আপনিই না হয় বলেন, মিস্টার ফরেন মিনিস্টার। বলেন তো কোন প্রেক্ষিতে মৃত্যু হয়েছে? উত্তর দেবার আগে তৈরি ফাইল পড়ে নিতে যেন ভুল করবেন না। ওই যে, এক দেশে ছিল..অস্ত্র উদ্ধার আর ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসী.. আপনার বয়স হয়েছে মাননীয় মন্ত্রী, ব্যাকগ্রাউন্ডে শুনতে পাবেন কিনা জানি না..আমরা কিন্তু শুনি, আব্বু তুমি কান্না করছ যে!
যুক্তরাষ্ট্রের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাখ্যায় তারা সন্তুষ্ট না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে আব্দুল মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ব্যাখ্যায় এখনো হয়তো সন্তুষ্ট হয়নি। আগামী দিনে হয়তো হবে।
পরের সন্তুষ্টির সাধনায় আপনাকে আরও কত কী যে করতে হবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী!